নাম তার মমতা। যে বয়সে হাতে থাকার কথা বই-খাতা-কলম, যাওয়ার কথা স্কুলে ঠিক ওই বয়সে সবকিছু ছেড়ে যেতে হয়েছে তাকে স্বামীর ঘরে। আট মাস আগে মমতার বাবা-মা পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। মমতার স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা করার। কিন্তু দারিদ্রতার কারণে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। মমতার বাড়ি রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামে। মমতা মমিনপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। তার বয়স এখন ১৩ বছর।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মততাই নয় ওই গ্রামে গত তিন বছরে ৩৬ জন স্কুল ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। আর এসব বিয়ে বন্ধে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও এনজিও কর্মীরা কোন পদক্ষেপ নেননি। এমনকি তারা ওই বিয়ে সর্ম্পকে কিছুই জানেন না। তাদের অজানা এবং গ্রামের মানুষদের কুসংস্কারের কারণে দিন দিন গ্রামটিতে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত আট মাসে ১১ জন স্কুল ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এখন স্বামীর ঘরে।রংপুর শহর থেকে পশ্চিমে ১৫ কিলোমিটার দূরে ওই গ্রামটি অবস্থিত। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে মৃৎ শিল্প তৈরি নিয়ে ব্যস্ত পাল পরিবারের লোকজন। গ্রামটিতে সহস্রাধিক মানুষ বাস করেন। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কম বয়সে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ দারিদ্রতা, নিরাপত্তার অভাব ও মেয়েরা দরিদ্র বাবা-মার মাথার বোঝা। তারা মনে করছেন, মেয়েদেরকে কম বয়সে পাত্রস্থ করতে পারলে তাদের মাথা থেকে বড় ঝোঝা নেমে যায়। গ্রামের ধরনী কাণ্ড (৬০) জাগো নিউজকে বলেন, বাবু, আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ে কম বয়সে মেয়েকে দিয়ে দিতে পারলে যৌতুকের পরিমাণ কম লাগে, ভালো পাত্র পাওয়া যায়। আর মেয়ে বড় হয়ে গেলে ভালো পাত্র পাওয়া যায় না, গেলেও যৌতুকের পরিমাণ অনেক বেশি দাঁড়ায়। যা দরিদ্র পরিবারের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না।গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০১২ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৩৬ জন স্কুল শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে গত আট মাসেই বিয়ে হয়েছে ১১ জন মেয়ে শিশুর। এছাড়া একজনের বিয়ে ঠিক হয়ে রয়েছে। সম্প্রতি বিয়ে হওয়া ১১ জন স্কুল ছাত্রীরা হলো, হিলালু পালের মেয়ে চন্দনা (১৫), ছত্রাপালের মেয়ে ভুমিকা (১২), যমুনাপালের মেয়ে ফুলেশ্বরী (১৩), বিমল পালের মেয়ে সাগরিকা (১২), দিনেশ পালের মেয়ে আদরি (১৪), বিকুল পালের মেয়ে বিউটি (১২), হবিরের মেয়ে বৃষ্টি (১২), শুদাসুন পালের মেয়ে শিল্পী (১৩), আশেম পালের মেয়ে লালিতা (১৪), অমুল্য মহন্তের মেয়ে মমতা (১৩), নরেয়ান পালের মেয়ে কাজলী (১৩)। জানা গেছে, এসব বিয়ের নিবন্ধনও করা হয়নি। ঠাকুর দিয়ে মন্ত্র পড়িয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এরা সবাই সদর উপজেলার মমিনপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রী। সম্প্রতি ওই গ্রামের জগদিশের মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী শিউলির বিয়ে ঠিক করা হয়েছে এক যুবকের সঙ্গে। প্রশাসন কোন পদক্ষেপ না নিলে আগামী সপ্তাহে তার বিয়ে হয়ে যাবে বলে গ্রামবাসী জানিয়েছেন। কথা হয় মমতার সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শিখে শিক্ষকতা করার। কিন্তু আমার গরীব বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে স্বামীর ঘরে যাই। তার মা মালতি পাল (৪৫) জাগো নিউজকে বলেন, হামরা (আমরা) গরীব মানুষ। গরীবের নেকাপড়া করি কী হইবে। উয়ার (ওর) বাপ কাজকাম করব্যার (করতে) পারে না। মোর দুই বেটি (মেয়ে)। বড় বেটির নয় বছর আগোত সিক্সে থাকা অবস্থায় বিয়াও দিছু। সে এখন দুই ছইলের (সন্তান) মাও, সুখোত (সুখে) আছে। মুই ফুলের টপ বানাও। বেচি (বিক্রি) যা লাভ হয়, তা দিয়া ঠিকমতন সংসার চলে না। আর বেটিক পড়াইম কেমনে করি? উয়ার বর মিলি যাওয়ায় বিয়াও দিয়া ঝামলা মুক্ত হছু (হয়েছি)।ওই গ্রামের চন্দনার বাবা হিয়ালু মারা যান ১৪ বছর আগে। তখন চন্দনার বয়স ছিল এক বছর। মা আন্তিবালা মৃৎ শিল্প তৈরির কাজ করেন। বিক্রি করে যা লাভ হয় তা দিয়ে সংসার ও চন্দনার লেখাপড়া চালিয়ে আসছিলেন। আট মাস আগে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন মা আন্তিবালা । মেয়ে চন্দনার বিয়ে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে আন্তিবালা বলেন, মুই বাড়িত সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকো। বেটি মোর স্কুলোত যায়। উয়াক (তাকে) স্কুলোত যাইতে-আসতে পাহাড়া দিবি কাই (কে)? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেটিক নেকাপড়া করে কি হইবে। যত বয়স বাড়বে, ততই ডিমান (যৌতুক) বেশি নাগবে। মুই গরীব মানুষ, বেটি মাথার উপর বুঝা হয়া দাঁড়ে ছিল। গ্রামে ফুলের টপ তৈরি করছেন দুলালী পাল (১৯) নামে এক গৃহবধূ। কথা হয় তার সঙ্গে। দুলালী জানায়, তার সাত বছর বয়সের ও এক বছর বয়সের দুই ছেলে রয়েছে। তার বাবার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাওচণ্ডী পাড়া গ্রামে। চার ভাই, চার বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। ১০ বছর আগে তিনি চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তার বাবা অনন্ত মারা যান। তখন ভাইয়েরা তাকে পালপাড়া গ্রামে রতন পালের (২২) সঙ্গে বিয়ে দেন। শিক্ষার্থীদের বিয়ে সর্ম্পকে মমিনপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিল্বরঞ্জন রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি সম্প্রতি স্কুলে যোগদান করেছি। ছাত্রীদের বিয়ে সংবাদ কেউ আমাকে জানাননি। ওই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আজমল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ওই শিক্ষার্থীরা আমাদের স্কুলের ছাত্রী ছিল। তাদের বিয়ের সংবাদ কেউ আমাদের দেননি।মমিনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জমির উদ্দিন প্রামানিক বলেন, ওই গ্রামে মেয়েদের বিয়ের সংবাদ আমার জানা নেই। আমি কয়েকদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে রয়েছি। খোঁজ নিয়ে দেখবো। বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে হলে তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। তারা কম বয়সে গর্ভধারণ করলে গর্ভ সংশ্লিট জটিলতা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়। বয়স ও ওজন দুটোই কম থাকার ফলে কিশোরী মা ও শিশু দু`জনই অপুষ্টিতে ভোগে। এছাড়া পরিপক্ক হওয়ার আগে অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় স্বামীর সঙ্গে শারিরীক সম্পর্কের ফলে জরায়ু মুখে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। রংপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রিয়সিন্ধু তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, আমি বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য তৎপর রয়েছি। সম্প্রতি চন্দনপাঠ ইউনিয়নসহ কয়েকটি ইউনিয়নে স্কুলছাত্রীর বিয়ের সংবাদ পেয়ে তা বন্ধ করেছি। কিন্তু ওই গ্রামে এতো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তা কেউ আমাকে জানাননি। তিনি আরো বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে ভুমিকা রাখতে পারেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা রহস্যজনক কারণে সেই ভূমিকা পালন করেন না। তিনি বিভিন্ন এনজিও কর্মীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এনজিও কর্মীরা ঠিকমতো মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন না। তারা শুধু দুই-একটি পত্রিকায় তাদের পক্ষে সংবাদ আনাতে পারলে বেঁচে যান। অচিরেই ইউপি চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে ওই গ্রামে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মতবিনিময় সভা করা হবে বলে ইউএনও বলেন। এমজেড/এমএস
Advertisement