মতামত

চিরকালীন আক্ষেপ

কবির আকাঙ্ক্ষায় ‘আজি পূর্ণ কৃতার্থ এ জীবন/মোর মাঝে কোন দৈন্য, শূন্য নাই’ কিন্তু মাটির পৃথিবীতে রক্ত মাংসের মানুষের পূর্ণ তৃপ্তিতে বোধকরি আপত্তি প্রকৃতির। এমনকি সাধনায় সিদ্ধ হওয়া মানুষকেও পূর্ণ প্রাপ্তির ছুঁই ছুঁই দূরত্বকেই মেনে নিতে হয় নিয়তির অমোঘ বিধান হিসেবে। আর চিরকালীন আক্ষেপের আখ্যানগুলো থেকে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে।

Advertisement

রক্ত মাংসের মানুষের অর্জন যে শতভাগ পূর্ণতা পেতে পারে না তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত মহাভারতের সর্বজয়ী বীর অর্জুন। ভারত পুরানের বড় অংশজুড়েই অর্জুন বীরত্ব গাথা। কৃষ্ণের প্রিয় সখা। কিন্তু কৃষ্ণ দেবতা আর অর্জুন যে মানুষ শেষ পর্যন্ত এই পার্থক্য থেকেই যায়। আর তাইতো শততম যুদ্ধে দেখা যায় এক অচেনা অর্জুনকে। নিজের শততম যুদ্ধে কোনো কিছুই ঠিকঠাক করতে পারেননি অর্জুন। ভুলে গেলেন অস্ত্র-শস্ত্রের নাম। একটা পর্যায়ে দিশেহারা অর্জুনের হাত থেকে খসে পড়ল তার সেই প্রাণপ্রিয় গাণ্ডিব (অর্জুনের ধনুক)। পরাজয় বরণ ঘটল মহাভারতের মহাবীরের। অর্জুনের শততম যুদ্ধ হয়ে থাকল এক চিরন্তন আক্ষেপের উপাখ্যান।

নিয়তির খেলায় যুগ যুগ ধরে চিরন্তন আক্ষেপের সবচেয়ে বেশি গল্প বোধকরি খেলার মাঠে। আর যে কারণে বিশ্বকাপ ফুটবলে বারবার মারাকানা ট্র্যাজেডি ঘটে ব্রাজিলের ভাগ্যে। জীবনের শেষ ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়ে যান ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের সমার্থক হয়ে ওঠা স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ফ্রেঞ্চ ওপেন শিরোপা অধরা রেখেই ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হয় কিংবদন্তি টেনিস তারকা পিট সাম্প্রাসকে। গত আড়াই দশকের ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত শক্তি হয়েও বিশ্বকাপ ফাইনালের নাগাল পায় না দক্ষিণ আফ্রিকা।

তিন তিনবার ফাইনাল খেলেও বিশ্বকাপ ফুটবল শিরোপার স্বাদ পায়নি টোটাল ফুটবলের দেশ নেদারল্যান্ডস। বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের সেরা দলগুলোর বেশির ভাগই পূরণ করতে পারেনি শিরোপা স্বপ্ন। ঘরের মাঠে জীবনের শেষ টেস্টে হারের গ্লানি নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় সুনীল গাভাস্কারকে। জীবনের শেষ টেস্টে পরাজয় সঙ্গী হয় ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডসের।

Advertisement

ভারতের বিপক্ষে শ্রেয়তর রেকর্ডের পরও বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোন ফরম্যাটেই আজ অবধি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাতে পারেনি পাকিস্তান। ক্রিকেটে জয় আর অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ সমার্থক। কিন্তু ভারত জয়ের আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়েই ক্রিকেটকে গুডবাই জানাতে হয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহকে। খেলার মাঠকে ঘিরে আছে এমনি হাজারও চিরকালীন আক্ষেপ আর ট্র্যাজেডির গল্প।

স্যার ডন ব্রাডম্যান ও ৪ রানের দুঃখগাথাক্রিকেটে ব্যাটিং আর স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান এ দুটো নাম কখনোই আলাদা হওয়ার নয়। ৫২ টেস্টে ৬৯৯৬ রান। গড় ৯৯.৯৪। অমরত্বের জন্য আর কি চাই? এমন যে স্যার ডন তিনিও পাননি পূর্ণতার স্বাদ। জীবনের শেষ ইনিংসে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান প্রমাণ করে দিলেন তিনিও রক্ত মাংসে গড়া মানুষই।

টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে ১০০ গড় নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করার সহজতম বাধাটুকুও পেরোতে পারেননি স্যার ডন। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় গর্বের এই অর্জনের জন্য শেষ টেস্টে মাত্র ৪ রান প্রয়োজন ছিল এই ব্যাটিং সম্রাটের। ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই সিরিজে প্রথম চার টেস্টের ৮ ইনিংসে ৫০৮ রান সংগ্রহ করলেন স্যার ডন। লন্ডনের কেনসিংটন ওভালে জীবনের শেষ টেস্টে খেলতে নামলেন এই ব্যাটিং বিস্ময়। স্যার ডন তার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে ক্রিকেটকে নতুন কি উপহার দেবেন তারই অপেক্ষায় গোটা ক্রিকেট দুনিয়া। বড় বিস্ময়ই উপহার দিলেন ব্যাটিং সম্রাট! বোলার এরিক হলিজ। লেগ স্পিনার। সাদামাটা ক্যারিয়ার। কিন্তু এই নামটি স্থায়ী হয়ে গেল ক্রিকেটে। স্যার ডনকে ফেরালেন শূন্য হাতে।

ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে মাত্র দুই বল উইকেটে টিকলেন স্যার ডন। প্রথম বল থেকে রান পেলেন না। দ্বিতীয় বলেই হলিজের বলে হয়ে গেলেন বোল্ড। স্যার ডনের নামের পাশে ০! ইংল্যান্ড ইনিংস ব্যবধানে হেরে যাওয়ায় দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেলেন না স্যার ডন। যতদিন ক্রিকেট থাকবে ততদিন স্যার ডনের এই ৪ রানের আক্ষেপ বয়ে বেড়াতে হবে ক্রিকেট পিয়াসীদের।

Advertisement

ব্রাজিলের ঐতিহাসিক ক্ষত মারাকানা ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। সর্বাধিকবার বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্বও তাদের। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা ফুটবলারদের সুতিকাগারও ব্রাজিল। এত কিছুর পরও ব্রাজিলিয়ানদের জন্য এক চিরন্তন হাহাকারের নাম তাদের ফুটবলের তীর্থক্ষেত্র মারাকানা স্টেডিয়াম। ১৯৫০ সালের দীর্ঘশ্বাস ২০১৪ সালেও দূর করতে পারল না ব্রাজিল।

১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে হট ফেভারিট হিসেবেই শুরু করল স্বাগতিক ব্রাজিল। ওই আসরে বাইলজে আলাদাভাবে কোন ফাইনাল ম্যাচ ছিল না। সর্বোচ্চ পয়েন্টের ভিত্তিতে শিরোপা নির্ধারণ করা হয়। তবে মারাকানার শেষ ম্যাচটি হয়ে ওঠে অলিখিত ফাইনাল। স্বাগতিক ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ আরেক ল্যাটিন শক্তি উরুগুয়ে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ব্রাজিলের প্রয়োজন ছিল শুধু ড্র। আর উরুগুয়ের জয়। শিরোপা উৎসব করার জন্য পুরো ব্রাজিল প্রস্তুত। তিল ধারণের ঠাঁই নাই মারাকানা স্টেডিয়ামে। সব হিসাব-নিকাশ পরে ব্রাজিলের স্বপ্ন চূর্ণ করে ২-১ গোলে ম্যাচ জিতল উরুগুয়ে। এই সুবাদে চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। মারাকানায় তখন বৈধ্যভূমির নীরবতা। অধিক শোকে পাথর দর্শকঠাসা গ্যালারি। শোক সামলাতে না পেরে গ্যালারি থেকে লাফিয়ে পড়লেন অনেক দর্শক। মারাও গেলেন বেশ কয়েকজন।

মারাকানা ট্র্যাজেডির ৬৪ বছর পর ২০১৪ সালে আবার বিশ্বকাপের আয়োজক হল ব্রাজিল। শাপমুক্তি ঘটবে আশায় বুক বাঁধল ব্রাজিল ভক্তরা। সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল স্বাগতিকরা। আর মাত্র দুটো ধাপ! কিন্তু যা ঘটল তা হার মানাল ১৯৫০-এর ট্র্যাজেডিকেও। মারাকানা স্টেডিয়ামে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলে হারের লজ্জায় ডুবল পাঁচবারের বিশ্ববিজয়ীরা। বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে এত বড় লজ্জা আর কখনও পেতে হয়নি ব্রাজিলকে। আর মারাকানার সঙ্গে যেন স্থায়ী হয়ে গেল ব্রাজিলের দুর্ভাগ্যও!

ফুটবল ইতিহাসের আলোচিত দলগুলোর ট্র্যাজেডির শেষ কোথায়?বলা হয়ে থাকে পেলের সময় (১৯৫৮-’৬২-’৭০) আর ২০০২ সালের ব্রাজিল এবং ২০০৬ এর স্পেন ছাড়া বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা দলগুলো কখনও বিশ্বকাপ জেতেনি। বিশেষ করে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত দলগুলোকে বেশিরভাগ সময়ই ফিরতে হয়েছে ট্রফি ছাড়াই। পেলে-গারিঞ্চা-ভাভাদের যুগ শুরুর আগে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত দলটির নাম হাঙ্গেরি। পুসকাস-ককসিস-হিদেকুটি এক একটা নাম নয়, এক একটা উপাখ্যান। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির বাইরে কেউ শিরোপা জিতবে এমনটা ভাবাই সম্ভব ছিল না কারও পক্ষে।

গ্রুপ পর্বে শক্তিশালী পশ্চিম জার্মানিকে হাঙ্গেরি হারাল ৮-৩ গোলের ব্যবধানে। ফাইনালে তাদের মুখোমুখি হল জার্মানরাই। একটা অসম ফাইনালের অপেক্ষায় ফুটবলপ্রেমীরা। কিন্তু সব সমীকরণ পাল্টে দিল জার্মানরা। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলটিকে হারিয়ে দিল ৩-২ গোলের ব্যবধানে।

১৯৭৪ ও ১৯৭৮ এর বিশ্বকাপে হুয়ান ক্রুয়েফের নেদারল্যান্ডস দলের জন্য বোধকরি কোন সান্ত্বনাই যথেষ্ট নয়। ওই সময়টাতে টোটাল ফুটবলের ছোঁয়ায় ফুটবলকে বদলে দিয়েছিল ডাচরাই। আর দলটিতে ছিলেন আধুনিক ফুটবলকে সার্থক করে তোলা নাম ক্রুয়েফ। চোখ ধাঁধাঁনো ফুটবল উপহার দিয়ে ফাইনালেও উঠল নেদারল্যান্ডস। কিন্তু টোটাল ফুটবলের দেশকে ফাইনালে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করে নিল জার্মানরা। ১৯৮২ ও ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপে সেমিফাইনালেরই নাগাল পায়নি জিকো-সক্রেটিসসমৃদ্ধ ব্রাজিল।

ঘাস যখন লেন্ডলের গলার ফাঁসগ্রান্ড স্লাম জিতেছেন আট আটটি। কিন্তু সবুজ ঘাসের উম্বলডন বারবার ধোকা দিয়েছে কিংবদন্তির টেনিস তারকা ইভান লেন্ডলকে। দু-দুবার ফাইনালে উঠেও রানারআপ ট্রফি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে এই টেনিস কিংবদন্তিকে। উইম্বলডন জেতার জন্য জীবন পণ করলেন লেন্ডল। আলাদাভাবে ঘাসের কোট করলেন নিজের বাড়িতে। সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ঘাসের রহস্য উন্মোচন করার জন্য তৈরি করলেন নিজেকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উইম্বলডন থেকে গেছে লেন্ডলের স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা হয়েই। মনের দুঃখে একবার তাই এই টেনিস কিংবদন্তি বলেছিলেন’ Grasses are for cows.(ঘাস গরুর জন্য)’। ঘাসের প্রতারণার(!) কথা লেন্ডলর পক্ষে কীভাবে বিস্মৃত হওয়া সম্ভব?

সাম্প্রাসের শৌর্য বীর্য রোলাঁ গাঁরোর লাল দুর্গে সমর্পিতক্যারিয়ারে গ্রান্ড স্লাম জিতেছেন ১৪ বার। একটা সময়ে পুরুষ এককে সবচেয়ে বেশি গ্রান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ডটিও ছিল তারই। তার রেকর্ড ভেঙেই সবচেয়ে বেশি গ্রান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ডটি নিজের করে রেখেছেন রজার ফেদেরার। তারপরও পুরোপুরি নিরাবেগ ইস্পাত মানসিকতার সাম্প্রাসকে বারবার আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে রোলাঁ গাঁরোর লাল দুর্গে।

উম্বলডনে সাম্প্রাস শিরোপা জেতেন সাত সাত বার। তার নামের সঙ্গে স্থায়ী হয়ে যায় ‘ঘাসের রাজা’ উপাধি। কিন্তু কাদামাটির ফ্রেঞ্চ ওপেনে সাম্প্রাস শুধুই নিজের নামের ভার! রোলাঁ গাঁরোর লাল দুর্গে শিরোপা জয় তো অনেক দূরের ব্যাপার কোনোদিন নাগাল পাননি ফাইনালেরই। ক্যারিয়ারজুড়ে মাত্র একবারই পেরোতে পেরেছিলেন শেষ আটের বাধা। ক্লে কোর্টে ১৯৯৬ সালে ওই একবারই খেলেছেন সেমিফাইনাল। লাল মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতেই ক্যারিয়ারের ইতি টানেন সাম্প্রাস।

ভারতের রহস্য ভেদ করতে পারেননি স্টিভ ওয়াহক্রিকেটে নেতৃত্ব আর স্টিভ ওয়াহ হয়ে ওঠেন সমার্থক। ওয়েস্টইন্ডিজ অধিনায়ক কার্ল হুপার বলেছিলেন এক মজার কথা। ওই সময় ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের দুর্দশা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কার্ল হুপার জানান, ‘স্টিভ ওয়াহ নেতৃত্ব দিলেও এই ওয়েস্টইন্ডিজকে জেতাতে পারবেন না।’ অস্ট্রেলিয়াকে এক অজেয় দলে পরিণত করেন অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। ওই সময় একটা প্রতিস্থিত হয়ে গিয়েছিল যে, ‘স্টিভের অস্ট্রেলিয়াকে কে হারাবে?’

স্টিভ ওয়াহর সময়ে অস্ট্রেলিয়া কতটা ভয়ঙ্কর ছিল সেটা অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। ধরা যাক ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপের কথাই। ফাইনালে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারাল অস্ট্রেলিয়া। ওই ম্যাচের পর ১৯৯২ এর বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খানের ভাষ্য ছিল, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল দুটো অস্ট্রেলিয়া দল যদি বিশ্বকাপে অংশ নিত তাহলেও ফাইনাল হত অল অস্ট্রেলিয়ান।’ বিপক্ষ দলগুলোকে নিয়ে ইচ্ছাপূরণের খেলায় মেতে উঠতেন স্টিভ ওয়াহরা। কিন্তু ভারত রহস্যই থেকে গেছে এই স্টিভ ওয়াহর কাছে। বারবার পথ হারিয়েছেন ভারত সফরে। কখনোই ভারতের মাটি থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফিরতে পারেননি কিংবদন্তির এই অধিনায়ক।

২০০১ সালে ভারত জয়ের দোড়গোড়ায় পৌঁছে যায় স্টিভ বাহিনী। তিন টেস্টের সিরিজে প্রথম টেস্ট ১০ উইকেটে জিতে সফরকারীরা এগিয়ে যায় ১-০ ব্যবধানে। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে দ্বিতীয় টেস্টে ভারতকে ফলো-অন করালেন স্টিভ ওয়াহ। এরপর যা ঘটল তাকে কি বলা যায়? ক্রিকেট দেবীর খেয়ালি ইচ্ছার কাছে মানুষের পরাজয়! ভিভিএস (ভেঙ্কট সাই লক্ষন) ও রাহুল দ্রাবিড় পঞ্চম উইকেটে যোগ করলেন ৩৭৬ রান। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ২৮১ রানের ইনিংস খেললেন লক্ষণ। আর ১৮০ রান করে তাকে সুযোগ্য সঙ্গ দিলেন দ্রাবিড়। শেষ দিনে এসে ১৭১ রানে হারল স্টিভ বাহিনী। এরপর তৃতীয় টেস্টে হেরে সিরিজে খুইয়ে দেশে ফিরল অস্ট্রেলিয়া। আর ভারত বিজয় অসম্পূর্ণ রেখেই ক্রিকেট ছাড়তে হল স্টিভ ওয়াহকে।

আজহারউদ্দীন ও ৯৯ এর জ্বালা ভারত ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত নাম মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন। মাত্র এক টেস্টের আক্ষেপ নিয়েই জীবন কাটাতে হচ্ছে সাবেক এই ভারত অধিনায়ককে। তার ক্যারিয়ার ৯৯ টেস্টের। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ফাঁদে পড়ে আর ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি আজহার।

১৯৮৪ সালে অভিষেক সিরিজে প্রথম তিন টেস্টেই আজহার করলেন তিন সেঞ্চুরি। ব্যাটিংয়ের সঙ্গে দুর্দান্ত ফিল্ডিং। ক্যারিয়ারের পঞ্চম বছরেই পেলেন নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব। সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে একে একে পেছনে ফেললেন পূর্বসূরিদের। টেস্ট ও ওয়ানডে দু ঘরানার ক্রিকেটেই গড়লেন ভারতের অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি জয়ের রেকর্ড (পরবর্তীতে ভারত অধিনায়ক হিসেবে তার ওয়ানডে জয়ের রেকর্ড ভেঙেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি ও টেস্ট রেকর্ড ভেঙেছেন সৌরভ গাঙ্গুলী)। শততম টেস্টে আজহার কি করবেন তারই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা ভক্তদের। কিন্তু ভক্তদের সেই অপেক্ষা আর কোনদিনই পূরণ হওয়ার নয়। ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ফেঁসে গেলেন ম্যাচ ফিক্সিংয়ে। আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হলেন আজহার।

স্বপ্নের সেঞ্চুরির দেখা পাননি চৌহানডান হাতি ওপেনার। খেলেছেন ৪০ টেস্ট। সবচেয়ে বড় পরিচয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ওপেনারদের অন্যতম সুনীল গাভাসকরের ওপেনিং পার্টনার। টেস্টে গাভাসকরের সঙ্গে ইনিংস উদ্বোধন করেছেন অরুনলাল, অংশুমান গায়কোয়াড, কৃষ্ণচামারি শ্রীকান্তের মত খ্যাতানামা ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু গাভাসকর একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ওপেনিং জুটিতে তার প্রিয় চৌহান। মজাটা হচ্ছে একই সঙ্গে ইনিংস গোড়াপত্তন করতে নেমে এক প্রান্ত থেকে থেকে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে গেছেন গাভাসকর। আর একবারও তিন অংকের ঘরের নাগাল পাননি চৌহান।

টেস্টে ৩১.৫৭ গড়ে চৌহানের রান ২০৫৭। হাফ সেঞ্চুরি আছে ১৬টি। নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়েছেন পাঁচবার। ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ রান ৯৭। কিন্তু সেঞ্চুরি বারবার ফাঁকি দিয়েছে চৌহানকে। টেস্ট ক্রিকেটে ১০ নম্বরে নেমেও সেঞ্চুরি করার কীর্তি আছে সেখানে ৪০ টেস্টে ইনিংস উদ্বোধন করেও পাননি পরম কাক্সিক্ষত তিন অংকের ঘরের নাগাল।

ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ দুঃস্বপ্ন ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে ভিন্নমাত্র দিয়েছে ভারত- পাকিস্তান। এই দুই চিরপ্রতিদ্ব›দ্বীদের মুখেমুখি লড়াইয়ে বিশেষ করে ওয়ান ডে ক্রিকেটে শ্রেয়তর রেকর্ড কিন্তু পাকিস্তানেরই। কিন্তু বিশ্বকাপে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। বিশ্বকাপে যে ওয়ান ডে কিংবা টি২০ হোক এই দুই দলের লড়াই মানেই অবধারিতভাবে পাকিস্তানের হার।

ওয়ান ডে ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ভারত- পাকিস্তান মুখেমুখি হয়েছে ১৩২ বার। এর মধ্যে ভারতের ৫১ জয়ের বিপরীতে পাকিস্তানের জয় ৭২ ম্যাচে। আর বাকি ৯ ম্যাচ থেকেছে নিষ্ফলা। হেড-টু-হেড ওয়ানডে লড়াইয়ে ভারতকে ১৯টি ম্যাচে বেশি হারিয়েছে পাকিস্তান।

অথচ বিশ্বকাপে যেন বলেই কয়েই পাকিস্তানকে হারাচ্ছে ভারত। ওয়ান ডে বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে ছয় ম্যাচের ছয়টিতেই হারিয়েছে ভারত। বিশ্বকাপে দুদল প্রথমবার মুখোমুখি হয় ১৯৯২ সালে। পরের তিন বিশ্বকাপেই ভারত দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে ফিরেছে পাকিস্তানকে। ২০০৭ বিশ্বকাপ বাদ দিয়ে ২০১১ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দ্বৈরথে নামে দুদল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয় ভারত। গত বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে আবারও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে হারের লজ্জায় ডোবে পাকিস্তান।

ব্যতিক্রম হয়নি টি২০ বিশ্বকাপেও। ভারতের মুখোমুখি হওয়া মানেই হারের দুঃষহ জালা নিয়ে পাকিস্তানের মাঠ ছাড়া হওয়া। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুদলের পাঁচবারের মোকাবেলায় পাঁচবারই হেরেছে পাকিস্তান। পাকিস্তান ভক্তরা বিশ্বকাপে কবে ভারতের বিপক্ষে জয় দেখতে পাবে বড় হয়ে উঠেছে সেই প্রশ্নটিই।

ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে হারলেন গাভাসকর ও ভিভ রিচার্ডস১৯৮৭ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে জীবনের শেষ টেস্ট সিরিজ খেলেন গাভাসকর। ৫ টেস্টের ওই সিরিজের প্রথম ৪ টেস্ট থাকে নিষ্ফলা। ওই সময় পর্যন্ত মুখেমুখি লড়াইয়ে ভারত- পাকিস্তান দুদলের কেউই নিজের দেশের বাইরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে সিরিজ তো বটেই, জিততে পারেনি কোন টেস্ট ম্যাচেই। এমনি অবস্থায় ব্যাঙ্গালোরে (বেঙ্গালুরু) সিরিজ নির্ধারণী এবং একই সঙ্গে বিদায়ী টেস্টে মাঠে নামলেন গাভাসকর। স্নায়ুক্ষয়ী ওই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ২৯ রানের লিড নিল স্বারত। দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়াল ২৪৯। জয়ের জন্য ভারতের সামনে টার্গেট ২২১ রান।

হাল ধরলেন গাভাসকর। একের পর এক সঙ্গী বদল হলেও হিমাদ্রির দৃঢ়তা নিয়ে লড়ে গেলেন এই কিংবদন্তির ওপেনার। পাকিস্তানের জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেন দেয়াল হয়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। আউট হয়ে গেলেন ৯৬ রানে। অষ্টম উইকেটের পতন ঘটল ভারতের। স্কোরবোর্ডে ১৮০/৬। জয় থেকে দূরত্ব ৩১ রানের। ২০৪ রানে অলআউট হলো ভারত। ১৬ রানে জিতে ম্যাচ তথা সিরিজ জিতে নিল পাকিস্তান। এই প্রথম নিজের মাটিতে পাকিস্তানের কাছে টেস্ট সিরিজে হারল ভারত। ৯৬ রানের সুবাদে ম্যাচ সেরার সান্ত্বনা পুরস্কার পেলেন গাভাসকর।

ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজে অবশ্য হারেননি ক্যারিবিয়ান কিং ভিভ রিচার্ডস। ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী পঞ্চম ও শেষ টেস্টে নামার আগে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল ওয়েস্টইন্ডিজ। কেনসিংটন ওভালে বিদায়ী টেস্টে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩ রানে আউট হলেন এই রান মেশিন। ২৪৩ রানে পিছিয়ে থেকে ফলো-অনে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য ঘুরে দাঁড়াল ওয়েস্টইন্ডিজ। স্কোরবোর্ডে জমা পড়ল ৩৮৫ রান। বিদায়ী ইনিংসে ৬০ রান করলেন ভিভ। হার এড়ানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ১৪২ রান টপকে ৫ উইকেটে জয় তুলে নিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড।

টেস্ট ক্যাপ মাথায় ওঠেনি মিনহাজুল আবেদিন নান্নুরকে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলেননি, এমন প্রশ্নটা হাস্যকরই বটে। বিশ্বকাপ খেলার সৌভাগ্য অর্জন করেননি অনেক বড় বড় তারকা ফুটবলাররই। তারপরও এমন প্রশ্ন যদি করা যায় তাহলে ফুটবলপ্রেমীদের বড় অংশেরই জবাব হবে, জর্জ বেস্ট বিশ্বকাপ ফুটবল খেলেননি। ঠিক একই প্রশ্ন যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটে করা হয় তাহলে উত্তরটা যে কি হবে সেটা সবারই জানা। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর মাথায় টেস্ট ক্যাপ ওঠেনি।

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে হাতেগোনা যে কয়েকজনকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষ বড় স্বপ্ন দেখত তাদের অন্যতম নান্নু। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়া কিংবা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে নান্নুর নাম।

১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ চূড়ান্তপর্বে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল টাইগারদের জন্য এসিড টেস্ট। তার অপরাজিত ৬৮ রানে ভর দিয়ে ১৮৫ রান সংগ্রহ করল বাংলাদেশ। জবাবে ১৬৩ রানে শেষ হলো স্কটিশদের ইনিংস। ২২ রানে জিতল বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের রসদও সংগ্রহ করে নিল বাংলাদেশ। ওই বছরই টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করল বাংলাদেশ। কিন্তু টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ কখনোই পাননি মিনহাজুল আবেদিন নান্নু।

আইএইচএস/জেআইএম