ডি নেট প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য তাদের মিলেছে স্বীকৃতিও। ডি নেটের এমন সাফল্যের পেছনে যার অবদান তিনি হলেন ডি নেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনন্য রায়হান। সম্প্রতি তিনি প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়ন-উদ্ভাবন, তরুণ উদ্যোক্তা, সমাজ উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ, ডি নেটের পথচলা, সাফল্য-সম্ভাবনা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত।
Advertisement
জাগো নিউজ : ডি নেট মূলত কী নিয়ে কাজ করে?অনন্য রায়হান : ডি নেট সলিউশন ডিজাইন অর্গানাইজেশন। আমরা মূলত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সোশ্যাল সমস্যাগুলো সলিউশনের ডিজাইন করি।
জাগো নিউজ : একটু বিস্তারিত বলবেন কি?অনন্য রায়হান : ডি নেট পূর্ণকালীন কাজ শুরু করে ২০০৫ সাল থেকে। আমাদের পথচলার ১২ বছর হলো। তবে ডি নেটের জন্ম ২০০১ সালে। ডি নেট প্রতিষ্ঠায় প্রথমত প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নের একটা লক্ষ্য ছিলো। দেশের উন্নয়নে প্রযুক্তি চর্চা দরকার। সেইসঙ্গে প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়ন-উদ্ভাবন দরকার। একটা সময় দেশে ক্ষুদ্র এনজিও প্রসার লাভ করে তখন আমরা ভেবেছি যে ঋণের বাহিরে কিভাবে মানুষের সক্ষমতা বাড়ানো যায়। আর সেটা প্রযুক্তির মাধ্যমে। আমরা চেষ্টা করেছি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটা মডেল তৈরি করে সেটা যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। প্রথমে আমাদের উদ্যোগে যে প্রকল্প সারাদেশ ব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছি- সেটা হলো সরকারি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। শুরুতে এর নাম ছিলো ইউনিয়ন ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিস সেন্টার। এই মডেলটা তৈরি করেছে ডি নেট।
জাগো নিউজ : এরপর ডি নেট কী করল?অনন্য রায়হান : মাঠ পর্যায়ে আমরা ২০০৩ সাল থেকে কাজ করি। এজন্য চারটি মডেলে আমরা কাজ করেছিলাম; সেখান থেকে সরকার একটি গ্রহণ করেছে। এরপর ২০০৪ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা সংগঠনের সহায়তায় তথ্যপ্রযুক্তি এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করি। সারাদেশে প্রায় ৪০০টি স্কুলে কম্পিউটার লার্নিং সেন্টার, পরে ৫টি করে কম্পিউটার দিয়ে স্কুলগুলোতে ল্যাব তৈরি করি। এরসাথে একটি বই নিয়ে আসলাম যা প্র্যাকটিকাল নির্ভর। একটা পর্যায়ে এসে সরকারও সম্পৃক্ত হলো। এরপর কাজ শুরু করি স্মার্ট ক্লাস রুম নিয়ে।
Advertisement
জাগো নিউজ : সমাজের এসব উন্নয়নমূলক কাজে ডি নেটর মূল সংগঠনের বাইরে কী আর কোন অঙ্গসংগঠন আছে? থাকলে তারা কী কাজ করছে?অনন্য রায়হান : ডি নেট মূল সংগঠন, এর বাইরে আমাদের অনেকগুলো অঙ্গসংগঠন আছে। এদের মধ্যে একটি মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন- যারা মূলত ডিজিটাল কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করে। মোবাইল গেমস-অ্যাপস নিয়ে কাজ করছে। মিনা কার্টুনের একটি মোবাইল সিরিজ ইতোমধ্যে ৭ লেভেল পর্যন্ত পাবলিশড হয়েছে। আমাদের অঙ্গসংগঠন এমসিসি এটিতে সহায়তা করছে। এছাড়া ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ নিয়ে কাজ করছি। আপনজন নামে মোবাইল হেলথ সার্ভিস, যেটা গর্ভবতী মায়েদের নানা পরামর্শ নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া আমাদের লাইফ কর্ড একটি অঙ্গসংগঠন আছে- যেটা গ্রাম ও শহরের জন্য এমন একটা কিছু করতে যাচ্ছে, যা এখন পর্যন্ত কেউ করছে না। এর ফলে সাধারণ নাগরিকরা উপকৃত হবে।
আরেকটা আছে- আই সোশ্যাল তথ্য কল্যাণী, এই মডেলটা আমরা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছি। এখানে কল্যাণীদের মধ্যে আছে তথ্য সেবা দেওয়া, এদের মূল কাজ হবে বিভিন্ন বাড়ি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা- যা পরবর্তীতে সরকারি কোন ভাতা বা সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। কৃষি কল্যাণী- কৃষক এবং বাড়ির মহিলাদেরকে বাড়ির আঙিনায় যারা চাষাবাদ করে তাদের বিভিন্ন তথ্যসহ আয় বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে। স্বাস্থ্য কল্যাণী- এটা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করবে। সর্বশেষ হলো কিশোরী কল্যাণী, যা কিশোরী মেয়েদের যে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন জিজ্ঞাসা-সমস্যা, বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের কিশোরীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেবে।
জাগো নিউজ : এসব কার্যক্রমের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন? অনন্য রায়হান : এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য টেরিটরি ম্যানেজার এবং হাব ম্যানেজার নিয়োগ করছি সারাদেশে। ৪০টি টেরিটরিতে ৪০জন টেরিটরি ম্যানেজার এবং ২৫০টি উপজেলায় ২৫০টি হাব ম্যানেজার ছাড়াও সর্বমোট ১০ হাজার কল্যাণী নিয়োগ করা হবে। পুরো কাজটি শেষ হবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। ১০ হাজার কল্যাণী মাঠে নামলে আমরা স্বাস্থ্য, কৃষির একদম মাঠপর্যায়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবো। কল্যাণী হিসেবে যারা কাজ করবে তারাও স্বাবলম্বী হবে। সরাসরি কর্মসংস্থানের বিষয়ে আমাদের একটা অংশগ্রহণ থাকবে ডি নেটের। আমাদের আরেকটি পদক্ষেপ আছে ‘কাইট বাংলাদেশ’ নামে। আমরা এখানে চেষ্টা করছি শিক্ষাসংক্রান্ত আরলি চাইল্ডহুড নিয়ে কাজ করতে। এছাড়া রয়েছে গুণীজন ট্রাস্ট। এর কাজ হলো- বাংলাদেশে যে সব গুণীজন রয়েছেন তাদের জীবনী শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরা।
জাগো নিউজ : আমরা জেনেছি ডি নেট তরুণ্যনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান- এর কারণ কী?অনন্য রায়হান : তরুণরা চট করে শিখতে পারে, রিস্ক নিতে পারে। তরুণদের মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া আসে। তরুণরা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে। সেগুলো ইনজয় করতে পারে। ইনোভেটিভ কিছু করতে রিস্ক টেকিং মেন্টালিটি জড়িত। রিস্ক নিতে না পারলে ইনোভেটিভ কিছু সম্ভব নয়। এ সবকিছু বিবেচনা করে ডি নেটের পুরো টিম সাজানো হয়েছে তরুণদের নিয়ে।
Advertisement
জাগো নিউজ : তরুণদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন- অনন্য রায়হান : আমি অফিসে তরুণদের সঙ্গে কাজ করি। আমি প্রতিদিনই শিখি তাদের কাছ থেকে। কোন অর্জনই টেকসই হবে না; সে অর্জনের পিছনে যদি শ্রম এবং ঘাম না ঝরে। রাতারাতি সফল হওয়ার চিন্তা একটা ভুল চিন্তা। আমরা নিজেরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি জাংশন নামে। এর মাধ্যমে আমরা পুরো জার্নিতে চেষ্টা করেছি তরুণ উদ্যোক্তাদের সাপোর্ট দেওয়ার। সামনের দিনে বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় চালিকা শক্তি হবে উদ্যোক্তারা। যে পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়োজন তা প্রচলিতভাবে আর হবে না। সেজন্য ছোট ছোট উদ্যোগ দরকার অর্থাৎ আমি একা হয়তোবা ৫ থেকে ১৫ বা ১০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবো। এর কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে তাই বড়র পাশাপাশি ছোট ছোট উদ্যোগ দরকার। যা হবে প্রযুক্তিভিত্তিক বা জ্ঞানভিত্তিক ট্রাডিশনালভিত্তিক। কারণ দেশের উন্নয়নে প্রচুর উদ্যোক্তা দরকার।
জাগো নিউজ : দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক তরুণই উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?অনন্য রায়হান : উদ্যোক্তা তৈরির পেছনে সরকারের পাশাপাশি আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানেরও অনেক কিছু করার আছে। যারা উদ্যোক্তা হিসেবে আসতে চান তাদের উদ্দেশে বলবো- আপনি উদ্যোক্তা হিসেবে যদি নেতৃত্ব দিতে চান, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে যে ছোট কাজটা তা আপনাকে করতে পারার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। এটা যদি আপানি করতে পারেন তাহলে আপনি উদ্যোক্তা হতে পারবেন। উদ্যোক্তা হওয়ার কোন শর্টকাট পথ নেই। আমি দশ টাকা নিয়ে নামলাম, পরের মাস থেকে লাভ করতে শুরু করলাম- এমন চিন্তা নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া যাবে না। উদ্যোক্তা হতে হলে ধৈর্য থাকতে হবে। একটা উদ্যোগে সফল হয়ে মুনাফা করতে কমপক্ষে এক বছর লাগে। সেই পর্যন্ত আর্থিকভাবে আপনার দম থাকবে কি না এটা আপনাকে হিসেব করে নামতে হবে। আর ব্যবসা করতে গেলে ভালো পার্টনারশিপে ব্যবসা করা উচিত। পার্টনারশিপটা এমন হতে হবে; যেখানে একজন ফিন্যান্স বোঝে, একজন মার্কেটিং এবং একজন বিজনেস বোঝে। খুব ভালো হয় সাথে যদি একজন থাকে, যে ল’ বোঝে। তাহলে ফেল করার সম্ভাবনা কম। আর যেহেতু মানুষের পকেট থেকে টাকা বের করা কঠিন, তাই বাকিতে ব্যবসা করবেন না। এমন এক বিজনেস মডিউল তৈরি করতে হবে, যেন মানুষ আপনার কাছ থেকে নগদ টাকায় পণ্য বা আপনার সেবাটা কেনে।
জাগো নিউজ : ডি নেট আগামীতে কী করতে চাচ্ছে?অনন্য রায়হান : আমরা একটি নতুন সেক্টর হাতে নিয়েছি মেন্টাল ওয়েল বিং- মানসিক স্বাস্থ্য। যৌন হয়রানি, জঙ্গিবাদ বা শিশুরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হচ্ছে- এগুলো হওয়ার পেছনে একটি মেন্টাল রিজিওন আছে। আমরা এটা অনুভব করি না। এই যে রুট কজ যেটা, এটা কেন ঘটছে সেখানে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। একজনের শিশু বয়স থেকে নির্ধারণ হয়ে যায়; সে ভবিষ্যতে কেমন হবে। আমরা ওই জায়গাতে কাজ করতে চাই। একটা ছেলে ক্লাসে পটপট করে শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। আরেকজন কিন্তু তা পারছে না। যখন পারছে না; তখন তাকে বেত দিয়ে মারা হচ্ছে। কিন্তু আসলে সে কেন পারছে না? এটা তার দোষ না, এটা তার একটা অসুখ। আপনার ছেলে বা মেয়ে সুস্থ আছে কি না, আর না থাকলে কী করণীয়? আমরা সে জায়গাটাতে কাজ শুরু করতে চাচ্ছি। আমরা এমন কিছু করতে চাই- যেন শিশু-কিশোররা সুস্থ নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। এছাড়া ডি নেটে বর্তমানে বিগ ডেটা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমরা এমনভাবে কাজ করছি, যেন একটা বিজনেস মডিউল দাঁড়ায়।
জাগো নিউজ : ডি নেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য কোনগুলো?অনন্য রায়হান : আমাদের প্রায় সব কাজেই সাফল্য পেয়েছি। এরমধ্যে আমাদের আপনজন স্বাস্থ্যসেবায় ২০ লাখের বেশি মা বা পরিবারের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে পেরেছি। এছাড়া কল্যাণীর মাধ্যমে গ্রামপর্যায়ে ১১ লাখ ব্যক্তির কাছে সেবা পৌঁছে দিতে পেরেছি। সরকার ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার যে করেছে, তার সাথে আমরা সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছি- এটা আমাদের সাফল্য। ৩০ হাজার স্কুলে আমাদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম আছে- এটা আমাদের স্মার্ট ক্লাস রুমের আদলে তৈরি হয়েছে।
জাগো নিউজ : ডি নেটকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?অনন্য রায়হান : বাংলাদেশের বাইরে ব্র্যাককে যেমন সবাই চেনে। ড. ইউনুসকে চেনে। বাংলাদেশ বললে যেন ডি নেটের কাজগুলোকে চেনে, সেই পর্যায়ে দেখতে চাই। আমরা সবসময় পার্টনারশিপে বিশ্বাস করেছি। একা কিছু করা সম্ভব নয়, যা-ই করি না কেন- মিলেমিশে করতে হবে অন্যদের সঙ্গে। সে কারণে হয়তো এগিয়ে যেতে পেরেছি। আমাদের আইডিয়াগুলো, কাজগুলো যেন এমন হয় যা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে নতুন কিছু করতে।
জাগো নিউজ : জাগো নিউজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অনন্য রায়হান : জাগো নিউজকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
এএস/এসইউ/জেআইএম