বিশেষ প্রতিবেদন

ঈদ আসে ঈদ যায়, ভাইয়া ফেরে না

প্রতি ঈদেই ভাইয়ার সঙ্গে বাবার কবর জিয়ারত করতে যেতাম। সততার সঙ্গে বাবা আমাদের জীবনযুদ্ধ শিখিয়ে গেছেন। সে পথেই চলেছে ভাইয়াও। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বাবার পর ভাইয়াও চলে গেলেন। বাবার সঙ্গে সঙ্গে এখন ভাইয়ার কবরও জিয়ারত করছি। ভাবলেই স্থির থাকতে পারি না। পেশাগত জীবনে কতো ব্যস্ততাই না কেটেছে ভাইয়ের। আম্মা, ভাবি ও ভাতিজাদের বোঝাতে পারি না। ভাইয়ার স্মৃতি পরিবারের পথচলা যেন থামিয়ে দিয়েছে।

Advertisement

র‌্যাবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে ছাড়াই এবার প্রথম ঈদ করছে পরিবার। গতকাল সোমবার ঈদের দিন বনানী সামরিক কবরস্থানে কর্নেল আজাদের কবরের সামনে দুই হাত তুলে মোনাজাত ধরেছেন মা সায়েদা করিম। ডুকরে কেঁদেছেন মা সায়েদা, আজাদের স্ত্রী সুরাইয়া সুলতান, তিন সন্তান জারিফ, জারা ও জাবির, আজাদের সেই সময়ের দেহরক্ষী আবুল হোসেন ও গাড়িচালক। কেঁদেছেন সঙ্গে পরিবারের অন্য কয়েকজন নারী সদস্যও। বনানী সামরিক কবরস্থানে নিরবতা ভাঙে স্বজনদের গগন বিদারি কান্নায়।

মা সায়েদা বলছিলেন, মায়ের কাছে সন্তানই সব কিছু। পেশাগত কারণে অনেক বড় কর্মকর্তা হলেও সন্তান মায়ের কাছেই শুধুই সন্তান। নাতি-নাতনি আছে, আছে বাড়ি-গাড়ি। তারপরও সব ফাঁকা লাগে।

‘এক মায়ের বুক অন্য মায়ের সন্তান খালি করে দিতে পারে না। তারা মানুষ নয়। এমন করে কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। ওর স্মৃতি ভুলতে পারি না। এমন সন্তান জন্ম দিয়ে নিজেকে সব সময় গর্ব করি।’

Advertisement

মঙ্গলবার কথা হয় ছোট ভাই ইউসুফ হাসান হিমেলের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বাবার পর ভাইয়ার ছায়ায় নিজের দিশা খুঁজে পেয়েছি। সব সময় উৎসাহ দিতো। বাবার অভাব বুঝতে পারিনি। সেনা কর্মকর্তা ও র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান হয়েও সাদা সিদে জীবন ছিল ভাইয়ার, আমাদের সঙ্গেই থেকেছেন।

হিমেল বলেন, ঈদে ভাইয়া ফ্রি থাকলে সন্তানদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এবার সে চিত্র বদলে গেল। আমাকেই ভাইয়ার সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে যেতে হচ্ছে। ভাইয়ার দায়িত্ব পালনে কার্পণ্য করেননি। ভাইয়া নেই। তার পরিবারে দায়িত্ব এখন আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। এখন বুঝতে পারছি ভাইয়া সে অসীমতা নিয়ে আমাদের জন্য নিজে বিলিয়ে গেছেন।

তিনি আরও বলেন, এতোদিনে বাবাকে আর পায় না আড়াই বছরের শিশু জাবির। ওর চোখে মুখে দেখি বাবাকে খুঁজে ফেরা চাহনি। এই চাহনি’র ভাষা বুঝলেও ভাইয়াকে ফেরানোর সাধ্য আমার নেই।

স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হিমেল বলেন, গত ঈদেরই কথা। ঈদের নামাজ পড়ে বাবার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম আগারগাঁওয়ে। আগারগাঁও আইডিবি ভবনের পাশে অবস্থিত মসজিদের পেছনে বাবার কবর। জিয়ারতের আগেই খবর আসে শোলাকিয়া ঈদগাহে জঙ্গি হামলার খবর। এরপর ব্যস্ত হয়ে উঠেন ভাইয়া। গাড়ি আসে। কবর জিয়ারত করে গাড়ি করে আামদের পৌঁছে দেন বাসায়। নিজে হেলিকপ্টারে উড়ে যান শোলাকিয়ায়। সে পর্বে ভাইয়া জীবিতই ফিরে আসেন। কিন্তু সিলেটের আতিয়া মহলের অভিযানে গিয়ে গুরুতর আহত হলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। গতকাল এসবই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।

Advertisement

হিমেল বলেন, ঈদ আসে ঈদ যায়, ভাইয়া ফেরে না। জীবনে এমন দিন আরও আসবে, যাবে। জানি ভাইয়া ফিরবে না। ওর অবুঝ সন্তানদের কথা ভেবে কিছুই ভালো লাগে না। ভাইয়ার সন্তানদের যেন ভাইয়ের মতোই দেশপ্রেমিক ও মেধাবি হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। সবার কাছে শুধু এই দোয়া চাই।

উল্লেখ্য, গত ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গি আস্তানার কাছে বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন আবুল কালাম আজাদ। বিস্ফোরিত বোমার স্প্লিন্টার তার বাঁ চোখের ভিতর ঢুকে যায়। প্রথমে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে রাতেই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরদিন রোববার রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। সেখানে তিনি মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শে বুধবার রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় এনে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। পরের দিন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

জেইউ/জেএইচ/পিআর