মতামত

টেকসই হবে রাজনীতি?

২০১৫ সালে বিশ্ব একমত হয়েছিল, ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে নিজে সে টেকসই উন্নয়ন লাভ করবে। এর ভেতরে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব ঠেকানোর প্রতীজ্ঞাও গুরুত্বের সাথে ছিল। নড়েচড়ে বসা বিশ্ব ভাবতে বসল, টেকসই মানে কি? উন্নয়ন কাকে বলে? টেকসই উন্নয়ন হলে কার কি লাভ? টেকসই উন্নয়ন পেতে কার কি দায়িত্ব পালন করতে হবে?

Advertisement

আঠারো শতকের ইউরোপে বন-জঙ্গল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোচনার সময় টেকসইত্ব বা Sustainibility শব্দটা প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু এই মাত্র ১৯৮০ সালে শব্দটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চরিত্র নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত হয়।যখন বার্টল্যান্ড কমিশন টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞা এভাবে ব্যাখ্যা করে- উন্নয়ন যদি বর্তমানে চাহিদা মেটাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর পথকে সংকুচিত না করে ফেলে, তবেই তা টেকসই উন্নয়ন। 

বাপ গাছ লাগিয়ে গেছেন, আমি তার ফল খাচ্ছি। গাছটাকে কেটে যদি ফেলি, আমার বাচ্চা খেতে পারবে না। গাছটারও বয়স হচ্ছে। তাই আমার বাচ্চার কথা ভেবে ফল থেকে জন্মানো চারা গাছটারও যত্ন নিতে আমি তৎপর। আমার উন্নয়ন আমার বাচ্চার উন্নয়নকে ব্যাহত করবে না। আমার খিদে মেটানোর সময় মনে রাখতে হবে, আমার বাচ্চারও খিদে পাবে এবং সেই খিদে মেটানোর উপায় যেন আমি বন্ধ করে না ফেলি। 

জাতিসংঘ ১৯৯২ সালে সেই প্রথম বারের মতো ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরো’তে পরিবেশ আর উন্নয়নকে সমান গুরুত্ব দিয়ে কনফারেন্স ডেকেছিল। রাজনীতিবিদ-বিজ্ঞানী-সাধারণ মানুষ মিলে মিশে আলোচনায় বসেছিলেন। বিজ্ঞান আর রাজনৈতিক নীতি এক সাথে হাঁটবে বলে কথা দিয়েছিল। টেকসই উন্নয়ন মানে কি, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছিল। প্রযুক্তির উন্নয়ন, অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদি নানান উন্নয়ন মিলেমিশে সুনিশ্চিত করবে বিশ্বের পরিবেশ আর মানুষসহ সকল প্রাণির অস্তিত্ব, এমন প্রতীজ্ঞা মেলে দিল ডানা। আসলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবকে যে কোন মূল্যে ঠেকাতে পারাই টেকসই উন্নয়নকে চূড়ান্ত রূপ দিতে পারে, এই উপসংহার তখনি পাওয়া হয়ে গেল। 

Advertisement

এরপরও গত পঁচিশ বছর ধরে বারবার বিশ্ব একসাথে বসেছে, আলোচনার টেবিলে সুনামি বইয়ে দিয়েছে, কোটি কোটি ডলার ব্যয় হওয়ার পর প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে গোটা বিশ্ব প্রথমবারের মতো এক হতে পেরেছে। আর ঠিক তার পরই বহু কষ্টে অর্জিত প্যারিস চুক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক এক ব্যক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বদৌলতে ‘প্রভুত্ববাদী রাজনীতি’ নামক দুষ্টুচক্রের তালে পড়ে এক নিমিষে অস্বীকার করে বসেন, আর তাতে বিশ্ব দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। এক দিকে শোষক। আরেক দিকে শোষিত। এক দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশসকল। আরেক দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় বেচারা দেশগুলো। কে ভাববে এদের কথা?

রাজনীতিবিদদের কানে কেবল মাত্র পানি ঢুকেছে, যদিও বিজ্ঞানী-পরিবেশবাদীগণ সেই ১৯৭০ সাল থেকেই বলে আসছেন, সীমিত সম্পদের এই পৃথিবী মানুষের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। দরকার টেকসই উন্নয়ন। দরকার সহনশীলতা। প্রকৃতি-পরিবেশ-রাষ্ট্র যেন যে কোন সমস্যাকে কাটিয়ে উঠার সক্ষমতা অর্জন করে এমনভাবে, সমস্যা ঘটে যাওয়ার আগে তার অবস্থা যেমন ছিল ঠিক সেরকম অবস্থায় সে ফিরে আসতে পারে। এই ধারণাকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হচ্ছে, প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ করে দিয়ে গড়ে তোলা মানুষের সম্পদের কোন দরকার নেই। সত্যি বলতে কি, প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার নিজের স্বার্থে খরচ করে ফেলার অধিকার কারোরই নেই। এই কথা সে কি মানবে, যার সম্পদ ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে? 

যার নেই, নীতিকথা তার মুখেই, ব্যাপারটা যেন সেরকমই। যার আছে, তার ঘরে বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আরম-আয়েশের ব্যবস্থা আছে, বিনিময়ে এসবই ঘটাচ্ছে কার্বন নিঃসরণসহ পৃাকৃতিক বিপর্যয়। মানুষ কি তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিবর্জিত জীবন যাপন করবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন সবুজ প্রযুক্তির কথা, যে প্রযুক্তি মানুষকে আরাম দেবে প্রকৃতির ক্ষতি না করে। কোথায় সেই প্রযুক্তি? ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ-এর মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কি শুরু হয়েছে? ওদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রেখে কোন্ উন্নয়ন টেকসই হবে? 

আসলে অর্থনীতিবিদ-বিজ্ঞানী-সমাজবিজ্ঞানী, যার কথাই বলুন না কেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পরিবেশবান্ধব কোন উন্নয়নের বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, পরিকল্পনার ভেতরই তো আসবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনৈতিক হাতুড়ি মেরে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে চাইছেন জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর সব উদ্যোগ। তাই, সবুজ রাজনীতির সন্ধানে পৃথিবী, এ কথা বললে আসলে ভুল হয় না একটুও। রাজনীতি গবেষক এন্ড্রু ডবসন রাজনৈতিক তত্ত্বগুলোকে সবুজ রাজনীতির রেখাতে সাজিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলেছেন। ইএনআরসি স্টেপস’ সেন্টারের আওতায় তিনি সব দেশের সব রাজনীতির সবুজ হয়ে ওঠার একটি নির্দেশনা দাঁড় করিয়েছেন। এর ভিত্তিতেই রাজনীতির মুখ্য ভূমিকায় টেকসইত্ব’র কোন সংস্করণ কার জন্য প্রযোজ্য, বর্তমান অবস্থা থেকে টেকসই অবস্থায় রূপান্তরের উপায় কি হবে, সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে সবাই, এমনকি সাম্প্রতিক আগুনমুখো জি২০ সম্মেলনেও চলছে এই তর্ক।

Advertisement

তর্ক অনেক। সম্পদের অভাব ইতোমধ্যে টের পাচ্ছে বিশ্ব। তাই যারা এতকাল ভোগ করছিল, তারা ভোগবাদীতা থেকে বেরিয়ে আসুক। সম্মেলনস্থলে জনতা প্ল্যাকার্ড ওঠাল, ডাউন ক্যাপিটালিজম; ক্যাপিটালিজম ইজন্ট ওয়ার্কিং। পৃথিবীর সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না বলেই সোমালিয়ার মানুষ না খেয়ে মরছে আর কোন কোন দেশে খাবার ফেলে দিচ্ছে ভুঁড়িতে আর জায়গা না দিতে পারা অবিবেচক অমানুষের দল। সম্মেলনস্থলে জনতার প্ল্যাকার্ডে লেখা- গিভ মাই ফুড; স্টপ জি২০। কার্বন-নিঃসরণে একমত হতে না পারা দেশগুলোর পারমাণবিক আস্ফালনে কেঁপে ওঠে নিরীহ মানুষ, কেননা এর ফল ভোগ করতে হবে তাদেরকেই। জলবায়ু ফান্ডে এক পয়সাও দেবে না ঘোষণা দেওয়া ক্ষমতাধর দিব্যি অস্ত্র কেনাবেচা করছে মানুষ মারার পাশবিক উন্মাদনায়। দেশে দেশে ঝগড়া-বিবাদ-আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, গৃহযুদ্ধ লেগে আছে বা লাগানো আছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকা ঝুলছে সুতোর উপর। প্রভুত্ববাদী মানসিকতা পৃথিবীকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। জনতা প্ল্যাকার্ড ওঠায় বাধ্য হয়ে, উই ওন্ট পে ফর দেয়ার ক্রাইসিস; গো টু হেল; জি২০-ওয়েলকাম টু হেল! জাহান্নামে যাক্ এরা।

মুশকিল কি জানেন? জাহান্নামের আগুনে বসেও এরা বুঝি পুষ্পের হাসিই হাসবেন। তা না হলে এ্যাতো প্রতিবাদ-ধিক্কার চোখে দেখে আর কানে শুনেও ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলছেন, জি২০ সম্মেলন সফল, তিনি সফল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভালই বলেছেন, টিভিতে দেখা ট্রাম্প আর সম্মেলনে দেখা ট্রাম্প এক নন।

কোন্ ট্রাম্প কেমন, তা জেনে কাজ নেই এটা বুঝে গেছে ট্রাম্প বাদে বাকিরা। আর তাই আমেরিকাকে বাদ দিয়ে বাকি ১৯টি দেশ বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছে। প্যারিস চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বিশ্বের ক্ষমতাধর ১৯টি দেশের রাজনৈতিক নেতাগণ। টেকসই প্রযুক্তি, টেকসই অর্থনীতির পাশাপাশি সূচনা হ’ল টেকসই রাজনীতি’র নতুন যুগের। সবুজ প্রযুক্তি, সবুজ অর্থনীতির মতো পুরোপুরি সবুজ হয়ে উঠুক এই নতুন ধারার মানবিক রাজনীতি, এই ইঙ্গিতই তো পেলাম। এই বিচারে এবারের জি২০ সম্মেলন সফল, অবশ্যই সফল।   

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, নাট্যকার। 

এইচআর/এমএস