মতামত

হলি আর্টিজান : আমাদের মৃত্যুর এক বছর

হলি আর্টিজানে রক্তের হোলি খেলার এক বছর পুরো হয়ে গেল গত ১ জুলাই। আজও পর্যন্ত মামলার তদন্ত শেষ হলো না। হলি আর্টিজান নামটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে রক্তাক্ত মৃতদেহের ছবি। যেখানে ইউরোপীয়, বাঙালি, জাপানি সকলেই লাল রঙের রক্তের মধ্যে নিথর। তাদের হত্যা করা হয়েছে জবাই করে। তাদের সামনে ছিল খাবারের পাত্র। তারা ছিল জীবনের আনন্দে ভরপুর। তাদের মধ্যে ছিল অন্তঃসত্ত্বা নারী। ছিল স্নেহময় পিতা। ছিল আদরের পুত্রকন্যা। কাউকে রেহাই দেওয়া হয়নি। কারও প্রতি দেখানো হয়নি এতটুকু করুণা।

Advertisement

কি দোষ ছিল এই মানুষদের? অনেকে ছিলেন বাংলাদেশে অতিথি। আবার অনেকে ছিলেন এদেশেরই নাগরিক। সহজ সরল হাসিখুশি মানুষ। যারা কিছুক্ষণ আগেও বুঝতে পারেননি নির্মম মৃত্যু তাদের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কারা হত্যা করেছে তাদের? কারা প্রদর্শন করেছে এই পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা? না, তারা হিটলারের নাজি বাহিনীর সদস্য নয়, তারা মিলিশিয়া নয়। ঘটনাটি কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বা কোন বন্দীশিবিরেও ঘটেনি। ঘটনা ঘটেছে শান্তিপূর্ণ একটি দেশের কূটনৈতিক এলাকায়।

হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে কিছু তরুণ ছেলে। তাদের মন ও চেতনাকে এতটাই বিকৃত করে তোলা হয়েছে, তাদের এত ভয়ংকর কিলিং মেশিনে পরিণত করা হয়েছে যে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ও অচেনা মানুষদের বিনা কারণে হত্যা করতেও তাদের হাত এতটুকু কাঁপেনি। হলি আর্টিজানের ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কি ভয়াবহ বিপদের মধ্যে আমরা আছি। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটালো তারাও কিন্তু আমাদেরই দেশের সন্তান। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। তারাও বাঁচতে পারেনি। তাদের মৃতদেহও পড়ে ছিল ওই হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টটির বাগানে, খোলা আকাশের নিচে। হত্যাকারী এবং তাদের শিকার কারও কি ওভাবে মরার কথা ছিল? তবু কেন ওই পরিণতি?

জঙ্গিবাদ কেবলমাত্র বাংলাদেশের সমস্যা নয়। এটা আজ সারা বিশ্বেরই সমস্যা। আজ হামলা হচ্ছে প্যারিসে, লন্ডনে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর দেশে আইন শৃংখলা বাহিনীর টনক নড়ে। জঙ্গি বিরোধী বিভিন্ন অভিযানে ৭০ জন জঙ্গি নিহত হয়। এক বছরে বড় ২০টি জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস হয়। সেখানেও অনেক তরুণ ও শিশু নিহত হয়। আরও দেখা যায় জঙ্গিরা সপরিবারে বিপথু হচ্ছে। নারীদেরও টেনে আনছে এ পথে। জঙ্গিবাদ দমনের পাশাপাশি দরকার জঙ্গিপথে যেন আমাদের দেশের মানুষ পা না বাড়ায় সেটি নিশ্চিত করা। জঙ্গি হওয়া রোধ করতে হবে। সেজন্য দরকার উপযুক্ত শিক্ষা।

Advertisement

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে আজ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মন্ধতার বিষবৃক্ষ ডালপালা মেলছে। ধর্মপরায়ণ এদেশের মানুষ বরাবরই ছিল। কিন্তু সে ধর্ম ছিল উদারনৈতিক। এদেশে সুফি-দরবেশ-বাউল-বৈষ্ণব-ভিক্ষুরা মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছেন। অথচ এখন ধর্মের নামে মানুষকে ঘৃণা ও হত্যার পাঠ দেওয়া হচ্ছে। মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠছে ভ্রান্ত শিক্ষার ফলে। আজ ঘরে ঘরে এমন মগজ ধোলাইয়ের ফাঁদ পাতা হচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলিত যে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই দেশে আজ সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর বিভাজন হচ্ছে। যে দেশের মনীষীরা বলেছেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তারচেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি, বলেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, সেদেশে আজ মন্দিরের পুরোহিত, মঠের সেবক, গির্জার ধর্মগুরুকে হত্যা করা হচ্ছে। চোখের উপরে দেশটা এমন হয়ে গেল কীভাবে?এমন হয়ে গেল আমাদেরই ভুলে, আমাদেরই অদূরদর্শিতায় আর আমাদেরই পাপে। অন্য ধর্ম বা মতাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণা তৈরিতে পরিবার ও সমাজের ভূমিকাও কম নয়। স্বাধীনতার পর যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল তা পঁচাত্তরের পর থেমে যায়। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকরা দেশকে ধর্মান্ধতার পথে নিয়ে যায় নিজেদের গদি পাকা করার স্বার্থে। আমাদের ভুল হলো নব্বইয়ের পরও আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু না করে, তাকে বেগবান না করে নিজেরা প্রচার, স্বার্থ আর ক্ষমতার মোহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়েছি। গান্ধারীর মতোই আমাদের চোখ আমরা নিজেরাই বেঁধে রেখেছি। কিন্তু চোখ বন্ধ করে থাকলে তো প্রলয় বন্ধ হয় না।

মহাভারতে দুর্যোধন ও দুঃশাসনের মা গান্ধারী এবং বাবা ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন ভালো মানুষ। তাদের সন্তানরা বিপথে গিয়েছিল শকুনির পরামর্শে। তারা নিহত হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে। শকুনি যখন ধীরে ধীরে তাদের মাথায় কুচিন্তার বীজ বপন করছিল তখন বাবা-মা তা প্রতিরোধ করেননি। আমাদের সন্তানদের মাথায় যখন শকুনিরা হত্যার বীজ বপন করছে, তাদের জঙ্গিবাদে দীক্ষা দিচ্ছে, তাদের মগজ ধোলাই করছে তখন অন্য কোন কাজে আমরা ব্যস্ত রয়েছি? ধর্ম, সংস্কৃতি, সুনীতি কোনটিরই স্বাভাবিক সুশিক্ষা আমরা সন্তানদের দিতে পারিনি। অবধারিতভাবে আমাদের সন্তানরা বিপথগামী হয়েছে, জাতির পতাকা খামচে ধরা পুরনো শকুনদের খপ্পরে গিয়ে পড়েছে আর তাদের মগজধোলাই হয়ে তারা জঙ্গিতে পরিণত হয়েছে।

যে তরুণরা আজ দেশ গঠন করবে, সৃষ্টির স্বপ্নে ব্রতী হবে তারা পরিণত হচ্ছে হত্যাকারী দানবে। এই তরুণরা তো একদিনে এক লহমায় দানবে পরিণত হয়নি। এরা যখন বিপথে যাচ্ছে, যখন সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের পাঠ নিচ্ছে তখন তাদের বাবা-মায়েরা কি চোখ বন্ধ করে ছিল? কেন তারা দেখেনি সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কার অশুভ প্রভাবে পড়েছে? কেন সুস্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করেনি তাদের? তারা হাজার হাজার টাকা খরচ করে নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলেকে পাঠিয়ে ভেবেছে সব কর্তব্য পালন করা গেল। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই বা কেমন? কোচিং, প্রশ্ন ফাঁস আর অবৈধ রোজগারের ধান্ধায় মত্ত থেকে তারা দেখেনি তাদের ছাত্ররা মানুষ হচ্ছে না হত্যার যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। আর যে অভিভাবক ও শিক্ষকরা নিজেরাই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী এবং জঙ্গিবাদের আদর্শে দীক্ষিত তাদের সন্তানরা তো কুপথে যাবেই।

জঙ্গিবাদের ভাইরাস থেকে শুধু বাংলাদেশকে নয়, বাঁচাতে হবে বিশ্বকে। বাঁচাতে হবে আমাদের তরুণ সমাজকে। এজন্য বিশ্বব্যাপী অসাম্প্রদায়িক মানবতার আদর্শ প্রচার করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সুস্থ চিন্তাধারা, মানবতাবাদী দর্শন বিশ্বকে বাঁচাতে পারে জঙ্গিবাদ থেকে।

Advertisement

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম