আমার বাসায় বুলবুলি ছিল গৃহকর্মী। যখন এসেছিল তখন তার বয়স ১২ বছর হবে। আমার দুই সন্তানের বয়স তখন ৫ ও ৩ বছর। আমার দুই শিশু সন্তানের কাছে বুলবুলি প্রায়শই দারুণ সব বিস্ময় উৎপাদন করতো। একদিন আমার ছেলে দৌঁড়ে এসে আমাকে বলে, মা মা জানো কী হয়েছে! বুলবুলি আপু নাকি ইঁদুর খায়! আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওমা তাই নাকি! তুমি শুনে এসোতো ইঁদুর খেতে কেমন মজা! যদি মজা হয় তাহলে আমরাও একদিন টেস্ট করবো। সে মুখে ওয়াক ওয়াক শব্দ করতে করতে আমার সামনে থেকে চলে গেল। ফিরে এসে ইঁদুরের রেসিপি জানিয়ে বললো বুলবুলি আপু বলেছে ইঁদুর খেতে নাকি খাসির মাংসের মতো! এটা বলেই মুখে ওয়াক ওয়াক শব্দ করতে করতে সে আবার বুলবুলির কাছে গেল। হয়তো নতুন কিছু আবিস্কার করতে।
Advertisement
গ্রামের শিশু কিশোরদের মধ্যে প্রচলিত অনেক খেলা ওরা তিনজন মিলে খেলতো। নানারকম মজার ছড়া কেটে কেটে সেসব খেলা খেলতে হয়। আমি খুব মজা পেতাম এই ভেবে যে, যাক ঢাকায় থেকেও আমাদের ফেলে আসা শৈশবকে আমার সন্তানরা কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারছে। একদিন ফোনে বাবার সাথে কথা বলে বুলবুলি দৌঁড়ে এলো আমার কাছে। মামী, আমাদের বাড়ির সবাই খ্রিস্টান হয়ে গেছে। আমিও নাকি হয়ে গেছি তবে আমার দীক্ষা নেয়া বাকি আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম তাই নাকি? সে জানালো, খ্রিস্টান মিশনারি এখন থেকে তার পরিবারের প্রতি সদস্যের জন্য প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার চাল, ডাল ও টাকা দেবে। স্কুল পড়ুয়াদের জন্য মিশনারি কর্তৃপক্ষ স্কুলের খরচ দেবে তাই তাকে তার বাবা আর বাসায় কাজ করাতে চাচ্ছে না। তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে বাবা।
আমার মনে আছে বুলবুলি যেদিন আমার বাসা থেকে চলে যাচ্ছিল আমি অকারণে নিজেকে সেদিন বেশি ব্যস্ত রেখেছিলাম। বুলবুলির কাছে থেকে নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখছিলাম। আজ কিছুতেই আমি ওর সামনে পড়তে চাই না। একসময় সে নিজেই কাছে আসলো, মামী যাই! বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো মামী আমাকে ভুলে যাইয়েন না। সেদিন বুলবুলির সাথে আমার পুরো পরিবার কেঁদেছিল। আমি এখনো বুলবুলির সেই আকুতি শুনতে পাই- মামী আমাকে ভুলে যাইয়েন না। বুলবুলি সাঁওতাল হিন্দু পরিবারের মেয়ে ছিল। তার বাড়ি ছিল নওগাঁ ও চাপাই নবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকায়। আমার বাসা থেকে যাওয়ার পরেও বুলবুলির সাথে মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা হতো।
আস্তে আস্তে একসময় সেই যোগাযোগটা কমে যায়। প্রায় দুই বছর পরের একদিন রাত ১২টার পরে আমার মোবাইলে অচেনা একটি নম্বর থেকে ফোন আসলো। ফোনটা ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে শুনলাম কে যেন ফিসফিস করে বলছে, মামী আমাকে বাঁচান, আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করেন। আমি কণ্ঠ শুনেই বুঝে গেলাম বুলবুলির সাথে কথা বলছি। বুলবুলি কী হয়েছে তোর? তুই কোথায়? আমি ১ বছর ধরে ঢাকার ন্যাম ভবনে আছি। আমি খুবই কষ্টে আছি। সে ভবন ও বাসা নম্বর জানালো, বাসার গৃহকর্তার নাম জানালো। সে কেন সেই বাসায় থাকতে চায় না সেসব কারণও জানালো এবং সেইসাথে আর্জি জানালো আমাকে এখনই আপনার বাসায় নিয়ে যান। বললাম, এখনতো অনেক রাত! তোর বাবাকে ঘটনাটা জানিয়েছিস? উত্তর পাওয়ার আগেই অনেকগুলো কণ্ঠ শুনতে পেলাম এবং ফোন বন্ধ হয়ে গেল। আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরেরদিন ঐ নম্বরে একাধিকবার ফোন করলাম, ফোন বন্ধ।
Advertisement
২-৩ দিন পরে ঐ নম্বর থেকে আমার কাছে আবার ফোন এলো। একজন মহিলার কণ্ঠস্বর। উনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, এই নম্বর থেকে অনেকক্ষণ আপনার ফোন নম্বরে কথা বলা হয়েছে। আমি আজ মোবাইল চেক করে বিষয়টা টের পেলাম অথচ আপনার নম্বরটা অচেনা। একটু বলবেন কী আপনাকে কে ফোন করেছিল? আমি তৎক্ষণাৎ গুছিয়ে বললাম, আমার সাথে কারো কথা হয়নি। এই ফোনটি বাসার কমন ফোন, সবাই ব্যবহার করে। যেহেতু এটা একটা মেস বাড়ি, তাই এটা বারোয়ারী ফোন। আমার মাথায় তখন কাজ করছিল বুলবুলি ও তার পরিবারের নিরাপত্তা। নিজ এলাকার এক্সিস্টিং এমপির বাসায় থাকে সে। যেকোন কারণেই হোক বুলবুলির ওপরে কড়া নজর রাখা হয়েছে বলেই আমার ধারণা। সে আমার সাথে কথা বলেছে জানলে তার ওপরে নির্যাতন নেমে আসতে পারে। মহিলা আমার কাছে নিজের পরিচয় ভুলভাল দিলেন এবং খুব ইনিয়েবিনিয়ে আমার কাছ থেকে ফোন কে করেছিল সেই নামটি বের করার চেষ্টা করলেন। ফোন রেখে দিয়ে আমি বুলবুলির বাবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, পারিনি।
শেষঅব্দি জানতে পারিনি বুলবুলির ভাগ্যে কী ঘটেছিল। এইযে আমি বুলবুলিকে সাহায্য করতে পারলাম না সেই বিষয়টা এখনো আমাকে কষ্ট দেয়। কেন আমি ন্যাম ভবনে গেলাম না ওকে দেখতে! কেন আমি ওর দায়িত্ব নিলাম না! মাঝে মাঝেই নিজেকে অমানুষ মনে হয়। আবার ভাবি গেলেই আমি কতটা উপকার করতে পারতাম, কিংবা কতটা বেশি ক্ষতি হতো ওর! কয়েকদিন ধরে গৃহকর্মী বিষয়ক ব্যাপক সমালোচনা পড়ছি পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গৃহকর্মী আর গৃহকর্তাজনিত সমস্যা বহুকালের। পৃথিবীজুড়েই আমরা সভ্যসমাজ গৃহকর্মী বিষয়ে একইরকম মানসিকতা ধারণ করি। তারা চব্বিশ ঘণ্টা শ্রম দিতে বাধ্য থাকবে আমরা ধরে নেই। তারা আমাদের টাকা দিয়ে কেনা সেটাও আমরা ধরে নেই। তারা নিজের মত প্রকাশে অপারগ আমরা ধরে নেই। এতোকিছু ধরার পরে একসময় আমরা মেনেই নেই তারা আসলে মানুষ না, তারা কেবল গায়ে গতরে খাটা দাসী বান্দি। তাদের ভালো থাকার অধিকার নেই। তাদের জন্মই হয়েছে সভ্যসমাজকে ভালো রাখার জন্য।
সাম্প্রতিক সময়ে সাবিনা নামের মেয়েটি আলোচলায় আসলেও এরকম অহরহ ঘটনা প্রতিদিনকার। শ্বাসরোধ করে মেরে আত্মহত্যা নামে প্রচার, ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলার ঘটনাও অনেক ঘটেছে। কিন্তু এই পুনরাবৃত্তি আর কত! গৃহকাজে সহযোগিতার জন্য প্রতিটা বাড়িতে এখন গৃহকর্মী অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে তবে প্রেক্ষিত যখন বাংলাদেশ। কই ইউরোপ আমেরিকায়তো লাগেনা! তার মানে দৈনন্দিন জীবন যাপনজনিত সাংসারিক নানাবিধ কাজকে তারা সহজতর করে নিয়েছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; গৃহকাজের দায়িত্ব একজনের ওপরে চাপিয়ে না দেয়া। আমাদের দেশে ঠিক উল্টা। এদেশে এখনো ছেলেকে বিয়ে করানোর কারণ নির্দিষ্ট। ছেলে মেসে থাকে, নিজে রেধে খেতে পারে না। যেহেতু একটা চাকরি পেয়ে গেছে তাই ছেলেকে রেধে খাওয়ানোর জন্য এখন বিয়েটা জরুরি।
এদেশে একজন পুরুষের জন্য বিয়ের উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো কাজ একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে গায়ে বাতাস লাগিয়ে চলা। সেক্ষেত্রে এদেশে প্রতিটা বাসায় গৃহকর্মী অবধারিত হয়ে পড়ছে। ইউরোপ আমেরিকা রাষ্ট্রীয় নানাভাবে সুবিধাদি প্রদান করে নাগরিক জীবনযাত্রার প্রক্রিয়াকে সহজ করে তুলেছে। কিন্তু আমাদের দেশে একজন কর্মজীবী মায়ের সন্তান লালনপালনেও কোন ডে-কেয়ার সেন্টারের সুবিধা নাই। হাতেগোনা যে কয়টা আছে সেখানে সাধারণ উপার্জনক্ষম মায়ের পক্ষে ব্যয়ভার সংকুলান করা সম্ভব হয় না। সুতরাং মায়েদের পক্ষে সেই বিশাল দায়িত্ব নেয়ার জন্য অপ্রশিক্ষিত গৃহকর্মীই ভরসা। এখনকার শহুরে ছুটা বুয়ারা নির্দিষ্ট কয়েকটা কাজের ফিরিস্তি অনুযায়ী গৃহকর্তার কাছ থেকে মাসিক বেতন নিয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে আসে, নির্দিষ্ট সময়ে চলে যায়। কিন্তু বাসায় থাকা গৃহকর্মীদের সময় ও শ্রম দুটোই আনলিমিটেড। বাসায় গৃহকাজে নিয়োজিতদের জন্য শ্রমসীমা নির্দিষ্ট করা উচিত। গৃহকর্তা ও গৃহকর্মী দুপক্ষের সুবিধার্থে গৃহকর্মী নিয়োগজনিত আইনকানুন থাকা উচিত।
Advertisement
স্বার্থরক্ষা না হলে দুপক্ষই যেন আইনের আশ্রয় নিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে। যেহেতু আমাদের পারিপার্শ্বিক নানা অসযোগিতার কারণে গৃহকর্মী ছাড়া দৈনন্দিন জীবন অনেকটাই অচল তাই দুপক্ষের স্বার্থ বিবেচনায় আনাটা এখন ভীষণভাবে জরুরি। একজন শিক্ষিত কর্মী কোন প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার আগে লিখিত আকারে দায়িত্বভার প্রাপ্ত হন। সেখানে চাকরিকালীন নানা সুবিধা ও কাজে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিলে কী কী শাস্তির বিধান আছে সেসব লিখিত আকারে থাকে। গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। প্রয়োজনে যেন দুপক্ষই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের বিবেকের চেয়ে বড় আইন পৃথিবীতে নেই। আমরা ভাবতে পারিনা কেন গৃহকর্মী আমাদের পরিবারের সদস্য! তাহলেই তো সমস্যার সমাধান।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর