৩ জুন ১৯৮৯ সাল। মারা গেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি। তার জানাজা এবং শোক মিছিলে যোগ দিতে তেহরানে নেমেছিল লাখ লাখ মানুষের ঢল। মরদেহ নিয়ে চলেছিল শোকের মাতম। খুব কাছ থেকে সেই ঘটনা দেখেছেন, এমন দু’জনের সঙ্গে কথা বলেন বিবিসির গোলনুশ গোলশানি।
Advertisement
মেহেদি খালাজি তখন ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী, পড়েন মাদ্রাসায়। ইরানের কোম শহরে বাবা-মার সঙ্গে থাকেন। তিনি সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তখন সকাল সাতটা। আমরা সকালের নাশতা করছি। রেডিওতে খবর চলছে। সংবাদ পাঠক খবর পড়ছেন, কিন্তু একেবারেই ভিন্ন মেজাজে। তিনি বলছিলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় এবং মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি আমাদের ছেড়ে বেহেশতে চলে গেছেন।
রেডিওতে এই খবর শুনে মেহেদির মা কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি খুবই কান্নাকাটি করছিলেন। কাঁদতে শুরু করলেন তার ছেলে-মেয়েরাও। খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সব লোকজন স্বতস্ফূর্তভাবে তাদের বাড়ি-ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলো। তিনি আরও বলেন, আমরা সেদিন কোম শহরের রাস্তায় যাকেই দেখেছিলাম, তিনিই কাঁদছিলেন।
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যূত হন। সেই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। সেই বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সর্বময় ক্ষমতা ছিল খোমেনির হাতে। তার ভক্তদের চোখে খোমেনি ছিলেন অনেকটা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি কেবল একজন রাজনীতিকই ছিলেন না তার চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন।
Advertisement
মেহেদি খালাজি আরও বলেন, আমাদের বাড়ির সব দেয়ালে খোমেনির একটা ছবি ঝুলতো। যখন টেলিভিশনে বা রেডিওতে খোমেনি কথা বলতেন, সবাই চুপ করে তার কথা শুনতেন। কাজেই বলতে পারেন খোমেনির উপস্থিতি ছিল সবখানেই। আমার বাবার কাছে তিনি নিজের বাবার চেয়েও অনেক বড় কিছু ছিলেন। খোমেনির জন্য তার যতটা আবেগ দেখেছি, নিজের বাবার জন্যও তার মধ্যে অতটা আবেগ দেখিনি।
মেহেদি খালাজির বাবা ছিলেন ইরানের কোম শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা। মেহেদি খালাজি যখন শিশু, তখন তার বাবার সঙ্গে গিয়ে সামনা-সামনি আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।
মেহেদি বলছেন, খোমেনি ছিলেন খুবই সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারি। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একেবারেই ভিন্ন দুটি বিষয় দেখেছি। যখন তিনি বড়দের সঙ্গে থাকতেন তখন তিনি খুবই গুরুগম্ভীর। তাকে হাসতে দেখা যেত খুবই কম। কিন্তু শিশুদের সঙ্গে তাকে দেখা যেত একেবারেই ভিন্ন মেজাজে। তিনি প্রচুর হাসতেন, শিশুদের সঙ্গে খেলতেন। শিশুদের সঙ্গে মেশার সময় তার মধ্যে প্রচুর আবেগ দেখা যেত।
শিশুদের সঙ্গে হয়তো তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। বিপ্লবের পরপরই তিনি কঠোর হাতে তার সমালোচকদের দমন করা শুরু করলেন।
Advertisement
বহু মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলালেন। অনেককে পাঠালেন নির্বাসনে। ইরাকের সঙ্গে তিনি আট বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন, সেই যুদ্ধে মারা গেল হাজার হাজার ইরানি। ইরানের অর্থনীতি তখন ধ্বংসের শেষ সীমায়। শান্তিু চুক্তির অবস্থা খুবই নাজুক, এ অবস্থায় অনেক ইরানির মনেই তখন প্রশ্ন, তার অবর্তমানে দেশের হাল কে ধরবে।
খোমেনির মৃত্যুর পর সব জায়গায় রেডিও বাজছিল। সবাই বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকা শুনছিল। খোমেনির মৃত্যুর পর ইরানের সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সবাই পশ্চিমাদের বিশ্লেষণ শুনতে চাচ্ছিল।
আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যু নিয়ে শুধু ইরানে নয়, তোলপাড় চলছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। ফরাসি আলোকচিত্রী অ্যারিক বুভে প্যারিস থেকে বিমানে চড়ে ইরানে গেলেন খোমেনির জানাজার সংবাদচিত্র সংগ্রহের জন্য। কিন্তু তিনি জানতেন, ইরানে ঢোকাটা সহজ হবে না।
আমাদের দলে আমরা প্রায় আট-দশজনের মতো সাংবাদিক ছিলাম। আমাদের কারোই ইরানের ভিসা ছিল না। কাজেই আমরা বুঝতে পারছিলাম না, আমাদের ইরানে ঢুকতে দেয়া হবে কি না। মধ্যরাতের পর দুই-তিনটার দিকে আমরা ইরানে পৌঁছালাম। বিমানবন্দরে ইরানি কর্তৃপক্ষ আমাদের ঢুকতে দিচ্ছিল না। আমরাও জেদ ধরলাম, কেন আমাদের যেতে দেবে না। তারপর ভোর পাঁচটার দিকে কি হলো বুঝতে পারলাম না, ইরানি কর্তৃপক্ষ আমাদের ইরানে প্রবেশের অনুমতি দিল। এরপর সকাল সাতটার দিকে আমরা চলে গেলাম জনতার মাঝখানে। সেখানে তখন দশ লাখের বেশি মানুষ।
জুনের পাঁচ তারিখে তেহরানের রাস্তায় শেষ পর্যন্ত কত মানুষ হয়েছিল তা বলা মুশকিল। কারও হিসেবে ২০ লাখ, কারও হিসেবে তার চেয়েও বেশি বা ৩০ লাখ। কালো কাপড়ে আবৃত মানুষেরা তাদের বুক চাপড়ে প্রিয় নেতার জন্য শোক প্রকাশ করছিল। আয়াতুল্লাহ খোমেনির দেহ চাদরে আবৃত করে একটি কাঁচের বাক্সে রাখা হয়েছিল। তার বিখ্যাত পাগড়িটা রাখা ছিল দেহের ওপরে।
সেই লাখ লাখ মানুষের ভিড়ের মধ্যে ছিলেন মেহেদি খালাজি। তিনি বলেন, শেষ বিকেলে আমরা সেখানে পৌঁছাই। তখন বসন্তকাল শেষে গ্রীষ্ম মাত্র শুরু হচ্ছে। একটু গরম পড়েছে। আমাদের সবার গায়ে কালো শার্ট। আমরা ঘামছিলাম। ঘাম আর চোখের পানির নোনতা স্বাদ আমাদের মুখে। অনেকেই তখন আবেগে কাঁদছে, কেউ কেউ শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাঁচের বাক্সটির দিকে।
পরের দিন সকালে মানুষের ভিড় আরও বাড়লো। উত্তর তেহরানের ওই অংশের সব রাস্তাঘাট তখন মানুষের ভিড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আয়াতুল্লাহ খোমেনির মরদেহ রাস্তা দিয়ে দক্ষিণ তেহরানের কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু তার মরদেহ রাখা কাঁচের বাক্সটি যখন খোলা হলো, সেই মূহুর্তেই শুরু হলো বিশৃঙ্খলা।
সবাই তখন চিৎকার করছে, কাঁদছে। সবাই খোমেনির দেহ দেখতে চাইছিল, সবাই লাশ স্পর্শ করতে চাইছিল। নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণপনে চেষ্টা করছিল জনতাকে ঠেকানোর। তারা খোমিনের মৃতদেহ নিয়ে সামনে এগোনের চেষ্টা করছিল।
এই বিশৃঙ্খলা আর হুড়োহুড়ির মধ্যে মারা যায় আটজন লোক আহত হয় অারও কয়েকশ মানুষ। অ্যারিক বুভে আটকে পড়েছিলেন এই জনতার ভিড়ে। হেলিকপ্টারে করে সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কবরস্থানে, যেখানে খোমেনিকে কবর দেয়া হবে। কিন্ত অ্যারিক বুভে ভিড়ে আটকে পড়ায় সেই হেলিকপ্টারে যেতে পারেননি। জনতা যখন নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে খোমেনির কফিনের কাছে পৌঁছে গেছে, তখন খুব কাছেই ছিলেন তিনি।
সবাই সবাইকে ঠেলছিল। মনে হচ্ছিল একটার পর একটা জনতার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। কফিনটা আমার কাছ থেকে তখন ৫০ থেকে ৭০ মিটার দূরে। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে আমি কোনো রকমে কয়েকটা ছবি তুলতে পেরেছিলাম।
নিরাপত্তা বেষ্টনী তছনছ করে শোকার্ত উন্মাদ-প্রায় জনতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির দেহ কেড়ে নিল। এরপর আধঘন্টা ধরে এই মরদেহ জনতার মধ্যে হাত বদল হতে লাগলো। মৃতদেহ আবৃত করে রাখা চাদরটি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলা হয়। আধ ঘন্টা পরে নিরাপত্তা বাহিনী আবার মরদেহের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
খোমেনির মরদেহ ঘিরে এই উন্মাদনা দেখে হতবাক হয়ে যান অ্যারিক বুভে। আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে এই অবস্থায় দেখবো, এটা কখনো ভাবিনি। কারণ তিনি তো একজন নেতা। তিনি বিশ্বের একটা অঞ্চল বদলে দিয়েছেন। তার দেহ নিয়ে যা ঘটলো, তা অবিশ্বাস্য।
লাখ লাখ মানুষের যে শোক মিছিল কবরস্থানের দিকে যাওয়ার কথা, তা কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ালো। খোমেনির মৃতদেহ উদ্ধারের পর তা নতুন এক চাদরে মোড়া হলো। এবার সেটি একটি লোহার বাক্সে ভরে হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হলো কবরস্থানে।
সেদিন শেষ বেলায় খোমেনির দাফন সম্পন্ন হলো দক্ষিণ তেহরানের কবরস্থানে। মেহেদি খালাজির ধারণা আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে ঘিরে শুধু ইরানের মানুষ বা মুসলিমদের নয়, বিশ্ব জুড়ে যারাই নির্যাতিত বা বঞ্চিত, তাদের তিনি ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
বিংশ শতাব্দীতে চলতে হলে যা যা দরকার, বিশেষ করে একটা মুসলিম দেশে তার সবকিছুই তার চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছিল। সে জন্যেই তিনি বিশ্বজুড়ে এতো ব্যাপক সংখ্যক মুসলিমকে এতটা প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন।
খোমেনির মৃত্যুর পর তার জায়গায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে আসেন আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি। তিনি এখনো ইরানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন।
মেহেদি খালেজি তার ধর্মীয় পড়াশুনা শেষ করেছেন, কিন্তু খোমেনি পরবর্তী ইরানি নেতাদের ওপর তার কোন আস্থা নেই। তিনি এখন একটি মার্কিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিয়া রাজনীতির বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। আর অ্যারিক বুভে আয়াতুল্লাহ খোমেনির শোক মিছিলের যেসব ছবি তুলেছিলেন, তার জন্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার পান।
কেএ/টিটিএন/এমএস