গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিমের পরিবারের শোক এখনও কাটেনি। থামেনি মা আর স্ত্রীর কান্না। শুধু পরিবারে নয়, নিজ গ্রামের মানুষও তার শূন্যতা অনুভব করে প্রতিনিয়ত।
Advertisement
জন্মের মাত্র এক মাস আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া বাবাকে খুঁজে ফেরে ছোট্ট মেয়ে রাইনা। আধো আধো কণ্ঠে বাবা ডাকতে শিখেছে সে। ১১ মাস বয়সি কামরুন নাহার রাইনা বাবার ছবিতে চুমু খায়, আদর করে। বাবা হারানোর বেদনা তাড়িয়ে বেড়ায় ৮ বছরের ছেলে সাজিদুল করিম সামীকেও।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিম। ডাক নাম কামরুল। গ্রামের ছোট-বড় সবার সঙ্গেই ছিল তার সুসম্পর্ক। রবিউলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার ছোট্ট দুই শিশুসন্তান বেলুন নিয়ে খেলা করছে। সাংবাদিক আসার খবরে এগিয়ে আসেন তার স্ত্রী ও মা।
তারা সবাই সাভারের বাসায়ই থাকেন। ঈদের সময়টা কাটানোর জন্য গ্রামের বাড়ি এসেছেন। রবিউলের কবরও গ্রামের গোরস্থানে।
Advertisement
কথা বলতে বলতে শাড়ির আঁচল দিয়ে রবিউলের বাঁধানো ছবিটি মুছছিলেন স্ত্রী উম্মে সালমা। ছবির দিকে এক পলকে তাকিয়ে থাকে ছেলে সামী। আর অবুঝ রাইনা তাতে চুমু খাচ্ছিল একের পর এক।
রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমা জানান, মেয়েটি সবার আগে বাবা ডাকতে শিখেছে। তার সামনে বাবার ছবি এগিয়ে দিলে তাতে চুমু খায়, আদর করে। যেন বাবাকে সে অনেক আগে থেকেই চেনে। ছেলেটি ঘুমাতে গেলে কষ্ট পায় সবচেয়ে বেশি। কারণ ওর বাবা বাসায় না আসা পর্যন্ত ও জেগে থাকত। বাসায় এসেই ছেলেকে নানা গল্প শুনাত, ছেলের সঙ্গে খেলত, ঘুম পাড়িয়ে দিত। বাবার সেই আদর ও খুব মিস করে।
বাবা আর কখনও ফিরে আসবে কিনা প্রায়ই প্রশ্ন করে সামী।
উম্মে সালমা বলেন, ঈদের আগের রাতটা খুব কষ্টে গেছে। কারণ ওই রাতেই রবিউলের বাসায় ফেরার কথা ছিল। ডিউটি ছেড়ে যদি আসতে নাও পারত তাহলে ঈদের দিন সকালে আসত। কিন্তু সে এসেছে ঠিকই। আমরা যেভাবে প্রত্যাশা করেছিলাম সেভাবে আসেনি। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মানের সঙ্গে আসতে হয়েছে। কিন্তু আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে আসেনি। আর কখনও আসবেও না। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সালমা।
Advertisement
চোখের পানি মুছতে মুছতে সালমা জানান, রবিউল দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। শুধু দেশবাসী নয়, সারা বিশ্বকে তার পরিচয় জানিয়ে গেছে। আমি একজন বীরের স্ত্রী। এই সন্তানদের বাবার আদর্শে গড়ে তোলাই আমার এখন একমাত্র স্বপ্ন।
বাবা মারা যাওয়ার পর রবিউল করিমই ধরেন সংসারের হাল। ছোট ভাই আর মাকে কখনও বাবার অভাব বোধ করতে দেননি। এমন নানা কথা আর ছেলের স্মৃতি তুলে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা করিমন নেছা।
বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলে রবিউলের ছেলে সামি জানায়, তার বাবা অনেক আদর করত। ঘুম পাড়িয়ে দিত। খেলনা কিনে দিত। আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে এখন তার বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে।
রবিউল গ্রামের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ব্লুমস নামে একটি প্রতিবন্ধী স্কুল। ৩০ জন শিক্ষার্থী আছে সেখানে। তার অবর্তমানে স্কুলটি অর্থাভাবে ধুকছে। রবিউলের বন্ধু-বান্ধব আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় কোনোমতে চালু রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জানান, যত কষ্টই হোক রবিউল করিমকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানটি আমরা চালু রাখবো। এজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চান তারা।
এছাড়া রবিউল করিমের স্বপ্ন ছিল নিজ গ্রামে একটি প্রবীণ নিবাস করার। তার সে স্বপ্ন পুরণের ইচ্ছে থাকলেও টাকার অভাবে শুরু করতে পারছেন না পরিবার।
দেশের জন্য এসি রবিউলের আত্মত্যাগকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ লাইন্স এর প্রধান গেট তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।নির্মাণ করা হয়েছে একটি মুর্যাইলও।
যেখানে লেখা রয়েছে- “জীবনের অধিক মৃত্যু হয় যারতাকে মনে রাখে জগৎ সংসারএই দেশই তাই তোমার মুখচ্ছবিনিশীথে চাঁদ, দিবসে রবি।তুমি রবিউল করিম, তুমি বীরতুমি না মায়ের, না ভাইয়ের, না স্ত্রীরতুমি মহাকালের মহাসন্তানতুমি নিলে তাই সর্ব হৃদয়ে স্থান।”
এফএ/এমএস