দেশজুড়ে

ঈদের ছুটিতে তলিয়ে গেল তিন শতাধিক স্কুল

পাহাড়ি ঢলে নদী ও হাওরের পানি বেড়ে গিয়ে সিলেটের ৯ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ওই নয় উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ। বন্ধ হয়ে গেছে তিন শতাধিক স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম।

Advertisement

বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মানুষজন। এছাড়া সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় তিন শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বন্যাদুর্গত লোকজন জানিয়েছেন, জেলায় আড়াই শতাধিক প্রাথমিক ও অর্ধশত উচ্চবিদ্যালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ঈদের ছুটির পর শনিবার থেকে বিদ্যালয় চালু হওয়ার কথা থাকলেও বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান হয়নি।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে সিলেট জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগে রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

Advertisement

তবে জেলা প্রশাসনের হিসাবে, ৯টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঘটনায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলায় ৯টি আশ্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ৮৯টি পরিবারকে আবাসন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এসব পরিবারকে খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ধরনের আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। তবে স্থানীয় ব্যক্তিদের মতে, জেলায় পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি হবে।

গত শনিবার বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যাপ্লাবিত বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শহিদুল ইসলাম চৌধুরী।

এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীও বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী বলেন, নদী তীরবর্তী এলাকার গ্রাম ও বাজারগুলো প্লাবিত হয়েছে বেশি।

ফেঞ্চুগঞ্জ জেনারেল ওসমানী সড়কের চন্ডি প্রসাদ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র খোলার সঙ্গে সঙ্গে দশটি পরিবারের প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ এখানে আশ্রয় নেন।

Advertisement

আশ্রয় নেওয়া এক ব্যক্তি জানান, পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধ নিয়ে বিপাকে ছিলাম। এখানে আশ্রয় পেয়ে আমরা এখন নিরাপদে আছি। আর সাঁতার না জানা শিশু নিয়ে আতংকিত থাকতে হবে না।

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুধী মহল বলেন, এ আশ্রয় কেন্দ্র খোলায় নিরাপদে থাকার একটা স্থান হয়েছে বন্যা কবলিত মানুষের। পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষাও মিলবে। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বন্যাকবলিত মানুষদের আহ্বান জানান উপজেলা নির্বাহী অফিসার হুরে জান্নাত।

বন্যায় বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা বন্যা প্লাবিত হচ্ছে। এক সপ্তাহে দুই উপজেলায় পানিবন্দি লোকজনের সংখ্যা তিন লক্ষাধিকের উপরে বলে জানা গেছে।

দুই উপজেলার ১৮৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে দেড় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যা প্লাবিত হওয়ায় উপজেলার প্রায় ৫১ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর পাঠ দান বন্ধ হয়ে পড়েছে।

এছাড়া বালাগঞ্জের তয়রুননেচ্ছা, ওসমানীনগরের এম ইলিয়াস আলী ও রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়সহ আরও প্রায় ৩০/৪০টি মাধ্যামিক ও মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

ওসমানীনগরের ভাগলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিউলি বেগম, রহমতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুমাইয়া আক্তার বালাগঞ্জের মনোহরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ক্ষেতকি রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, তাদের বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষে পানি ঢুকে পড়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের যোগাযোগ রাস্তাসহ চতুর্দিকে তিন-চার ফুট পরিমাণ পানি রয়েছে। বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে।

উপজেলার গাভুরটিকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মিতা রানী ধর, দক্ষিণ কালনীরচর বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোখিয়া বেগম, বালাগঞ্জের নলজুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসিদ আলী বলেন, আমাদের কর্মস্থল বিদ্যালয়ের আঙিনা, যোগাযোগ রাস্তাসহ চতুর্দিক জলমগ্ন হয়ে হাটুঁপানি রয়েছে। এ অবস্থায় আমরা পানি ভেঙে বিদ্যালয়ে গেলেও শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না।

দুই উপজেলার দায়িত্বে থাকা বালাগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রকিব ভুঁইয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি কতটি বিদ্যালয় বন্যা প্লাবিত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনও তার কাছে নেই বলে জানান।

দুই উপজেলার দায়িত্বে থাকা বালাগঞ্জ মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, দুই উপজেলার প্লাবিত বিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.মনিরুজ্জামান বলেন, উপেজলার অধিকাংশ এলাকা বন্যা প্লাবিত হয়ে আছে। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মনিটরিং সেল গঠনপূর্বক সার্বিক দিকে নজর রাখা হচ্ছে। প্লাবিত বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের যাতে ক্ষতি না হয় সে জন্য প্রয়োজনে বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করার জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলেছি।

বালাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ সিংহ বলেন, বালাগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ প্রশাসনিক ভবনসহ গোটা উপজেলাই এখন বন্যা প্লাবিত। এ অবস্থায় বানবাসী মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে ঊর্ধ্বতন মহলে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।

বিয়ানীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। উজান এলাকায় নতুন করে পানি বৃদ্ধি না পেলেও নিম্নাঞ্চলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এসব এলাকায় পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে উঠছে দুর্গত পরিবার। এসব কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছে। সরকারি কলেজসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রসহ পানিবন্দি এলাকায় অপ্রতুল ত্রাণ বরাদ্দ নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই। পুরো উপজেলার জন্য শনিবার সকাল পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ১৪ টন ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

এদিকে এলাকার সংসদ সদস্য এবং শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রোববার দুপুর ২টায় থেকে বন্যাকবলিত বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জে এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করতে সাত দিনের সরকারি সফরে নিজ নির্বাচনী এলাকায় আসছেন।

গোলাপগঞ্জ উপজেলার অর্ধশত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উপস্থিত হলেও শিক্ষার্থীরা বন্যার কারণে উপস্থিত হতে পারেনি। উপজেলার অধিকাংশ বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষ হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত।

উপজেলার বাদেপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, বিদ্যালয়ে পানি মাঠে, শ্রেণি কক্ষে পানি থাকায় শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। তাই বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

মীরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসএমসির সদস্য মঈন উদ্দিন জানান বন্যার কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা চিন্তাহরণ দাস জানান, বন্যার সময়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি চাইলে বিদ্যালয় বন্ধ রাখতে পারে। তবে সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শহিদুল ইসলাম চৌধুরী রোববার দুপুরে জাগো নিউজকে জানান, বন্যার্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১২৭ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। প্রয়োজনে এ সহায়তা আরও বাড়ানো হবে। এছাড়া বন্যা দুর্গত এলাকার সঙ্গে সমন্বয় করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

ছামির মাহমুদ/এফএ/এমএস