মতামত

ঈদ আর উন্নত জীবন সেতো মেঘনার ওপারে!

ঈদ মানেই এক অনাবিল উৎসব, সীমাহীন আনন্দের ছুটোছুটি। ঈদ সকল দেশের, সকল মুসলমানের আত্মশুদ্ধির শাশ্বতিক নির্মল আনন্দ ও পুণ্যের এক দুর্লভ অনুভূতি, যা ভাগাভাগি করলে ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ঈদ বিশ্বের সমগ্র মুসলমান জাতির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।

Advertisement

ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপরীত অর্থের দুই মেরুর কোন শব্দ নয়। একটি জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস সে জাতির সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৮২ সালে মেক্সিকো শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি নীতিমালা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, “একটি জাতির- শিল্প, সাহিত্য, স্থপতিদের নির্মাণকর্ম, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এবং মানুষের ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদি সবকিছুকেই তাঁর সংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে গণ্য করা হবে। সামাজিক রীতিনীতি, বিশ্বাস, ঐতিহাসিক নিদর্শন, নৃতত্ত্ব, গ্রন্থাগার- সবকিছুই সংস্কৃতির অংশ। ‘অর্থাৎ যে দেশ বা জাতি তাঁর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে দেশের ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সর্বমানবাদী রূপকে সংরক্ষণের মাধ্যমে সংস্কৃতিতে সমন্বিত করতে সক্ষম হবে সে জাতি সমৃদ্ধ হবে।

আজ পৃথিবীময় ইসলাম ধর্মের তথা মুসলিম জাতির সংস্কৃতির যে কলুষিত অধ্যায়ের পরিচয় আমরা পাই ভারতবর্ষে তা সম্পূর্ণই ব্যতিক্রম। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, আরবেরাই ভারতের প্রাচীনতম মুসলিম আগমনকারী। (৭৫১-৬২৩ খ্রিঃ) আরবের মালাবার উপকূলের ‘চেরুমান পেরমল’ নামক জনৈক হিন্দু প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং গোপনে হজরত মুহম্মদকে (সা.) দর্শন করবার জন্য মক্কায় যান। ভারতের সাথে মুসলিম সম্বন্ধের প্রাচীনতম কিংবদন্তিভিত্তিক ইতিহাস এইরূপ। এই সম্বন্ধ পশ্চিমা বিশ্বের মতো যুদ্ধ-বিগ্রহের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বলে রক্তে কলঙ্কিত নয়। ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ইতিহাস, শান্তি প্রবর্তনেরই ইতিহাস। এই ইতিহাস নর শ্রেণিতে কলঙ্কিত নয়।

মুসলমানরা ইসলামের সাম্যের বাণী নিয়ে মানবতার জয়গান গেয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ভারতীয়রা এই প্রথম শুনলো, “মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষমতা, রাজপথ ও জীবন-জীবিকা মানুষকে মানুষ হইতে পৃথক উত্তম অথবা অধম করিয়া তুলিতে পারে না। সকল মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি, এক আল্লাহ অনন্ত-শক্তির আধার, তাঁহারই ইচ্ছা ও ইঙ্গিতেই সমস্ত সৃষ্টি হইয়াছে, হইতেছে ও হইবে।”

Advertisement

ভারতে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতার অনুধ্যানে ও ভারতের বর্ণ-হিন্দু ইসলামের বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের বাণী শুনে ভারতীয় সনাতন হিন্দু-ধর্মের পাশে অর্বাচীন ইসলাম ধর্ম সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। পুরোহিত শ্রেণী অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বিদ্যান ও বুদ্ধিজীবী ভারতীয়রা ইসলামের আল্লাহকে ভারতের সনাতন-ধর্মে স্থান দিবার জন্য খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে “অল্পোপনিষদ” নামে এক নতুন উপনিষদ রচিত হলো। এতে আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষ (রসূল) হজরত মুহম্মদ (দ.) এর মহিমা পরিকীর্তিত হয়েছে। ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয়রা নতুন করে বেদ বেদান্ত চর্চায় মনোনিবেশ করে, মূর্তিপূজা প্রবল হয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতা ঢুকে পড়ে। ভারতের সাধু সন্ন্যাসীরা পাতঞ্জল মুনির যোগ সাধনা নিয়ে সূফী সাধকের মোকাবেলা করেছিলেন। ফলে মুসলমান সূফীরা হিন্দু-শিষ্য এবং হিন্দু-সন্ন্যাসীর মুসলমান চেলা দেখতে পাওয়া যায়। এই কারণেই সাধনার ক্ষেত্রে ভাবের বিনিময়ের দ্বারা ভারতীয় সংস্কৃতি যেই বিশিষ্ট্য ঐশ্বর্যময় রূপ গ্রহণ করেছে, তা অল্প কথায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

এই সময়ে ভারতীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলায়ও যুগান্তর উপস্থিত হয়। ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গীতবিদ্যা ও যন্ত্র ভারতে নতুন রূপ গ্রহণ করে। ফলে ভারতীয় রাগরাগিণীর পাশাপাশি মুসলমানদের গজল, কাওয়ালী, দাদরা, খেয়াল প্রভৃতি মিলে গেল। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র জগতে মুসলমানদের তবলা, রবার, সেতার, নাকারা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রও স্থান পেলো। ধীরে ধীরে ঠুমরী, টপ্পা, জৌনপুরী, আশাবরী প্রভৃতি নানা মিশ্র রাগিণীর উদ্ভবে ভারতীয় সঙ্গীতে যুগান্তর উপস্থিত হলো। ফলে মিসর, ইরান, তুরান, তুর্কিস্থান প্রভৃতি দেশে মুসলিম সংস্কৃতি দেশীয় সংস্কৃতিকে একেবারেই গ্রাস করলেও ভারতে তা ঘটেনি। উভয় সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটাতে বরং ভারতীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মুসলমান জনসংখ্যা ১৪৬ মিলিয়ন, ভারতে ১৭২ মিলিয়ন। সংখ্যায় ভারতীয় মুসলমান সারা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তর মুসলিম জাতি এবং ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। সুতরাং বোঝা কঠিন নয় যে রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলের যাঁতাকলে না পড়লে ঈদের এই আনন্দ কেবল বাংলাদেশেই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ধুমধামের সাথে, শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপিত হয়। ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উদযাপন। আর মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময়। সুতরাং ঈদ মোবারকের অর্থ হল ঈদ বা আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক। ঈদ মোবারক একটি ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য যা বলে মুসলমানরা ঈদের দিন পরস্পরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকে। ঈদ সকল শ্রেণির মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে, গড়ে তোলে সবার মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ঐক্যের মেলবন্ধন। অবশ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এই বাক্যটি আর কেবল মুসলমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। উৎসব মানেই আনন্দ, আনন্দ মানেই এক অন্তিম পবিত্র স্বর্গীয় অনুভূতি যেখানে সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের অবাধ অংশীদারিত্ব থাকে।

অবাধ, ঐশ্বর্যময় শৈশবের প্রতিবিন্দু উচ্ছ্বাসের ষোলআনা উসুলের একদিন এই ঈদের দিন। সকাল থেকে রাত অবধি অপার আনন্দে ডুবে থাকি আমরা পরিবার-প্রিয়জনের বন্ধনডোরে। বছরজুড়ে নানা হতাশার ডাক, প্রতিকূলতা, দুঃখ-কষ্ট, বেদনা সব ভুলে ঈদের দিনে আমরা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হই। পেছনের সব গ্লানি বিস্মৃত হয়ে ঈদের দিন ঈদের নতুন চাঁদ দেখামাত্রই রেডিও-টিভি ও পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্তা ‘ঈদ মোবারক’। সেই সঙ্গে চারদিকে শোনা যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রোজার ঈদের গান, “ও মন, রমজানের ঐ, রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ।/ তুই আপনারে আজ, বিলিয়ে দে শোন, আসমানি তাগিদ।”

Advertisement

ঈদ মানে ভালোবাসা, উৎসব, ক্ষমা, মিলন। মনে পড়ে শৈশবের চাঁদরাতে আমরা আড়ি নেয়া বন্ধুদের সাথে ভাব করতাম মধ্যমা আঙুলের মিলনের মাধ্যমে। আড়ি নেয়া হয় সাধারণত কনিষ্ঠার মিলনের মাধ্যমে। আমরা প্রতীক্ষায় থাকতাম চাঁদরাতের, আমাদের অতি কাছের, প্রাণের সঙ্গীটির সঙ্গে আবার পূর্বের মতো ভাব করতে। ঈদের দিন যেন কেবল ক্ষমা করার দিন। ক্ষমা, সম্মান, আদর, ভালোবাসায় বিশেষ দিনক্ষণ বিবেচনা করতে হয় না। যিনি ক্ষমা করেন, সম্মান করেন, ভালোবাসেন তিনি বিচার করেন না। নির্বিশেষে, নির্বিচারেই তিনি ক্ষমা করেন। ক্ষমা করা তাঁর স্বভাব, ক্ষমা না করে তিনি পারেন না বলেই ক্ষমা করেন।

তাঁর কাছে অপরাধের কোন পরিমাণ, পরিমাপ বা ধরন নেই। তাই অপরাধ কতটা গুরুতর হলে ক্ষমার অযোগ্য এবং কতটা লঘু হলে ক্ষমার যোগ্য তাঁর কাছে তা বিচার্য নয়। এর বিচার করেন আদালতের বিচারক, মানুষকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, রাষ্ট্রীয় বিধিতে অপরাধীকে দণ্ডায়মান করেন তিনি। তাঁর সে বিচারের সাথে মননের, আত্মার মিলন হয় না। তিনি ভালোবাসেন না, কর্তব্য করেন মাত্র। অথচ স্মৃতি নিংড়ে শৈশবের সেই রাতের কথা স্মরণ করতেই মনে হয়, কতো সহজেই সেই চাঁদরাতের স্বচ্ছ সলিল জোছনার নির্মলতায় আমাদের সকলের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভেদের সব কালিমা যেন কেমন ধুয়ে-মুছে যেতো। ঈদের দিন রাষ্ট্রীয় সকল কার্যকলাপ বন্ধ থাকে, আর সেই সুবাদে বিচারক ও সেদিন উৎসবে মেতে উঠেন তাঁর প্রিয়জনদের সাথে। এখানে তিনি নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিতে পারেন সকলকে।

শহরের আর গ্রামের ঈদের চিত্রটা একটু ভিন্ন। গ্রামের আর শহরের ঈদের মধ্যে তফাৎ আছ। শহরের ধনীরা কর্ম-ব্যস্ততা, ধন-মান, যান্ত্রিকতার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকে। ভোগ-বিলাসের পরিণতিতে পরিবার-পরিজন আর আত্মীয়তার বন্ধনগুলোকে যে তারা কখন, কীভাবে ছিন্ন কওে ফেলেছে তা উপলব্ধি করার সময়টুকুও পায় না।

পক্ষান্তরে গ্রামের সহজ সরল সতেজ মনা মানুষগুলো এখনো আপনজনদের সান্নিধ্যের জন্য শুধু ঈদে নয় সারাটা বছর এক নিঃসীম প্রত্যয়ের সাথে দিন গুনতে থাকে। আত্মার অন্তিম টানে ছুটে যায় ইট-পাথরের শহর ছেড়ে ছেলে মেয়ে স্বজনরা। একটা প্রতিশ্রুতি ওদের দু’চোখজুড়ে থাকে, ফিরে পাব আজ ঘরে, মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রতিবেশী ও প্রিয়জনদের। অবারিত সবুজ শ্যামল গাঁ যেন আনন্দে আন্দোলিত হয়ে নিজের প্রাকৃতিক রূপ ও লাবণ্যকে আরো বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই গাঁয়ে হাসি উল্লাসে মেতে, ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে যায় শত্রু বন্ধু নতুন উল্লাসে। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদীরগর্ভে জন্মেছে বাংলাদেশের কতো গ্রাম। কতো নদী প্রতি বছর তার সগৌরব যৌবন নিয়ে দাবড়ে বেরিয়েছে গ্রামগুলোকে। তবু কিন্তু নদীর মায়া কাটাতে পারেনি বাঙালি। নদীর সঙ্গে গ্রামের, বাঙালির বিচ্ছেদ ঘটেনি আজও। সেই পলিমাটির উর্বরা প্লাবনেই ফসলে ভরে গেছে এইসব চরাঞ্চল। আবার নদী যখন বিরূপ হয়েছে তখন ভিটে-মাটি-জমি-জিরেত-বিদ্যালয়-গোরস্থান-ঈদগাহ-মসজিদ-মন্দির কিচ্ছু থাকেনি।

বর্তমানে সারা বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লক্ষ উদ্বাস্তু আছেন। তার ওপর প্রতিদিনই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকায় এসে বস্তি গড়ছে মানুষ৷ সচ্ছল কৃষকও হয়ে যাচ্ছেন বেকার। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, আগামীতে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে। বাধ্য হবে অভিবাসী বা উদ্বাস্তু হতে৷ আমরাকি একবারো ভাবি যে, মানুষ হিসাবে আমাদের সকলের মতো এইসব উদ্বাস্তুদের ও ঈদের আনন্দে শামিল হবার অধিকার আছে?

পদ্মার ভাঙনে আরো অনেক কিছুর মতো যে এমন কতো উদ্বাস্তুও শৈশব স্মৃতিতাড়ানিয়া ঈদগাহটিও হারিয়ে গেছে তা কে জানে! যেখানে ওদের ঘর ছিলো, পরিবার ছিলো, খেলার উঠোন ছিলো, স্কুল ছিলো, বাজার ছিলো সেখানে চারদিকে আজ অথৈ মেঘনার ঘোলা জল। আবার কোথাও হয়তো এখনো টিকে আছে মাঝে মাঝে কেবল মাথা তোলা জেলে কৃষকদের বাড়িগুলো। উজান থেকে আসা জোয়ারের অযাচিত জল পুরো চরকে মিনি সমুদ্রে পরিণত করে রেখেছে। সূর্য ওঠার সাথেই নৌকো ভিড়ানো। শন-খড়ের ছাউনি আর হোগলা পাতার বেড়া দেয়া জেলেদের ঘরগুলি। চারদিকে খোলা কেবল বেশ কটি কলা আর মাদার গাছ লাগানো। এক চিলতে উঠোন, যা ঘিওে রেখেছে চরের নল খাগড়া জাতীয় তৃণঘাস।

এভাবে বহমান মেঘনার বুকে জেগে আছে আরো কতো চর। চারপাশে জলরাশির মাঝে যেন সবুজ প্রকৃতি আর প্রাণের সন্ধি। ফুলে ফুলে মৌমাছি নতুন ধানের সবুজ চারার মাঝে সাদা বকের বিচরণ আর শাপলা শালুকের সাথেই এখানে মিশে আছে কতো উদ্বাস্তুও শৈশব। স্কুল ছুটির দিনে হয়তো এদের অনেকেই নেমে পড়তো কাদা জলে। মেঘনার জলের স্বচ্ছতায় ধুয়ে যেতো এদের জীবনের সকল দরিদ্রতা, অন্তরের সকল কালিমা।

"এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁয়ে/ নির্ভয় নীলাকাশ রয়েছে নুয়ে/ যেন হৃদয়ের ভালোবাসা হৃদয়ে ফুটে।/ এই আমার দেশ, এই আমার প্রেম/ আনন্দ বেদনায়, মিলন বিরহ সংকটে।/এই পদ্মা, এই মেঘনা,/ এই যমুনা সুরমা নদী তটে।"

মৌসুমের শুরুতেই চর এলাকাগুলোতে নদীর পাড় ভাঙ্গতে শুরু করে। ভাঙ্গনের হাত থেকে রেহাই পেতে অনেকেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন ঘরবাড়ি, সহায় সম্বল। পানি বাড়ার সাথে ক্রমেই বাড়ে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা। প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে ফসলী জমি, বসতভিটা ও গাছপালা। এতে ভাঙ্গন আতঙ্কে দিন কাটাছেন দরিদ্র কৃষিজীবী পদ্মা পাড়ের মানুষেরা। এভাবেই এলাকার প্রায় বসতভিটা বিলীন হয়ে যায়।

ওরস পূজা-পার্বনে উৎসবের মতো ঈদের আনন্দের রং কি ছড়ানো উচিত নয় এইসব গ্রামেও? এই চরাঞ্চলের শিশুরাও কি ঈদের নতুন জামা-কাপড় পরে আনন্দে আর উল্লাসে মেতে তাদের ঈদগাহ মেলায় সমবেত হবার অধিকার নিয়ে জন্মায়নি এই পৃথিবীতে? কেন ক্ষণিকের সুখটুকু নিয়েও ওদের ফিরে যেতে হয় সেই অনিশ্চিত জীবনে, যেখানে পরতে পরতে হারানোর গল্প! যেখানে স্বপ্নরা বাস করে নদীর ওপারে, শহরে। বসতভিটা হারিয়ে পাঁচ মাস হলো অন্যের জায়গায় মাথা গোজার ঠাঁই মিলেছে আমেনা খাতুনের। এখন সংগ্রাম কেবল টিকে থাকার। মেঘনার ভাঙ্গন কেড়ে নিয়ে গেছে তারমতো এক সময়ের সম্ভ্রান্তদের। একই আতঙ্কে মেঘনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কাশেম আলী। তার বাড়িটি যে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙ্গনের ওপরে। ঈদের এই কৃত্রিম চাকচিক্যময়তা আর অর্থ অপচয় আর বিলাসিতার ফাঁকে কি আমাদের কারো একবারো মনে পড়বে আমেনা খাতুন আর কাশেম আলীর জীবন সংগ্রামের কথা? রাস্তা নেই বিদ্যুৎ নেই, নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা। এমনকি বাজার সদাই এর জন্য মেঘনা পার হয়ে যেতে হয় তাদের। উন্নত জীবনতো মেঘনার ওপারে। কেবল উন্নত মননের মানুষেরাই বুঝি আজ আর নেই এপারওপার কোন পারেই!

গ্রীষ্ম, শীত, বর্ষা কিংবা শরৎ, সব ঋতুতেই পদ্মা নদীকে ঘিরে মানুষের আনাগোনা। গ্রীষ্মে শুকিয়ে কাঠ পদ্মা আর বর্ষায় জলে টইটুম্বুর সব সময় মানুষকে কাছে টানে। সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে খানিক রাত অবধি পদ্মা নদীর কূলে মানুষের আনাগোনা। জলরাশির পাশে খানিকটা আনন্দেও ঢেউ। শান্তির সুবাতাস। আর ভরা পদ্মার নৈসর্গিক রূপে মানুষের টান থাকে সর্বক্ষণ। সারাদিন হৈ চৈ, আনন্দে মাতামাতি, ছোট ছোট নৌকায় পাড়ি দেওয়া এসব নিয়ে এখন মুখরিত পদ্মা নদীর পাড়। নদীর প্রবহমান জোয়ার, কলতান, মাঝিদের গান সবই আজ অতীত হলেও নদীর কূলে তখন তবু মানুষের বসবাস। রাতের আঁধারে বাতির আলোয় আরো ফুটে ওঠে নদী কূলের অন্য আরেক রূপ।

এবারের ঈদে সবার বিলাসী জীবনে রইল গ্রাম বাংলার স্নিগ্ধ নিমন্ত্রণ। আমরাকি এই যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে একবার ও দেখার চেষ্টা করতে পারিনা গ্রামের মানুষগুলোর মায়া মমতার রূপ? গাঁয়ের স্নিগ্ধ শীতল বিজন পথের একটু সতেজ হাওয়া কি পারবে আমাদের মানবতাকে আবার নতুন করে জাগ্রত করতে? একটু মায়ার বন্ধন, কিছুটা মনুষ্যত্বের ডাক, ধরণীর প্রতি কিছু দায়িত্ব পালন যে সকলের আজ বড় বেশি প্রয়োজন। আজকের এই প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ঈদের হাসি খুশি আর গান কেবল ধনীকে নয়, ভরিয়ে দিক গরিব, দুঃখী, অসহায়, সম্বলহীনা সকলের মন প্রাণকে। ধনীর অভিলাষী চিত্তের পাশাপাশি ঈদের আনন্দে মেতে উঠুক প্রতিটি উদ্বাস্তুর পবিত্র হৃদয়ের অবিনশ্বরতা।

লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

এইচআর/পিআর