যে পেশার মানুষেরা যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাত-দিন সেবা দিয়ে যান, তারা এয়ার হোস্টেস বা কেবিন ক্রু। অনেক চড়াই-উৎরাই পার করেই এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং ও সম্ভাবনাময় পেশায় ক্যারিয়ার হিসেবেই একজন কেবিন ক্রু পা বাড়ায় বিদেশের মাটিতে।
Advertisement
তিনিও ভালো ছাত্রী হিসেবেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে পেয়েছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কেবিন ক্রুর চাকরি। তার অনর্গল ইংরেজি বলার ধরন ও ইতিবাচক আচরণে বিমানের যাত্রীরা হতেন মুগ্ধ। অনেকেই তার আতিথেয়তায় ছিলেন পঞ্চমুখ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, নিজ যোগ্যতায় যে নারী ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, সেই যাত্রীসেবাদানকারী চটপটে এয়ার হোস্টেস এখন ভিক্ষা করেন।
কর্মজীবনে একসঙ্গে পাঁচতারকা হোটেলে অবস্থান করা সহকর্মীরা কেউ এখন আর তার খবরও নেন না। কেবিন ক্রুদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশে গঠিত অ্যাসোসিয়েশন পর্যন্ত তার পাশে দাঁড়াচ্ছে না। সাধারণ সদস্য তো নয়ই বরং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও খবর রাখেন না এই হতভাগিনীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলোচিত ওই কেবিন ক্রুর নাম শামীমা নার্গিস। পি নম্বর-৩৪০১৯। বাবার নাম এম এ রকিব। বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর থানাধীন গাজিপুরা গ্রামে। বিমানের নথিপত্রে বর্তমান ঠিকানা এন্ট্রি করা আছে ২-বি/২, বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি, আইজি গেট, ফরিদাবাদ, ঢাকা।
Advertisement
১৯৮১ সালে নার্গিস ঢাকার বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ইডেন কলেজ থেকে ১৯৮৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৮৫ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি বিমানে ফ্লাইট স্টুয়ার্টেড হিসেবে যোগ দেন। প্রায় ১৮ বছর চাকরির পর বিমানের তৎকালীন বিতর্কিত এমডি হিসেবে পরিচিত ড. মোমেনের (ভি আরএস মোমেন হিসেবে পরিচিত) আমলে নার্গিসকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। নার্গিস বর্তমানে তিনি নানান অসুস্থতায় ভুগছেন।
মোমেনের বিদায়ের পর অনেকে আদালতে রিট আবেদনের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পেলেও নার্গিস রাগে-ক্ষোভে সে চেষ্টা করেননি। বিয়ে করেন ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল। ঘরে সন্তান না আসায় বিয়ের আট বছরের মাথায় স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর ক্যারিয়ার গড়ার বদলে তার জীবনে একের পর এক বিপর্যয় নামতে শুরু করে।
নিজের জীবনের এসব কথা নিজেই জানান প্রতিবেদককে। সম্প্রতি খিলক্ষেত থানাধীন বরুয়া গ্রামের এক টং দোকানে সাদাসিধে পোশাকে বসে এক ব্যক্তির কাছে এক টুকরা রুটি খুঁজে খাচ্ছিলেন। বললেন, কপাল দোষে ভিক্ষা করছি। আমার সাথের সবাই ভালো থাকলেও কেউ আমার খবর নেয় না। সব আপনজন এখন পর হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমান ফ্লাইং সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব কেবিন ক্রুর সভাপতি আকতারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, নার্গিসের দুর্বিষহ জীবনের কথা আমরা শুনেছি। শুনে আমাদের খারাপও লাগছে। তিনি আমাদেরই একজন প্রিয় সহকর্মী ছিলেন। আমরা তার সন্ধান পেলে অবশ্যই পাশে দাঁড়াব। চিকিৎসার ব্যবস্থা করব এবং প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা কিংবা চাকরির ব্যবস্থা করব।
Advertisement
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিমের (ভিআরএস) আওতায় বাধ্যতামুলক বিদায় দেয়া হয় নার্গিসসহ বিমানের ১৮৭৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। সে সময় মোট জনবল ছিল ৪৭০৬ জন। বিদায়ীদের ৩০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয় তখন। এরপর বিষয়টি মামলায় গড়ালে তাতেও খরচ হয় ও পরবর্তীকালে ভিআরএসপ্রাপ্ত লোকদের নিয়োগ দিতে হয় এবং এখনও ওই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
পাশাপাশি ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে তখন থেকেই অতিরিক্ত লোক দিয়ে বিমানকে চালিয়ে নিতে হয়। বর্তমানে সংস্থাটির জনবল পাঁচ হাজারের বেশি। ভিআরএস-এর আগে বিমানে মোট বেতন লাগত ১৩ কোটি টাকা। মোটা অংকের লোনের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ১৮৭৭ জনকে বিদায় দিয়ে অবশিষ্ট ২৭৯২ জনকে বেতন দেয়া হত ২১ কোটি টাকার ওপরে। বর্তমানে সংস্থাটির পাঁচ হাজার জনবল পেছনে বেতন বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ।
আরএম/বিএ