মতামত

বদলে যাওয়া বাংলাদেশ

এক বছর। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার এক বছর। ২০১৬–এ ১ জুলাই-এর আগের বাংলাদেশ আর নেই। বদলে যাওয়া এক নতুন বাংলাদেশ।

Advertisement

যে বাংলাদেশ আমরা আবহমান কাল থেকে দেখে আসছি, যে বাংলাদেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি, ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, সেই বাংলাদেশে অনেক বৈচিত্র্য। ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ নিয়ে আমরা অনেক কথা বলে থাকি, কিন্তু কথাটার সত্য অর্থ উপলব্ধি করতে হবে। অঞ্চল ভেদে এক বাংলা ভাষারই কত রূপ, নানা উৎসব, কত ধরনের মানুষ। কিন্তু সব মানুষের প্রাণান্তকর চাওয়া এক বাংলাদেশ, যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও থাকবে ধর্মনিরপেক্ষ। এই উদার বাংলাদেশকে বারবার সাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করেছে রাজনীতি, যার চূড়ান্ত আঘাত ছিল হলি আর্টিজানে হামলা। উদ্দেশ্য ছিল, এদেশকে পাকিস্তান আশ্রিত করা। হামলাকারীরা মারা গেছে, কিন্তু তারা সফল হয়েছে অন্যভাবে। সেই হামলার পর যেন, সমাজ আরো বিভাজিত ও কলুষিত হয়েছে, ধর্মীয় রাজনীতির বিষে আক্রান্ত হয়েছে।

গুলশান হামলার পর জঙ্গি ও সন্ত্রাসী খতমে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনী। কোথায় জাতীয় ঐক্য দেখবো আমরা, তা নয়, বরং এই সাফ্যলকে কালিমালিপ্ত চেষ্টা করেছে আমাদের এখানে সদা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী সরকার বিরোধী রাজনীতি। বিরোধিতার প্রচলিত ছকের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করতে না শেখায় আমাদের রাজনীতিকরা দেশের ভেতরেই নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশকারী শক্তিগুলির মাঝে নিজেদের ঠিকানা খুঁজছে। কোন সন্দেহ নেই সেই সন্ত্রাসীরা কারো না কারো মদদে এই কাজ করেছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক যে সহিংস রাজনীতি এই বাংলাদেশ অতীতে দেখেছে তার সাথে বর্তমানের পার্থক্য অনেক। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির চক্রের রাজনীতি সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি মানুষের কাছে। তাই এবার নতুন কৌশল- অরাজনৈতিক শক্তির নামে হেফাজতে ইসলাম নামে এক অন্ধকারের শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে যা আজ প্রগতির বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায়।

যারা স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে রাজনীতি করে, এখন তাদের এক জায়গায় আসা প্রয়োজন, তাদের মূল্যায়ন করা দরকার, নতুন এই সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি রণনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানে প্রচলিত ধারার রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন কি করে সূচিত হবে তা নিয়ে।

Advertisement

বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি তা নয়। সংকীর্ণ ধর্মীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তারের ষড়যন্ত্র। ধর্ম দিয়ে ভাবনা জগতে সংকীর্ণতা প্রবেশ করিয়ে দেয়া- ‘আমরা’ আর ‘ওরা’। এটাই সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের চিরাচরিত যে রাজনীতি তার পালাবদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে। একদল জেতে আরেক দল হারে। শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা আন্দোলনে মুখর হতো, সে আন্দোলনে সংঘর্ষ হতো। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর, এই বিচারকাজ ঠেকাতে যে সহিংসতা দেখেছে মানুষ, দিনের পর দিন পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ ও তার সম্পদ পুড়িয়ে দেয়া, তার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। এই জঙ্গি আন্দোলনের সাথেই সংশ্লিষ্ট এখনকার সংস্কৃতি বিরোধী রাজনীতি, যে রাজনীতি ভাড়া করা আধা-বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে সুচতুরভাবে সামাজিক হিংসার বিস্তার ঘটানো। ধারাবাহিক হিংসাশ্রয়ী এই রাজনীতিই গুলশান হামলার পর বাংলাদেশের সামনে নতুন রাজনীতি যাদের ফাঁদে পা দিয়েছে সাধারণ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠি।

গুলশান হামলার অন্যতম লক্ষ্য রাজনৈতিক সহিংসতা আমদানির পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্যকে বিদায় জানানো। তারা উল্লসিত হতে চেয়েছিল যেন প্রগতির পথ, উন্নয়নের পথ থেমে যায়। তাইতো হয়েছিলও কিছুটা। একের পর এক আঘাত এসেছিল ব্যবসা বাণিজ্যে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আবার জোর কদমে চলেছে উন্নয়নের চাকা। এতো রক্ত, হিংসা আর আগুনের পরও সাত শতাংশের উপর প্রবৃদ্ধি, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন।

এ কথা সত্য, যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে সংঘাত ও হিংসা পুরোপুরি দূর করা যায় না। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, এসব নানা ভাবে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে চলতে হয় বহুপাক্ষিক পথে। কোন গোষ্ঠি, ধর্মীয় বা অন্যকোন সংখ্যাতত্ত্বের জোরে যেন নিরঙ্কুশ সুবিধা ভোগ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। যারা বারবার ধর্মীয় সংখ্যার আধিক্য দিয়ে সব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র ও সমাজের উপর চাপাতে চায়, রাষ্ট্র থেকে আদায় করতে চায়, তাদের সেই মনোভাবের মধ্যেই আছে সহিংসতার সব থেকে বড় সম্ভাবনাময় উৎস।

গুলশান হামলার পর এটাই চ্যালেঞ্জ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সামনে। দুর্ভাগ্যজনক যে, এই ক্ষুদ্র মানসিকতার গোষ্ঠির সাথে মিলে বাকি সবাইও ধারণ করতে চায় সেই ক্ষুদ্র পরিচয়। ফলে বুঝে না বুঝে, ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠিও সহিংসতাকে, ঘৃণাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলছে। বিপদ এখানেই।

Advertisement

ধর্মীয় সংকীর্ণতা নয়, বরং বহুত্বের পথেই বাংলাদেশের মুক্তি। দলমত নির্বিশেষে সবার উচিত এই ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা। সহিংসতার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতেই হবে আমাদের। ‘যাকে তাকে যখন তখন মুরতাদ, নাস্তিক যারা বলে তারা দেশ বিরোধী’, এই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে সবার আগে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এটাই হোক নতুন অঙ্গীকার। বাংলাদেশকে সব মানুষের বাসযোগ্য করতে ইচ্ছে জাগতে হবে মনে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, পাকিস্তানের পথে দেশকে যারা নিয়ে যেতে চায় তাদের সাথে আর রাজনীতি নয়, এটাই হোক প্রত্যয়। উদার ও সহনশীল মনোভাবসম্পন্ন মানুষের আবাসভূমি হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম ও মর্যাদা ছিল, জঙ্গিদের অপতৎপরতার কারণে তার অনেকটাই ম্লান হয়েছে। দেশ থেকে জঙ্গিবাদ ও তাদের দোসর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিকে নির্মূলে মানুষের ঐক্য আজ সময়ের দাবি। ধ্বংস, খুন ও বিশৃংখলার মাধ্যমে যারা ধর্ম কায়েমের চেষ্টা করছে, সমাজকে কলুষিত করছে সে পথ আদতে ইসলামের পথ নয়, সে কথাও জোরের সাথে বলবার সময় এখন এই বদলে যাওয়া বাংলাদেশে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস