বিশেষ প্রতিবেদন

৫৭ ধারা বাকস্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক পাস করেন। ২০০১ সালে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের নর্দামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় আইনে স্নাতক ডিগ্রি এবং ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ‘ব্যারিস্টার অ্যাট-ল’ সম্পন্ন করেন। ২০০৯ সালে তিনি ‘নিউ সাউথ ওয়েলস সুপ্রিম কোর্ট’ বারের সদস্য হন।

Advertisement

আইন পেশার পাশাপাশি তিনি একজন মানবাধিকারকর্মী ও ফেমিনিস্ট অ্যাকটিভিস্ট (নারীবাদীকর্মী)। গবেষণা করছেন সমতালের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিয়েও।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দুই পর্বের ধারাবাহিকের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বিতর্ক চলছে। মামলায় ঝুলছেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। অনেকে এটিকে খড়্গ হিসেবে দেখছেন। আপনি এ ধারার বিরুদ্ধে রিট করেছিলেন। কী বলবেন এখন?ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : সরকার আসলে বিরোধী মত দমন করতেই এমন আইনে গুরুত্ব দিচ্ছে। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধীদের নাজেহালের চেষ্টা আমরা দেখে আসছি কয়েক বছর ধরেই।

Advertisement

এ জুলুমের অনেকটাই বাইরে ছিলেন সাংবাদিকরা। কিন্তু এক বছর হলো সাংবাদিকরাও আর রক্ষা পাচ্ছেন না। তথ্যপ্রযুক্তির ৫৭ ধারাটি সাংবাদিকদের ওপর খড়্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ সাংবাদিকরাই ইন্টারনেট ব্যবহার করে সংবাদ পরিবেশন করছেন বেশি। বই লিখে কোনো কবি-সাহিত্যিক সমালোচনা করলে মামলায় পড়ছেন না। কিন্তু একই বিষয় ইন্টারনেটে প্রকাশ পেলে মামলা খেতে হচ্ছে।

এখন সবই অনলাইনে। দৈনিকগুলোরও অনলাইন ভার্সন রয়েছে। এ কারণে ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদেরই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়া দরকার ছিল। প্রথম দিন থেকেই এ নিয়ে সাংবাদিকদের মাঠে নামা উচিত ছিল। কিন্তু তারা নামেননি।

২০০৬ সালে আইনটি হলেও ২০০৮ সালের আগে এ ধারায় কোনো মামলা হয়নি। ২০০৮ সালে র‌্যাবের ওয়েবসাইট হ্যাক করায় তিন যুবকের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয় ৫৭ ধারায়। এরপর পার্থ নামের এক যুবক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেয়ায় দ্বিতীয় আলোচিত মামলা হয়।

২০০৪ সালে চারজন ব্লগারকে এ ধারায় আটক করার পর গণহারে মামলা শুরু হয়। আমি ওই চারজনের পক্ষে লড়ছি। ৫৭ ধারা বাকস্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ধারায় প্রায় তিনশ মামলা ট্রায়ালে আছে ঢাকাতে। ট্রাইব্যুনাল তো একটিই।

Advertisement

জাগো নিউজ : এতে ভোগান্তি তো আরও বাড়ছে?ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : অবশ্যই। ধরুন, আসামির বাড়ি দিনাজপুর। মামলা হলো দিনাজপুরে। মামলা লড়তে হচ্ছে ঢাকায় এসে। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে ঢাকায় এসে মামলা পরিচালনা করা কত কঠিন, যিনি আসামি তিনিই বোঝেন।

আবার চাইলেই দিনাজপুরের একজন আইনজীবী ঢাকায় এসে মামলার শুনানিতে অংশ নিতে পারেন না। তারও অনেক মামলা থাকে স্থানীয় আদালতে। আর একজন মক্কেলের জন্য আইনজীবী ঢাকায় আসবেনই বা কেন?

জাগো নিউজ : পরিস্থিতি তো তাহলে বেসামাল?ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : অনেকটা তাই। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কে কার বিরুদ্ধে মামলা করছে, তার কোনো মাপকাঠি মিলছে না। অনলাইনে কোনো কিছু প্রকাশ পেলে এবং এর সঙ্গে দ্বিমত থাকলেই যে কেউ মামলা ঠুঁকে দিতে পারছেন।

জাগো নিউজ : যেসব অপরাধ দমনে আইনটি করা, তা কি সংজ্ঞায়িত?ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : আইনটি তো সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এটি এমন জগাখিচুড়ি পাকিয়ে সামনে আনা হয়েছে, যার কোনোটিই ডিফাইন (অর্থ নির্ধারণ করা) না।

ফৌজদারি অপরাধগুলো হতে হয় খুবই সুনির্দিষ্ট। সময়, স্থান, অপরাধের ধরন নির্দিষ্ট না হলে মামলায় লড়া যায় না। মামলার মেরিট রাখার জন্য অপরাধের নানা বিষয় সুনির্দিষ্ট করতে হয় আইন দ্বারা। সবকিছু অন্ধকারে রেখে তো আপনি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন না।

জাগো নিউজ : কিন্তু স্বাধীনতারও তো মাত্রা থাকা দরকার। বাকস্বাধীনতার নামে অন্যের অধিকার হরণ বা সম্মানহানি করা যায় না। নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন তো থাকেই।ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : অনলাইনে মত প্রকাশে বাড়াবাড়ি হচ্ছে না, তা বলব না। অনেকেই বাড়াবাড়ি করছেন। কিন্তু ৫৭ ধারা দিয়ে আপনি নিয়ন্ত্রণ করবেন, তা পৃথিবীর কোনো আইন সমর্থন করবে না।

সংবিধানে স্বাধীনতার কথা বলা আছে। আবার এ স্বাধীনতার প্রশ্নে নানা শর্তও জুড়ে দেয়া আছে। এগুলো কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানের দুর্বলতা।

অনলাইনে ঘৃণা ছড়িয়ে সে তার অনুসারীদের সংগঠিত করে অন্যের ওপর আক্রমণ করছেন- এমন নজির কিন্তু নেই। ঘৃণিত কোনো বক্তব্যে যদি অপরাধ সংঘটিত না হয়, তাহলে সেই বক্তব্য অপরাধ হতে পারে না।

জাগো নিউজ : এ আইনের মাধ্যমে কোটি টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। এটি তো আরও ভয়ঙ্কর!ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে আরও ভয়ঙ্কর রূপ দেয়া হয়েছে। এক কোটি টাকা কোন বিবেচানয় রাখা হলো, তা বুঝে আসেনি। বড় বড় ফৌজদারি আইনেও দশ হাজার, বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

একজন কৃষক মোবাইল ফোনে প্যারোডি গান শোনার অপরাধে ৫৭ ধারায় মামলায় পড়েছেন। ২০১৪ সালে যশোরে এ ঘটনা ঘটে। ওই কৃষকের ছেলে মোবাইলে গানটি আপলোড করেছিল। কৃষকের অপরাধ তিনি গানটি শুনেছিলেন। মামলায় সাজা হলে ওই কৃষক এক কোটি টাকা পাবেন কোথায়?

মজার কথা হচ্ছে, আইনটি যারা করেছিলেন, তারাই এখন ভুগছেন বেশি। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত এ আইন নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তারা আশায় আছেন, ফের ক্ষমতায় গেলে এ আইনের বলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের লোকজনকে শায়েস্তা করতে পারবেন। প্রতিহিংসার কারণেই এসব আইন হয়ে থাকে।

প্রতিহিংসার এ রাজনীতি পরিত্যাগ না করলে মানুষের স্বাধীনতা কখনই মিলবে না। সাধারণ মানুষ আরও ভোগান্তির শিকার হবেন। শুরু থেকেই আমরা এ আইন বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আইনটি থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। এর বিপক্ষে আন্দোলন জোরদার করা উচিত।

জাগো নিউজ : আইনটির বিরুদ্ধে করা আপনার রিট আবেদনটি কী অবস্থায় আছে?ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : আমিসহ তিনজন ৫৭ ধারা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছিলাম। শুরুতেই দুটি খারিজ হয়ে গেছে। আমারটি রয়ে গেছে।

আমারটির রুল জারি করা হয়েছে। দ্রুত শুনানি হবে বলে আশা করছি।

জাগো নিউজ : আপনার প্রত্যাশা কী?ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : আমার রিট আবেদনটির মেরিট দেখেই আদালত রুল ইস্যু করেছেন। আমি আশাবাদী ৫৭ ধারা বাতিল হবে।

এএসএস/এমএআর/এইচআর/পিআর