পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে দেশের অন্য জেলাগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ আদৌ হবে কি-না এমন প্রশ্ন যখন কারও কারও মুখে তখনই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি এখন প্রায় ১৮ শতাংশ। এরই মধ্যে মূল সেতুর টেস্ট পাইল স্থাপনের কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং নদীর তীর রক্ষার ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে দ্রুতলয়ে। সরকারের ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে এক নম্বরে থাকা এ প্রকল্পটির কাজে যেন কোনো অনিয়ম না হয় সেদিকে নজর রাখছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই যাতে সেতুটি বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকই খেয়াল রাখা হচ্ছে। সে হিসেবে ২০১৯ সাল নয় ২০১৮ সালের মধ্যে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে। শুক্রবার সকালে পদ্মার দুই পাড় মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে পুরোদমে কাজ এগিয়ে চলছে। একদিকে মূল সেতুর টেস্ট পাইল বসানো, অন্যদিকে নদীর ড্রেজিং, পাশাপাশি অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ চলছে। দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা ব্যস্ত কতো দ্রুত কাজ করা যাবে তা নিয়ে। তবে জাজিরা পাড়ের তুলনায় মাওয়া প্রান্তের মূল সেতুর কাজ বেশি দৃশ্যমান। আবার অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ মাওয়া পাড়ের চেয়ে মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় বেশি এগিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। মাওয়া প্রান্তটি পড়েছে মুন্সিগঞ্জ জেলায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সব সময় মনিটরিং করা হচ্ছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য দ্বিতল বিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। এর ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি প্যাকেজে মূল সেতু নির্মাণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, নদী শাসন ও পরামর্শক নিয়োগে এ টাকা ব্যয় হবে। সেতু নির্মাণ কাজে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা রক্ষা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে সরকার।সরেজমিনে পদ্মা সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মার দুই পাড় মাওয়া, জাজিরা ও শিবচরে কর্মযজ্ঞ চলছে। মাওয়ায় বড় বড় ক্রেন দিয়ে টেস্ট পাইল বসানোর কাজ চলছে। মাওয়ায় পদ্মার পাড়ে বড় বড় পাইপসহ বিভিন্ন ভারি যন্ত্রপাতির স্তূপ পড়ে আছে। নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। বড় বড় যন্ত্রে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। নির্মাণ অঙ্গনে (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের থাকার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা ঘর বানানো হচ্ছে। কয়েকশ` শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। কেউ ইট ভাঙছেন। কেউ ভবন বানাচ্ছেন। নিরাপত্তা হেলমেট পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরুর সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব শুরু হয়েছে। পদ্মার দুই পাড়ে নির্মাণাধীন সংযোগ সড়কে দেশীয় ইট, পাথর ও বালুসহ নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। পদ্মার দুই পাড়ে অবস্থিত তিন জেলা মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে উন্নয়নের ধারা শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা আধুনিক শহর গড়ে উঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্থ প্রায় দেড় হাজার পরিবার প্লট পেয়েছেন। গ্রাম এলাকায় অবস্থিত এসব আধুনিক শহরের সুবিধা ভোগ করছেন তারা।সেতু প্রকৌশলীরা জানান, মূল সেতু নির্মাণের জন্য পদ্মা নদীর ভেতরে তিনটি ও তীরে আরো তিনটি মোট ছয়টি টেস্ট পাইল বসানোর কাজ চলছে। ইতোমধ্যে দুটি টেস্ট পাইলের কংক্রিট ঢালাই হয়েছে। এগুলোতে লোড দিয়ে ধারণ ক্ষমতা পরীক্ষার অপেক্ষায় রয়েছে। দুটি টেস্ট পাইলে লোহার তৈরি বৃত্তাকার খাঁচা নামানো হয়েছে। বাকি দুুটিতে কেচিং পাইপ ড্রাইভ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ১০টি পরীক্ষামূলক পাইল বসানোর কথা রয়েছে। এছাড়া ১৪২টি স্থানে মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। ২৪টি স্থানের মাটি পরীক্ষার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নদী ভাঙন রোধে মাওয়া এলাকায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় কাজ চলছে। সেতুর অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী পদ্মা নদীর ভেতরে জেগে ওঠা চর কেটে নাব্যতা বাড়াতে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় তিনটি ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ চলছে। এসব কাজ শেষ হলেই মূল সেতুর পিলার বসানোর কাজ শুরু হবে বলে জানান তারা।স্থানীয়রা জানান, দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশমুখ হিসেবে পরিচিত মাওয়া ঘাট এলাকা এখন পদ্মা সেতুর কারণে এ পথের গুরুত্বটা আরো অনেকটা বেড়ে গেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ পথে ফেরি, লঞ্চ, সি-বোট ও ট্রলার যোগে নদী পার হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে সেতু হওয়ার কারণে খুব শিগগিরই এসব ঝুঁকি এরিয়ে সময় ও খরচ বাঁচিয়ে বাড়িতে যাতায়াত করাটা সহজ হবে এখন।সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত দুই সংযোগ সড়কের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৪০ ভাগ। প্রকেল্পর তিনটি সার্ভিস এরিয়ার দুটি মাওয়া ও শিবচরের কুতুবপুর সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ দুটি সার্ভিস এরিয়াতে কর্মকর্তারা বসবাস শুরু করেছেন। তাদের জন্য সুইমিং পুল, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন সুবিধাদি রয়েছে। জাজিরার নাওডোবা সার্ভিস এরিয়ার কাজ চলছে। প্রকল্পের পুনর্বাসনকাজ চলমান। এর আগে অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হলেও এখন আর কোনো সমস্যা নেই। এমজেড/বিএ/পিআর
Advertisement