২০১৬ সালের ১ জুলাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম এক কালো অধ্যায়। এদিন রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। বিদেশিসহ নিহত হন ২২ জন। এর মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন।
Advertisement
হামলার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও প্রথমে পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেননি পুলিশ সদস্যরা। ওয়াকিটকিতে থানায় বিপদের সিগন্যাল দেন তারা। থানা থেকে ঊর্ধ্বতনদের অবগত করা হয় বিষয়টি। তখনই ডাক পড়ে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের (স্পেশাল ওয়েপন অ্যান্ড ট্যাকটিক্স)। সেদিনের হামলার ঘটনায় সোয়াটের দুটি টিম (পার্টি) পর্যায়ক্রমে সেখানে যায়।
হলি আর্টিসান হামলার এক বছর পূর্তিতে জাগো নিউজকে সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা জানান সোয়াটের দুই টিমের দুই কর্মকর্তা। তবে নিজেদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন তারা।
সোয়াটের প্রথম টিমে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সেদিন একটি ইফতারের দাওয়াতে উপস্থিত ছিলাম। তখন অফিস থেকে কল পাই। অফিস ডিউটির কর্মকর্তা জানালেন, গুলশান-২ এর একটি রেস্টুরেন্টে চাঁদাবাজ ঢুকেছে। ভেতরে গোলাগুলি হচ্ছে। দ্রুত চলে আসুন, ডাক পড়েছে। ফোন কেটেই দাওয়াত ছেড়ে ব্যারাকের দিকে রওনা দেই। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে রওনা হই ওই রেস্টুরেন্টের উদ্দেশে।’
Advertisement
‘তখন কোনো প্রেসার ছিল না, ভয়ও ছিল না। সত্যি বলতে আমরা খুব রিলাক্স ছিলাম। ভেবেছিলাম চাঁদাবাজরা সোয়াটের সামনে তেমন সুবিধা করতে পারবে না। তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি প্রেক্ষাপট পুরোটাই ভিন্ন। অন্যদের মুখে শুনলাম গুলশান থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও কনস্টেবল আহত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি। ভেতরে তখন গোলাগুলির শব্দ। অনেকে বলছিল ভেতরে ঢোকার সময় তারা আল্লাহু আকবর বলছিল।’
‘এবার অ্যাকশনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। সোয়াট, গুলশান ও বনানী থানা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকটি ফোর্স এবং মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি টিম অপারেশনের জন্য রেস্টুরেন্টের বাউন্ডারির ভেতরে প্রবেশ করে। প্রথম সারিতে ছিল সোয়াট। তবে সবার সামনে ও হলি আর্টিসানের বাম কোণে ছিলেন বনানী থানার প্রয়াত ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি রেস্টুরেন্টের পিলারের পাশে নিজেকে আড়াল করে ভেতরের চিত্র দেখার চেষ্টা করছিলেন।’
‘রেস্টুরেন্টের সীমানার কাছাকাছি যেতেই দেখি একটি গ্রেনেড পড়ে আছে। গ্রেনেডটি দেখে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। সামান্য দূরে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ চলছিল, এটার পিন খোলা নাকি লাগানো। পরামর্শের ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই এটি বিস্ফোরিত হয়। সামনের কাতারের সবাই ছিটকে পড়েন। আমিও অচেতন হয়ে পড়ি। পরে জানতে পারি ডিবির এসি রবিউল স্যার ও ওসি সালাউদ্দিন স্যার আর নেই।’
তার ভাষায়, জঙ্গিদের প্রথম আঘাতে সোয়াটের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হওয়ার পর দ্বিতীয় পার্টিকে ডাকা হয়। ততক্ষণে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে যে, জঙ্গিরা তরুণ, বেশভূষাও ভালো। তারা ধারণা করেন, এটা হিজবুত তাহরীরের কাজ হতে পারে।
Advertisement
ওই টিমের অপর এক সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইফতার শেষে আমি তখন বাসায়। ওয়াকিটকিতে ম্যাসেজ এলো গুলশানের হলি আর্টিসানে হিজবুত তাহরীর ঢুকেছে। প্রথম পার্টির অনেকে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ডিউটি অফিসারের ফোন পেয়ে ছুটে এলাম ডিবি কার্যালয়ে। রেডি হয়ে গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিলাম। সহকর্মীর ওপর আক্রমণের ঘটনায় সবার মধ্যেই এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। হাতিরঝিল থেকে বের হওয়ার পর নিকেতনের গেটের সামনে দীর্ঘ যানজট। আমরা নিজেদের সামলাতে না পেরে অস্ত্রসহ গাড়ি থেকে নেমে সড়ক যানজটমুক্ত করার কাজ শুরু করি। কয়েকটি গাড়ি সরিয়ে আমাদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাই।’
তিনি বলেন, কিছুক্ষণ পর আর্টিসানের সামনে গিয়ে দেখি সুনশান নীরবতা। সোয়াট আর্টিসানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। দেয়াল টপকে শাওন নামে আর্টিসানের এক কর্মী নামার পর তাকে ধরে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাতে বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলি আর চিৎকারের শব্দ পেয়েছিলাম। তবে রাত ১টার পর আর কোনো শব্দ পাইনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ না পাওয়ায় অপারেশনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা বাইরেই অবস্থান করি। এরপরের সবকিছুতো আপনারাই জানেন।’
আর্টিসানের হামলার ঘটনায় সেদিন রাতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর অভিযানে হামলাকারী ছয় জঙ্গিও নিহত হন। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস) হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। তবে বাংলাদেশের পুলিশের দীর্ঘ তদন্ত উঠে আসে, গুলশান হামলার নেপথ্যে ছিল নব্য জেএমবি। যার কর্মীরা আইএসআইয়ের মতাদর্শী।
ওই ঘটনার প্রায় দুই মাস পর নারায়ণগঞ্জে এক জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নব্য জেএমবির প্রধান ও গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী নিহত হন। কয়েক মাস পর নিহত হন আরেক মাস্টারমাইন্ড ও তামিমের সহযোগী নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান।
এআর/এমএমএ/এমএআর/পিআর