বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন জেলা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান কুমিল্লা। তাই নানা কারণেই এ জেলার রয়েছে অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এ জেলার সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান এবং বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পাশাপাশি পর্যটনের ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। সারা বছর দেশ-বিদেশ থেকে আসা হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে কুমিল্লাঞ্চলের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলিতে।
Advertisement
এক কথায় অসংখ্য প্রাকৃতিক সম্পদ আর নয়নাভিরাম দৃশ্যের অপূর্ব সমাহারে বিস্তৃত কুমিল্লা। নান্দনিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুমিল্লার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানসমূহ বিনোদন ও জ্ঞানপিপাসু পর্যটকদের আনাগোনায় বছরের প্রায় সবসময় মুখর থাকে। অসংখ্য প্রাকৃতিক ও প্রত্নসম্পদ নিদর্শনসমৃদ্ধ নয়নাভিরাম অপরূপ দৃশ্যের সমাহারে বিস্তৃত কুমিল্লায় এ বছর ঈদের লম্বা ছুটিতে আপনিও পরিবার-পরিজন বা সহপাঠীদের নিয়ে ঘুরে যেতে পারেন।
কুমিল্লার শহর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি (কোটবাড়ি) অবস্থিত। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তি রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন স্পটের মধ্যে ‘শালবন বিহার’, ‘নবশালবন বিহার’ ও ‘বৌদ্ধ বিহার’ অন্যতম। শালবন বিহার দেখার পর প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে দেখতে পাবেন ‘কোটিলামুড়া’। এখানে তিনটি বৌদ্ধ স্তুপ আছে। এর ভিত্তি বেদীগুলো চার কোণাকার।
কোটিলামুড়া দেখার পর এটি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত ‘চারপত্র মুড়া’ দেখুন। প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু একটি ছোট ও সমতল পাহাড়ের চূড়ায় এর অবস্থান। পাহাড়পুর বিহারের পরই এর স্থান। এছাড়াও রয়েছে ‘রূপবান মুড়া’। রয়েছে ‘ময়নামতি যাদুঘর’। যাদুঘরের পাশে বন বিভাগের নতুন দুইটি পিকনিক স্পট করেছে।
Advertisement
ময়নামতি জাদুঘর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে দর্শনীয় স্থান ‘ব্লু-ওয়াটার পার্ক’। এখানে রয়েছে পানির ফোয়ারা, শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইডস, পাহাড় থেকে কৃত্রিম উপায়ে পানির ঝরনাধারা, হাতি, অজগর, কুমিরসহ বিভিন্ন পশুপাখির দৃষ্টিনন্দন প্রতিকৃতি।
কুমিল্লায় রয়েছে উপমহাদেশের সমবায়ের অন্যতম পৃথিকৃত মরহুম আকতার হামিদ খানের স্মৃতি বিজরিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) ও কেটিসিসি লিঃ। কোটবাড়ি এলাকায় রয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের সূতিকাগার। বার্ডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে ফি লাগে না, তবে অনুমতি নিতে হবে।
বার্ডের ভেতরের দুই পাহাড়ের মাঝখানে দেখতে পাবেন অনিন্দ্য সুন্দর ‘বনকুটির’, রয়েছে ‘নীলাচল পাহাড়’। নির্জন প্রকৃতির এক অকৃত্রিম ভালো লাগার জায়গা হচ্ছে এ নীলাচল। পুরো বার্ডের ভেতরই সবুজের সমারোহ। রয়েছে পাখির কিচির-মিচির আওয়াজ। বুড়িচংয়ের সাহেববাজারে ‘রানীর বাংলো’, একই সড়কের পাশে এলাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ৭৩৭ জন সৈন্যের সমাধি ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি।
এছাড়া লালমাই পাহাড়ের শীর্ষ দেশে রয়েছে দুটি ‘চন্ডি মন্দির’, ওই এলাকাটি চন্ডিমুড়া হিসেবে পরিচিত। ত্রিপুরাধিপতির বংশধর দ্বিতীয়া দেবী প্রতিষ্ঠিত চন্ডি মন্দিরদ্বয় ১৩শ’ বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
Advertisement
১৭শ শতাব্দীতে রাজা গোবিন্দ মানিক্যের অনুজ জগন্নাথ দেবের মেয়ে দুতিয়া দেবী এ দুটি মন্দির নির্মাণ করেন। এর সামান্য দূরেই রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে ‘দুতিয়া দীঘি’। কুমিল্লা শহরের বাদুরতলায় রয়েছে ‘ধর্মসাগর’ দীঘি। প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর আগে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ধর্মমানিক্য এটি খনন করেন। এ সাগরের আয়তন ২৩.১৮ একর। এর উত্তর পাড়ে রয়েছে পাঁচ একরের কুমিল্লা ‘নগর পার্ক’। এর উত্তর পূর্ব কোণে রয়েছে ‘রাণীর কুটির’ এবং একটি ‘শিশু পার্ক’ ও ‘নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র’। বিশুদ্ধ পরিবেশে প্রাণ খুলে সময় কাটাবার এক মায়াময় স্থান ধর্মসাগর পাড়। ধর্মসাগরে নৌকায়ও ভ্রমণ করা যায়। এ ছাড়াও আছে নগরীর মোগলটুলীতে ঐতিহাসিক ‘শাহ্ সুজা বাদশাহ্ মসজিদ’, বাদুরতলায় ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, দক্ষিণ চর্থায় ভারত উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শচিন দেব বর্মনের বাড়ি, বাগিচাগাঁয়ে রয়েছে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের অন্যতম নেতা অতীন রায়ের বাড়ি, কেটিটিসির পর্যটন কেন্দ্র, জগন্নাথ মন্দির, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত কুমিল্লার সুখ-দুঃখের সাথী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা গোমতী নদী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান।
দেখতে পারেন কুমিল্লার চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, নূরজাহান ইকো পার্ক ও ফার্ন টাউন। সদর দক্ষিণ উপজেলার রাজেশপুরে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত রাজেশ পুর ফরেস্ট বিটে রয়েছে ব্যাপক প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। এই ইকো পার্কে ৮৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৩৫ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ৬ প্রজাতির উভয়চর, ৪০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১২৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ইকো পার্কে তৈরী করা হয়েছে নয়নাভিরাম সুসজ্জিত প্রবেশ গেইট, পিকনিক শেড এবং বনশ্রী বিশ্রামাগারসহ নানা সুযোগ সুবিধা।
সদর দক্ষিণের বিজয়পুরে কুমিল্লার ঐতিহ্যের ‘মৃৎশিল্প’। এ মৃৎশিল্প কারখানাটি এখনও দেশে-বিদেশে কুমিল্লার খ্যাতি বৃদ্ধি করছে। এখান থেকে কম টাকায় মাটির তৈরির ফুলের টব, ফুলদানি, হাঁসটব, লম্বা ও গোল ছাইদানি, চায়ের কাপ, প্লেট ও নকশাদার বাতি, মাছ, ক্যাঙ্গারুসহ অনেক কিছু কিনতে পারবেন।
লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে নারী জাগরণের পথিকৃত্ নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর বাড়ি, দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে ‘ত্রিশ আউলিয়ার মাজার’। মুরাদনগর উপজেলার কবিতীর্থ দৌলতপুরে যেতে পারেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিজড়িত দেখার জন্য। এখানে নার্গিসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কুমিল্লার শহর ও দৌলতপুরে অনেক কবিতা ও গান রচনা করেন কবি নজরুল।
গোমতী নদীর তট, প্রাচীণ জমিদার বাড়িগুলো পর্যটন স্পট হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত। জেলার চান্দিনার কৈলাইন গ্রামে রয়েছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পন্ডিত শীল ভদ্র ভিক্ষুর বাড়ি। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্বা গান্ধীর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে কুমিল্লার অভয়আশ্রমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল, পন্ডিতশীল ভদ্র, ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ভাষা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও ভারতীয় উপ-মহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত সাধক শচীনদেব বর্মনের স্মৃতিচিহ্ন বাড়িতে ঘুরে দেখতে পারেন নগরীতে।
এফএ/এমএস