জাতীয়

রামপাল নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বাহাস

রামপালে বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণে আপত্তি ‘তুলে নেয়ার’ বিষয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তের পক্ষে ও বিপক্ষে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আন্দোলনকারী নেতাদের বাহাস চলছে।

Advertisement

বিষয়টি নিয়ে নেতারা যে যার অবস্থান ঠিক রেখে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ও নিজের যুক্তি তুলে ধরছেন।

আপত্তি তুলে নেয়ার খবরে সরকারি দলের নেতারা খুশি। তবে যারা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজপথে আন্দোলন- সংগ্রাম করছিলেন তারাও নিজেদের অবস্থানে অনঢ়।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মুখপাত্র এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আন্দোলনকারী ও বিরোধীতাকারীদের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসেন। যারা এই প্রকল্পের বিরোধীতা করছেন, তাদের অনেকের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক নয়, ষড়যন্ত্রমূলক। অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। কিন্তু যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ও ষড়যন্ত্রমূলক।’

Advertisement

পোল্যান্ডে চলমান ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশনে রামপাল নিয়ে ইউনেস্কোর আপত্তি তুলে নেওয়া হয়েছে বলে গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে থাকা প্রাকৃতিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করার পদক্ষেপ থেকেও ইউনেস্কো সরে এসেছে বলে মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, রামপাল নিয়ে উদ্বেগ নিরসনে সরকার যে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে তা পরীক্ষা -নিরিক্ষার পর ইউনেস্কো আপত্তি প্রত্যাহার করে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনুমোদন দিয়েছে।

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ম হচ্ছে কোনো বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না। সুন্দরবনের যে অংশটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সেটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে, আর সুন্দরবনের প্রান্তসীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে।’

Advertisement

এদিকে, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে তার যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে এই প্রকল্প থেকে প্রতি বছর ২২৩ কেজি পারদ নির্গত হবে। এ পারদ পাশের সংবেদনশীল ভূমিতে অবক্ষেপ ও সঞ্চিত হবে। ফলে সুন্দরবন এলাকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকাংশই প্রতিবন্ধী হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক চার্লস টি ড্রিসকল এ গবেষণা করে এ ধরনের তথ্য পেয়েছেন বলে তিনি জানান।

তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইউনেস্কো রামপাল প্রকল্প সম্পর্কে তাদের বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক অনুসন্ধান এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল কীভাবে এই প্রকল্প সুন্দরবন বিনাশ করবে। যদি ইউনেস্কো এ অবস্থান থেকে সরে আসে তার অর্থ হবে, ইউনেস্কো কোনো না কোনো প্রভাবে তার নিজেরই বৈজ্ঞানিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে গোষ্ঠীস্বার্থের লবিংয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এটি বাংলাদেশ ও বিশ্বের একটি বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে ইউনেস্কোর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাই নির্দেশ করে। সুন্দরবনের যেকোনো ক্ষতির দায়দায়িত্ব তাই ইউনেস্কোকেও বহন করতে হবে।’

তারা বলেন, ‘সুন্দরবন বিনাশ হলে এদেশ ও এদেশের মানুষেরই সর্বনাশ। ইউনেস্কোর কর্মকর্তারা সন্দেহজনক কারণে যুক্তিযুক্ত আপত্তি প্রত্যাহার করলেও তাই বাংলাদেশের মানুষ আপত্তি প্রত্যাহার করতে পারে না।’

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এরপরও ইউনেস্কো যদি তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে ইউনেস্কোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে।’

অপরদিকে, রামপাল নিয়ে সরকারি দাবি প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘রামপাল নিয়ে যে যাই বলুক, বিএনপি এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে। কোন সংগঠন কী বলছে, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। রামপাল পুরোপুরি একটি রাষ্ট্রবিরোধী প্রকল্প।’

রিজভী বলেন, ‘এই প্রকল্প শেখ হাসিনাকে দিয়ে ভারত তৈরি করছে। অথচ ভারত নিজেদের দেশে এ ধরনের প্রকল্প নির্মাণ করতে দেয় না। পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবন ধ্বংস করতেই ভারত এই প্রকল্প তৈরি করাচ্ছে।’

সরকারি প্রেসনোট প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, ‘আমাদের দেশের যারা পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী তারা কি জ্ঞানী নয়? তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি? তাদের গবেষণার কি কোনো ভিত্তি নেই? বিদেশি সংস্থা কী বলছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’ একই বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে শর্তগুলো মানা হবে বলে তাদের আশ্বস্ত করেছি। বাংলাদেশ তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে পরিবেশ সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে সুন্দরবনে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না।’

ইউনেস্কো যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছে তার প্রতিটি উত্তর যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ তুলে ধরেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ইউনেস্কোর সম্মতি প্রমাণ করে শেখ হাসিনার সরকারের সব সিদ্ধান্তই সঠিক। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিভিন্ন জায়গায় লবিং করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।’

এফএইচএস/এসআর/এমএস