জাগো জবস

পুরস্কার জেতার অনুভূতি অসাধারণ : নাদিম মজিদ

নাদিম মজিদ একাধারে ছাত্র, লেখক, মেন্টর এবং অ্যাপ নির্মাতা। তিনি পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে। তার নেতৃত্বাধীন অ্যাপ ‘ব্রেইন ইক্যুয়েশন’ এবছর ‘ন্যাশনাল মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছে। এছাড়া তিনি অনলাইন শিক্ষামাধ্যম ‘কোর্সেরা’র মেন্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি ৫ বছর যাবৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ফিচার লিখছেন।

Advertisement

সম্প্রতি নাদিম মজিদের সঙ্গে তার কর্মকাণ্ড এবং পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।

জাগো নিউজ : অ্যাপ তৈরির পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই-নাদিম মজিদ : ছেলেবেলা থেকে পত্রিকার শব্দজট মেলাতে পছন্দ করতাম। ২০১৩ সালে দু’টি জাতীয় দৈনিকে পাজেল লেখা শুরু করি। ২০১৪ সালের শুরুতে একটি দৈনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তাদের ম্যাগাজিনে নতুন পাজেল দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আমি ম্যাগাজিনটির সম্পাদককে গণিতের সমীকরণভিত্তিক পাজেলের আইডিয়া দেই। এটি অফিসের পছন্দ হয়। সে পাজেলটি সমীকরণজট নামে ছাপা হয়। পাজেলটির আইডিয়া ইউনিক কি না অনলাইনেও যাচাই করে দেখি। ইউনিক আইডিয়া। তখন মাথায় আসল, আমাকে এমন কোনো কাজ করতে হবে যেন পৃথিবীতে এ গেমের জনক হিসেবে আমার নাম উচ্চারিত হয়। উৎপত্তিস্থল হিসেবে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসে।

পাজেল নিয়ে কাজের আগ্রহ থেকে ২০১৪ সাল থেকে আমি একটি ওয়েবসাইট পরিচালনা করছি। কিন্তু হাতের কাছে দক্ষ প্রোগ্রামার না থাকায় পাজেল তৈরি করে ওয়েবসাইটে দেওয়া, সেখানে ভিজিটর খেলবে- তা সম্ভব হয়নি। ২০১৬ সালে এক ছোটভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। সে মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে। তাকে অ্যাপের গেমগুলো কেমন হবে, লেভেলগুলো কেমন হবে- তা জানাই। সে এ ধরনের অ্যাপ করার জন্য কোডিং করে দেওয়া সম্ভব বলে জানান। চলতি বছর মার্চ মাসে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য অ্যাপ তৈরির কাজ শেষ হয়। অ্যাপে পাঁচটি ডিফিকাল্টি লেভেলে ১৬৮টি গেম রয়েছে। গেমগুলোতে ভুল-ত্রুটি শনাক্ত করে দেয় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী। অ্যাপের নাম প্রথমে রাখতে চেয়েছিলাম ম্যাথমেটিকেল ইক্যুয়েশন। কিন্তু এ নামে প্লে স্টোরে অ্যাপ থাকায় ‘ব্রেইন ইক্যুয়েশন’ নামটি চূড়ান্ত হয়।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনার নেতৃত্বে তৈরি অ্যাপস ‘ব্রেইন ইক্যুয়েশন’ সম্পর্কে বলুন-নাদিম মজিদ : সরল অঙ্কের মৌলিক নিয়মকে ভিত্তি করে পাজেল আকারে তৈরি অ্যাপ ‘ব্রেইন ইক্যুয়েশন’। সরল অঙ্কে যেমন যোগ, বিয়োগ, গুণ এবং ভাগের কাজ থাকে। প্রায় সব শিক্ষার্থী এ ধরনের কাজ একসঙ্গে আসলে বিব্রত হয়। ভুল করে। কারণ অনুশীলন না করার কারণে তারা কিসের কাজ আগে করতে হবে বুঝতে পারে না। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের সমস্যা সমাধান করার জন্য আমরা তৈরি করেছি ‘ব্রেইন ইক্যুয়েশন’ অ্যাপটি। বর্তমানে ইংরেজি ভাষার অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ভবিষ্যতে আইফোনের জন্যও তৈরি করবো।

জাগো নিউজ : আপনাদের অ্যাপটি ‘ন্যাশনাল মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে- এব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী? নাদিম মজিদ : অ্যাপ তৈরি করার সময় ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জিততে হবে; তা মাথায় ছিল না। আমরা চেষ্টা করেছি ইউনিক আইডিয়ার অ্যাপটি যেন গুণগতমান ঠিক রেখে তৈরি হয়। ভাগ্য ব্রেইন ইক্যুয়েশনের সহায়ক ছিল। এটি ছিল বাংলাদেশে আয়োজিত দ্বিতীয় মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতা। আমরা গত ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রেইন ইক্যুয়েশন অ্যাপের উদ্বোধন করি। অথচ জাতীয় মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষদিন ছিল ৩১ মার্চ। অ্যাপটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার আগের দিন ১৩ এপ্রিল পত্রিকায় দেখি, ন্যাশনাল মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতার মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়সীমা ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাই দেরি না করে গুগল প্লে স্টোরে পরীক্ষামূলকভাবে রাখা অ্যাপটি দিয়ে আবেদন করি।

২৪ এপ্রিল ই-মেইল করে জানানো হয়, আমাদের অ্যাপটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে। ২৬ এপ্রিল বাছাইকৃত অ্যাপগুলোর প্রেজেন্টেশন। আমাদের অ্যাপটি ছিল লার্নিং অ্যান্ড এডুকেশন ক্যাটাগরিতে। মোট আটটি ক্যাটাগরির প্রেজেন্টেশন ছিল। প্রেজেন্টেশন দিতে গিয়ে দেখি, সবচেয়ে বেশি অ্যাপ শর্টলিস্টে এসেছে আমাদের ক্যাটাগরিতে। অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ৪-৫টি করে অ্যাপ শর্টলিস্টে থাকলেও আমাদের ক্যাটাগরিতে শর্টলিস্টে আছে ষোলটি।

বেশি অ্যাপ শর্টলিস্টে থাকায় পুরস্কার জেতা নিয়ে দোদুল্যমান ছিলাম। ব্রেইন ইক্যুয়েশন আমাদের প্রথম অ্যাপ। আমরা গুণগতমানসম্পন্ন এবং ভিন্ন ধারণাকে কেন্দ্র করে অ্যাপ বানিয়েছি। কিন্তু কোনো অ্যাপ প্রতিযোগিতায় সরাসরি অংশ নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। আত্মবিশ্বাসের জায়গায় ছিল শুধু আমাদের আইডিয়া ইউনিক, আমাদের অ্যাপ মানের ক্ষেত্রে আপোসহীন।

Advertisement

গত ৪ মে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ব্রেইন ইক্যুয়েশনকে ন্যাশনাল মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এ পুরস্কার জেতার অনুভূতি অসাধারণ। শখের বশে তৈরি করা অ্যাপটি পুরস্কার পাওয়ায় আমরা নতুন নতুন কাজ করার আগ্রহ পাচ্ছি। দেশ-বিদেশের মানুষের কাজে লাগে এমন অ্যাপ তৈরি করার সাহস করতে পারছি।

জাগো নিউজ : অনলাইন শিক্ষামাধ্যম ‘কোর্সেরা’ বাংলাদেশের তরুণদের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে?নাদিম মজিদ : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা আলোকমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে পড়াশোনা করে আলোকিত হওয়া যায়। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাওয়ার জন্য আবার পড়াশোনা করতে হয়। অনেকে অভিজ্ঞতা না থাকায় চাকরি করতে পারেন না। কোর্সেরার শিক্ষা এখানে ব্যতিক্রম। সময়োপযোগী প্রায় ২ হাজার বিষয়ে পাঠদান করানো হয় অনলাইন শিক্ষামাধ্যম কোর্সেরায়। এখানকার বিষয় এবং শিক্ষকেরা বিশ্বমানের। এখানকার পড়াশোনার টুলসগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। আমি কোর্সেরা থেকে ১৪ বিষয়ে সফলভাবে কোর্স সম্পন্ন করেছি। দু’টি কোর্সের মেন্টর। পারসোনাল ব্র্যান্ডিং, সোশাল মিডিয়া, ই-পোর্টফোলিও, গেম ডেভেলপমেন্ট, আইডিয়া টু প্রোডাক্ট বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স করেছি।

এখানকার বিষয়গুলো সাজানো হয় সম্পূর্ণ রূপে। পাইথন নিয়ে একটি বিষয় রয়েছে। এ বিষয়টি সঠিকভাবে রপ্ত করার জন্য পাঁচটি কোর্স করতে হয়। প্রতিটি কোর্স থাকে ৪-৫ সপ্তাহের। অনলাইনে পড়াশোনা করতে হয়। অনলাইনে অনুশীলন করতে হয়। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হয়। কুইজ পরীক্ষা দিয়ে ৮০% নম্বর পেয়ে পাস করতে হয়। একটি কোর্সের একটি পরীক্ষায়ও যদি সে পাস না করে তাহলে সে কোর্স সমাপনী সনদ পাবে না। কারো যদি আগ্রহ থাকে, সে অনলাইনে কোর্স করতে পারে। অনলাইনে কোর্স করতে বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। কোর্স ফি সাধারণত ৪৯ ডলার থেকে ৭৯ ডলার হয়ে থাকে। তবে যাদের সামর্থ নেই, তারা আবেদন করে কোর্স ফি মওকুফ করে নিতে পারে।

কোর্সেরা ছাড়াও ইডিএক্স, ইউডেমিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যে কেউ পড়াশোনা করতে পারে।

জাগো নিউজ : ব্রেইন ইক্যুয়েশন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি সম্পর্কে জানতে চাই?নাদিম মজিদ : ব্রেইন ইক্যুয়েশনের মাধ্যমে সারাবিশ্বে আমরা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। ক্রসওয়ার্ডের উৎপত্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র পরিচিত, সুডোকুর কারণে জাপান পরিচিত। ব্রেইন ইক্যুয়েশনের কারণে বাংলাদেশও সমান খ্যাতি পাবে বলে বিশ্বাস করি।

জাগো নিউজ : অ্যাপ এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? নাদিম মজিদ : ব্রেইন ইক্যুয়েশন আমাদের প্রথম অ্যাপ। এ ধরনের শিক্ষামূলক নতুন আরো দশটি অ্যাপ তৈরি করার আইডিয়া আমাদের রয়েছে। শিক্ষা ক্যাটাগরির বাইরে মানুষের কাজে লাগে এমন সুন্দর সুন্দর, গুণগত মানসম্পন্ন আরো নতুন নতুন অ্যাপ তৈরি করতে চাই। পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই। দৈনিক পত্রিকায় বিষয়ভিত্তিক লেখালেখি অব্যাহত রাখতে চাই। বইমেলা উপলক্ষে নতুন বইও উপহার দিতে চাই।

জাগো নিউজ : তরুণদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন-নাদিম মজিদ : পৃথিবীতে এখন প্রযুক্তি খুব দ্রুত এগোচ্ছে। ক্রম অগ্রসরমান প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারতে হবে। তাই নিজের পড়াশোনা, বিনোদনের পাশাপাশি প্রযুক্তিকে আয়ত্ত্বে নিয়ে আসার পেছনেও সময় দিতে হবে।

তরুণদের অনেকে ফেসবুকে প্রচুর সময় ব্যয় করে। তারা কি একবার ভেবে দেখতে পারে, ফেসবুকের বার্ষিক আয় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের কাছাকাছি। হোয়াটসঅ্যাপের মত একটি অ্যাপের আয় বাংলাদেশের গার্মেন্টসের মোট আয়ের সমান। অথচ হোয়াটসঅ্যাপে চাকরি করে মাত্র ১০০ জন কর্মচারী। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে কব্জা করার জন্য প্রযুক্তি এবং প্রোগ্রামিং অনিবার্য হয়ে পড়েছে। অনলাইন কোর্স, ইউটিউব থেকেও তরুণরা চাইলে এসব বিষয়ে কম সময়ে গুণগত পড়াশোনা করতে পারে। শিখতে পারে।

জাগো নিউজ : মূলবান সময় দেওয়ার আপনাকে ধন্যবাদ এবং পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।নাদিম মজিদ : জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ। সবার জন্য শুভকামনা।

এসইউ/এমএস