ফিচার

ছেলেবেলার ঈদস্মৃতি

জীবনে ত্রিশটি ঈদ গত হয়ে গেছে। ঈদের স্মৃতি বলতে ছেলেবেলার স্মৃতিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মধ্যবিত্ত সংসারে ঈদ নিয়ে বিশেষ কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না। অভাবের সঙ্গেই যাদের রোজ দেখা; তাদের তেমন স্মৃতি থাকতে নেই। ফলে নতুন জামা আছে তো প্যান্ট পুরনো। পায়ের স্যান্ডেল জোরাতালি দিয়ে রং মাখিয়ে নতুন করার প্রচেষ্টা। যা ঠিক ঘটা করে উপস্থাপন করা যায় না। যদিও নানার কল্যাণে কোনো কোনো বছর নতুন জামা-প্যান্ট জুটতো। তবুও কীসের যেন অপূর্ণতা থেকে যেত। বাবার প্রতি বড় অভিমান হতো।

Advertisement

নতুন পোশাকের দায়িত্বটা যখন বাবার ঘাড়ে এলো; তখন বড় প্রাপ্তির আশা ছিল না কারোরই। অভাবের বৃহৎ সংসারে জামা হলে প্যান্ট নেই। প্যান্ট হলে জুতা নেই। তাই পুরনো প্যান্ট বা জুতা পরিষ্কার করেই মানিয়ে নিতে হয়েছে কয়েক বছর। পরে অবশ্য নানা-বাবার পর দায়িত্বটি পালন করেন বড়ভাই। বড়ভাইয়ের সীমিত উপার্জনে বৃহৎ সংসারে সবার জন্য সম্পূর্ণ পোশাক জুটতো না।

চাঁদরাতে লাঠিবাজি বা তারাবাজি কিনে আনতেন বাবা অথবা নানা। একটি বাঁশের শলাকার মাথায় বারুদের পোটলা থাকতো বলে তার নাম লাঠিবাজি। আমরা লাঠিটা ধরে শক্ত কিছুর সাথে পোটলাটাকে আঘাত করলে আওয়াজ হতো। আর তারাবাজিতে কোনো আওয়াজ হতো না। আগুন দিলে তারার মতো চারিদিকে আলো ছড়িয়ে পড়তো। এছাড়া জিয়া কাকা, মোতালেব কাকা ও শফি কাকা ফোটাতো সিগারেট বাজি। সিগারেটের মতো লম্বা একটি বস্তুর মাথায় সুতা থাকতো। সুতায় আগুন দিলে কিছুক্ষণ পর বিকট আওয়াজ হতো।

চাঁদ দেখার আনন্দে আমরা বাজি ফোটাতাম। পাটখড়ি, কাশফুল, শুকনো পাতা দিয়ে বানাতাম ‘বুড়ির ঘর’। সন্ধ্যায় সে ঘরে আগুন লাগিয়ে আনন্দ করতাম। বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে মিছিল হতো- ‘হলদি/ চাঁদ উঠছে জলদি’ এবং ‘ঈদের চাঁদ উঠছে, আল্লায় দিছে’। একটু বড় হলে মেজ কাকা বা ছলেম কাকা কাঠের ওপর মেশিনের প্লাঞ্জার বসিয়ে ‘হাতুড় বাজি’ বানিয়ে দিতেন। হারুন মোল্লার দোকান থেকে গন্ধক আর পটাশ কিনে বাজি ফোটাতাম। ফুফাতো ভাই মোস্তাফিজ, মামা রাকিব ও চাচাতো ভাই আনসার ছিলো বাজির ওস্তাদ। ওরা বিকট আওয়াজের বাজি ফোটালে আমি কানে আঙুল দিতাম।

Advertisement

ডিসেম্বর মাসের কনকনে শীতের ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে বাবা যখন হাসিমুখে আমাদের ঘুম থেকে জাগাতেন, বাবার সেই পবিত্র মুখের দিকে তাকিয়ে সব অভিমান কোথায় যেন চলে যেত। আমরা ভাই-বোনেরা মিলে বাবার সঙ্গে চলে যেতাম নদীর পারে। নতুন কসকো সাবানের ঘ্রাণে কাঁপতে কাঁপতে গোসল করে বাড়ি ফিরতাম। বাবা নিজহাতে আমাদের জামা-কাপড় পরিয়ে দিতেন। সকালের আলো ফুটলেই প্লাস্টিকের ঘড়ি-চশমা পরে বের হতাম। প্লাস্টিকের চশমা পড়ে কখনো সমতল মাটিকেও উঁচু-নিচু দেখতাম। তবুও কত আনন্দ ছিলো তখন।

ছোটবেলায় বিশেষ করে মায়ের হাতের মলিদা ছিলো পরম তৃপ্তির। জামা-কাপড় পরা হলেই তিনি এক গ্লাস মলিদা (নারিকেল, চিনি বা গুড় ও আতপ চালের শরবত) এনে আমার হাতে দিতেন। সকালে শিরনি রান্না করতে যাওয়ার সময় কিছু কিসমিস ধরিয়ে দিতেন আমার হাতের মুঠোয়। কারণ মা জানতেন, এ দু’টো জিনিস আমার খুব প্রিয়।

এরপর গরু কাটা হয়ে গেলে আমরা গামলা ভর্তি মাংস নিয়ে ঘরে ফিরতাম। বাড়ির সাত-আটজন মিলে বড় একটি গরু কিনতেন। কাটাকুটি শেষে সমানভাগে ভাগ করে যার যার অংশ নিয়ে যেতেন। কিছু মাংস দিয়ে প্রতিবছরই সকালে গরুর ভুনা দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন মা। বাবাও কাটাকাটি শেষে রান্নাঘরে এসে মাকে সহযোগিতা করতেন।

এখনো কাজগুলো করছেন। কিন্তু এখন আর সেই ছোটবেলার আমেজটা আমাদের মধ্যে নেই। নতুন জামা নতুনই থাকে। খুব একটা পরা হয় না। সে সবই এখন স্মৃতি মনে হয়। তখন নতুন জামা পরে দলবেঁধে ঘরে ঘরে যেতাম। আমরা তিন-চারজন মিলে (বেশিও হতো) একটি দল হতাম। সকালে থাকতো শিরনি পর্ব। গ্রামের এ প্রান্ত থেকে শুরু করে ওপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যেতাম। প্রত্যেক ঘর থেকে এক চামচ করে শিরনি প্লেটে দিতেন। আমরা খেয়ে হাত না ধুয়েই অন্য ঘরে যেতাম। পেট ভরে খাওয়া হলে সবশেষে হাত ধুতাম।

Advertisement

এরপর গরুর গোশতের জন্য বিরতি। সবার ঘরে ঘরে গরুর গোশত রান্না হয়ে গেলে আবার দুপুরের দিকে ছুটতাম দলবেঁধে। প্রতিবছর আমাদের দলে পরিবর্তন আসতো। আমার সমবয়সীদের মধ্যে দুলাল, টোটন, হাফিজ, রাকিব, মাহবুব- আমরা এক দলে থাকতাম। আমাদের একটু বড়দের মধ্যে মেজভাই, মোস্তাফিজ, আবু তালেব, খলিল কাকা মিলে একটি দল হতো। কখনো কখনো আমরা দুটি দল মিলে একদল হয়ে যেতাম।

ঈদের দিন রাতে যেতাম আত্মীয়-স্বজনের ঘরে। এরপরও কোনো ঘর বাদ পড়লে ঈদের পরে দিন গিয়ে হাজির হতাম। এভাবে ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত চলতো অবাধ খাওয়া-দাওয়া। কারণ সবার জন্যই প্রত্যেক ঘরের দরজা থাকতো উন্মুক্ত। যখন একটু বড় হলাম, মানে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ি কিংবা স্নাতকে ভর্তি হয়েছি; তখনও ছোটদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতাম। তখন ছোট ভাই-বোনদের হাতে মেহেদি পরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা ছিলো আমার। চাঁদরাতে বোন আর ভাইটা ঘুরঘুর করতো। ওদের হাতে মেহেদি পরিয়ে দিয়ে নিজেও আনন্দ পেতাম।

যে বছর ঈদে বাড়ি যাইনি- ঢাকাতেই ছিলাম। সকালে মা ফোন করে বললেন, ‘তোমার মলিদা ও কিসমিস ফ্রিজে তুলে রাখলাম। যেদিন আসবে; সেদিন খেতে পারবে।’ আমার চোখের কোণে তখন চিকচিক করছিল আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত অশ্রু। শুষ্ক অনুভূতি কখনো কখনো আর্দ্র হয়ে ওঠে।

এখন বড় হয়ে গেছি। তবুও বাবা সকালেই গোসলের কথা বলেন। নতুন জামা-কাপড় পরলে কেমন লাগবে- তা দেখার জন্য বায়না ধরেন। ‘বাবা আমরা এখন বড় হয়েছি। একটু পরে পরবো।’ ইত্যাদি বলে ফিরিয়ে দেই। বাবা নামাজ শেষে গরুর গোস্ত কাটার বন্দোবস্ত করেন। কখনো সাহায্য করি, কখনো বাবা-কাকা, বড়ভাইদের ওপর চাপিয়ে পালাই।

সত্যি বলতে কী? মানুষ যত বড় হয়; ততই আনন্দ ফিকে হয়ে আসে। বাড়ে দায়িত্ববোধ। সে বোধটা কেমন যেন কঠিন। ছোটবেলার সেই আনন্দবোধের সঙ্গে একে মেলাতে পারি না। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি তো বড় হতে চাইনি। ছোটই থাকতে চেয়েছিলাম। অনেক ছোট।

সময় বয়ে যায়। বয়ে চলে মানুষের জীবন। আবেগ-অনুভূতি ফিকে হয়ে আসে ক্রমশ। শুধু থেকে যায় স্মৃতি। তাই স্মৃতিরাই পিছু টানে। কিন্তু সেখানে আর যেতে পারি না। কবির কথা মনে পড়ে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সে জানতো— সবাই জানে/ শৈশবে আর ফেরা যায় না।’ সে আমিও জানি। শৈশবে আর ফিরতে পারবো না। তাই তো স্মৃতিটুকু রেখে গেলাম কালির আচড়ে।

তবুও বলবো, সবার ঈদ কাটুক আনন্দে। কারণ ঈদ মানেই তো আনন্দ। ঈদ মানেই তো খুশি। শৈশব কী যৌবনে- এ আনন্দধারা চির বহমান থাকুক। ছোটবেলার সাথীরা সুখে থাকুক। এখন যারা ছোট- ঈদের খুশিতে ওদের হৃদয়ও ভরে উঠুক কানায় কানায়!

লেখক : কবি, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।

এসইউ/এমএস