দেশজুড়ে

দৃষ্টিহীন রফিকুলের সাফল্য

দৃষ্টিহীনতা আটকাতে পারেনি রফিকুলের অগ্রযাত্রাকে। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে লড়াই করে গেছেন অন্ধত্বের সঙ্গে। তার ফল পেতেও দেরি হয়নি। নিরলস প্রচেষ্টা, অধ্যাবসায় আর একাগ্রতার কারণে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আজ তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।

Advertisement

অথচ এই পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সময়ই লক্ষ্য করেছিলেন অন্যান্যদের চেয়ে তিনি চোখে কম দেখেন। এভাবেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী তখনই ঘটল জীবনের সবচেয়ে করুণ পরিণতি। প্রি-টেস্ট পরীক্ষা দেয়ার পর চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপের টাকা জমা দিয়েছেন। হঠাৎ বুঝতে পারলেন তার চোখের আলো ক্ষীণ হয়ে গেছে। পরীক্ষা যখন দোরগোড়ায় তখন একেবারে দৃষ্টিহীন তিনি। ফলে পরীক্ষা দেয়া আর হলো না।

পুরো জীবনটাই যেন ঢেকে গেল অন্ধকারে। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা পারিবারিক কাজের মধ্য দিয়ে তাকে নতুনভাবে বেঁচে থাকার পরামর্শ দিলেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় রফিকুল প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে আজ একজন প্রতিষ্ঠিত সফল প্লাস্টিক ব্যবসায়ী।

কুড়িগ্রাম ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কারখানার (বিসিকে) তার ফ্যাক্টরিতে এখন ২০ জন শ্রমিক কাজ করছে। মাসে গড় আয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয়ের পরও ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। ব্যবসার পরিসর বাড়ানোর জন্য আরো টাকা দরকার। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যবসায়ীদের লোন দিতে অনিহা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকে ধরণা দিয়েও সফল হতে পারেননি তিনি।

Advertisement

ঢাকার বিক্রমপুরের লৌহজং থানার শিমুলিয়া গ্রামে তার বাড়ি। ১৯৮০ সালে জন্ম। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট রফিকুল। বাবা মৃত আব্দুস সাত্তার ছিলেন একজন কাপড় ব্যবসায়ী। জন্ম থেকেই চোখে ঝাপসা দেখতেন রফিকুল। পরিবারের লোকজন ডাক্তারও দেখিয়েছিল। কিন্তু এই ভাল তো; এই খারাপ।

এভাবে মেজ ভাইয়ের ব্যবসার সূত্রে যশোরে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সম্মিলনি ইনস্টিটিউটে লেখাপড়া শুরু। লেখাপড়া ও ভাইয়ের প্লাস্টিক কারখানায় কাজ নিয়ে মগ্ন ছিলেন তিনি। কিন্তু এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষার সময় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান। হতাশ রফিকুল ফিরে যান শিমুলিয়ায়। ১৯৯৭ সালে বড় ভাই শহিদুল ইসলাম রফিকুলকে লালমনিরহাটে নিয়ে আসেন। লালমনিরহাট বিসিকে তার ছিল প্লাস্টিক কারখানা। সেখানে বদনা ও সুতা তৈরি করা হত। সে কাজে যুক্ত হন রফিকুল।

শ্রমিকদের কাজ দেখাশুনা করার পাশাপাশি নিজেও মেশিনে বসে কাজ করেন। এখানে ৭/৮ বছর কাজ করার পর নিজে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন। কুড়িগ্রাম বিসিকে বড় ভাইয়ের ২১ শতক জমির একটা প্লট ছিল। সেখানে নিজেই প্লাস্টিক পণ্যের কাজ শুরু করেন রফিকুল।

২০১৩ সালে মেজ ভাই হামিদুল ইসলাম ব্যবসার জন্য তাকে ৫ লাখ টাকা পুঁজি দেন। সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে বড় ভাইয়ের প্লটটি কিনে নেন রফিকুল। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ভাংড়ি দোকান থেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল কিনে সেসব ঢালাইয়ের মাধ্যমে চিপস করে ঢাকায় বিক্রি করেন। এসব চিপস দিয়েই তৈরি করা হয় প্লান্টিকের জগ, গ্লাস, বালতিসহ নানান পণ্য।

Advertisement

ব্যক্তিগত জীবনে রফিকুলের বড় ছেলে সাজ্জাদ ৬ষ্ঠ শ্রেণি ও ছোট ছেলে শিফাত ২য় শ্রেণির ছাত্র।

রফিকুলের কারখানায় কর্মরত শ্রমিক লক্ষণ, মাঈদুল ও আব্দুর রশিদ বলেন, হামার মালিক অন্ধ হইলেও খুব ভালো মানুষ। হামার সঙ্গে সমানতালে কাটিং, ঢালাই ও ডাট মেশিনোত কাজ করে। বেতন কখনো বাকি রাখে না। এ কারখানায় ৫ থাকি ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনে লোকজন কাম করে।

তবে রফিকুল দুঃখ করে বলেন, আমার প্রতিবন্ধকতার কারণে কোনো ব্যাংক আমাকে সিসি লোন দিতে চায় না। উত্তরা ব্যাংকে অনেক ঘুরেছি, তারা সিসি দিতে রাজি হলো না। অথচ এই ব্যবসা ভালভাবে পরিচালনা করতে হলে আমার ৩০ লাখ টাকা প্রয়োজন। বর্তমানে আমার কাছে রয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা। সীমিত টাকায় ব্যবসা করছি। টাকা পেলে ব্যবসায় আরো উৎপাদন বাড়াতে পারতাম।

কুড়িগ্রাম ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কারখানার উপ-ব্যবস্থাপক মকবুল হোসেন জানান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিকুল নিজের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আজ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তার পাশে ব্যাংকগুলো সহায়তার হাত বাড়ালে সে ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

এফএ/পিআর