বাংলাদেশের ক্রিকেট পরিবার বা ক্রিকেট সমাজ তাদের কীভাবে মনে রেখেছে সেটা তর্কযোগ্য। তবে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ যদি কোন দিন ইমারত সদৃশ্য কিছু হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বলতেই হবে তার প্রথম এগারটা পিলার তাঁরা। তারা টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম এগারজন। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটারদের তালিকায়ও তারা উপরের দিকেই থাকবেন। ইন্টারনেটের যুগে গুগল কিংবা ক্রিকইনফোতে সার্চ দিলেই নামগুলো চলে আসবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধ আর বাঘের মুখের চাপ দেয়া সবুজ ক্যাপ পরে টেস্ট আঙিনায় প্রথম পা রেখেছিলেন তারা। অমরত্ব পান বা নাই পান, ইতিহাসে ঢুকে পড়তে আর কী লাগে তাদের!
Advertisement
ইতিহাসে ঢুকে পড়েছেন তারা। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের একেবারে সূচনা অধ্যায়েই আছেন তারা। কিন্তু ইতিহাস মনস্ক বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীরা সেই অধ্যয়টা কতোটা মনোযোগ দিয়ে পড়বেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বাঙালি খুব বেশি ইতিহাস মনস্ক সেই দাবি কী করা যায়?
দাবি-টাবির কথা বাদ দিন। বাস্তবতা হচ্ছে ‘ওরা এগার জন’-র অনেকেই এখন শুধুই সাবেক ক্রিকেটার। অনেকে আবার ক্রিকেটার ইমেজটাকে ডিপোজিট করে ভালই আছেন। সুদে-আসলে যা পাচ্ছেন তাতে দিব্যি চলে যাচ্ছে। টেস্ট গ্রহে প্রথম পা রেখে সেদিন তাদের কেউ কেই বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। কেউ ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে অভিষেক টেস্টে দল হিসেবে স্মরণীয় কিছু করতে না পারলেও ব্যক্তিগত অর্জনে তাদের কারো কারো নাম রেকর্ড বইয়ে জ্বলজ্বল করছে। আবার কারো কারো নাম চাইলেও ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা যাবে না।
টেস্ট ক্রিকেটে দেশের হয়ে প্রথম বলটা খেলেছিলেন যিনি, রেকর্ড বইয়ে তার নামটা থাকবে। তবে রেকর্ড-ইতিহাস-পরিসংখ্যান নিয়ে তিনি নিজে কখনো খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। এখনো না। ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন অনেক আগেই। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেয়ার সুযোগ তারও হয়নি। আর অবসরোত্তর জীবনে ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে তিনি। জড়িয়েছেন পারিবারিক ব্যবসায়।
Advertisement
স্মৃতির ক্যাবল দিয়ে মনের ভেতর ক্রিকেট নামক বাল্বটাকে আর জ্বালাতে খুব আগ্রহী মনে হয় না শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎকে। তাই স্যাটেলাইটের এই জমনায় টেলিভিশনের ক্রিকেট আড্ডায়ও তাকে দেখা যায় না। পাওয়া যায় না। অথচ ভারতের বিপক্ষে ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তিনিই খেলেছিলেন দেশের হয়ে প্রথম বল। স্মৃতি রোমান্থনে কত রোমাঞ্চকর অনুভূতির কথাই না বেরিয়ে আসতে পারে তার মুখ থেকে! স্মৃতির সাগরে ডুব দেয়ার চেয়ে ব্যবসায়ে বেশি মনোযোগী বাংলাদেশ দলের এই ওপেনার।
শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের ওপেনিং পার্টনার ছিলেন যিনি, তিনি খুব একটা বদলাননি। শরীরে মননে খুব একটা পরিবর্তন নেই মেহরাব হোসেন অপির। সতের বছর আগে টেস্ট খেলা মেহরাবের শরীর এখনো বলবে, তিনি ক্রিকেটার। কিন্তু প্রায় দেড় দশক আগে টেস্ট ক্রিকেটে সাবেক হয়ে যাওয়া মেহরাবের মন আর মননে এখনও সেই চপলতা। কখনো কোচিং করানোর কথা ভাবেন। চলে যান কিশোরগঞ্জের একটা ক্রিকেট একাডেমিতে।
মাস তিনেক যেতে না যেতে আবার ফিরে আসা। মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনেন জাতীয় দলের নির্বাচক হবেন। না হয় বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক। কখনো তার মনে উঁকি দেয় বিসিবির একাডেমি টিমের কোচ হওয়ার স্বপ্ন। আবার কিছুদিন পর বুঝতে পারেন, বাস্তবতা আর স্বপ্নের মাঝখানে বাইশ গজের চেয়ে দূরত্ব অনেক বেশি।
তাই স্বপ্নগুলোকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে চান বাস্তবের রুক্ষ জমিনে। তাই কখনো পারিবারিক ব্যবসায়ে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা। কখনো ব্যবসা ছেড়ে করপোরেট জগতে ঢুকে পড়া। কখনো ফুয়াং ফুডে তার অধিনায়কের ছায়াতলে ন’টা পাঁচটা অফিস করা কর্মকর্তা! জীবনের বাইশ গজে তিনি এখন যাই করুন, ক্রিকেট তার মনে। ক্রিকেটের মায়াটা ছাড়তে পারেন না।
Advertisement
তাই টেলিভিশন টক শো-তে বিশেষজ্ঞ হয়ে সন্তুষ্ট নন। মাইক্রোফোন হাতে তিনি দাঁড়াতে চান বিভিন্ন মাঠে। যেতে চান বিভিন্ন স্টেডিয়ামের কমেন্ট্রিবক্সে। এই কাজটা যে তার জন্য খুব কঠিন ছিল, তাও নয়। কিন্তু তিনি যে মেহরাব হোসেন অপি! কমেন্ট্রিবক্সে ঠিক সময়ে তিনি হাজির হবেন, সেই নিশ্চয়তা কে দেবেন? আর সেই নিশ্চয়তা ছাড়া তার হাত মাইক্রোফোন দেয়ার ঝুঁকি-ই বা নেবেন কোন চ্যানেলের কোন প্রোডিউসার?
কিন্তু অসম্ভব রকম ঝুঁকি আর নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন একজন। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র ২৬ মিনিট। সেই সময় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বাউন্ডারি লাইন টপকে বাইশ গজের দিকে পা বাড়ালেন চোটখাটো চেহারার এক ব্যাটসম্যান।
ভারতীয়দের উল্লাসের মধ্যে শঙ্কা নিয়েই হাঁটা উইকেটের দিকে। আশঙ্কা জহির খানের বলে নয়। যদিও বাঁহাতি জহির খানই টেস্টে প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানকে আউট করে রেকর্ড বইয়ে। ওটা তার ক্যারিয়ারেরও প্রথম টেস্ট উইকেট। মেহরাব হোসেন আউট হয়েছিলেন জহিরের বলে ৪ রান করে। তাই জহির-শ্রীনাথদের নতুন বলের মুখেই পড়তে হলো হাবিবুলকে। কিন্তু তার আগেই তো নির্বাচকদের রিভার্স সুইংয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। ‘পা চলে না’! অর্থাৎ ‘ ফুটওয়ার্ক’ নেই। এই দোহাই দিয়ে হাবিবুলকে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের চৌদ্দজনের স্কোয়াডেই রাখেননি প্রয়াত তানভীর হায়দারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটি।
মিডিয়ার সমালোচনা আর বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর হস্তক্ষেপে হাবিবুল স্কোয়াডে এলেন। বাংলাদেশের চৌদ্দজনের স্কোয়াড বেড়ে হলো ষোলজনের। হাবিবুলের সঙ্গী হয়ে স্কোয়াডে এলেন বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক মনিও। মনিকে স্কোয়াডে রাখা হয়েছিল শুধুমাত্র নির্বাচকদের স্ট্যান্স পরিবর্তনকে মিডিয়ায় জায়েজ করতে। মিডিয়ার প্রবল সমালোচনার মুখে হাবিবুলকে স্কোয়াডে জায়গা দেয়া। আর তিনি স্কোয়াডে থাকা মানে প্রথম একাদশেও থাকবেন।
এটা নির্বাচকদের পাশাপাশি জানতেন সবাই। আর হাবিবুল জানতেন, অভিষেক টেস্টটাই তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের লাইফ লাইন। ব্যর্থ হলেই শেষ। নির্বাচকরা ওঁৎ পেতে বসে আছেন তাকে ছেঁটে ফেলার জন্য। ওখানেই শেষ হয়ে যেতে পারে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার। হাবিবুলের মত এতোটা ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের আর কোন ক্রিকেটারের টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হয়নি। তাই শঙ্গা আর ঝুঁকি নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখা তার।
হাবিবুল ব্যাট করার সময় অন্যরকম এক শঙ্কার বাতাবরণ ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে। বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেসের মধ্যে! কারণ, মিডিয়ার লোকজনও জানতেন, হাবিবুল ব্যর্থ হলে সেই সময়ের নির্বাচক কমিটি গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলতেন; ‘দেখলেন তো, এদেশের মিডিয়া ক্রিকেট বোঝে না!’ ধন্যবাদ হাবিবুলকে। তার পা চললো। ব্যাট চললো। টেস্টে প্রথম যার বলের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেই জহির খানের বলে আউট হওয়ার আগে ৭১ রানের ইনিংস খেলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন নির্বাচকদের মুখ।
সেখান থেকে জন্ম নতুন এক হাবিবুলের। যিনি শুধু অভিষেক টেস্ট খেলেননি। বাংলাদেশের পক্ষে এক সময় সবচেয়ে বেশি টেস্ট আর বেশি রানেরও মালিক হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে নেতৃত্বও দিয়েছেন লম্বা সময়। তার অধিনায়কত্বেই বাংলাদেশ তার ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জিতেছে।সেই হাবিবুল আট বছর পর নিজের ক্যারিয়ার আরো লম্বা করার স্বপ্নকে বির্সজন দিয়ে সাড়া দিলেন আইসিএলের হাতছানিতে। ডলার পেলেন। কিন্তু নিষিদ্ধ হয়ে শেষ হলো তার ক্যারিয়ার! সেই নিষেধাজ্ঞা খুব বেশি লম্বা হয়নি। তাই হাবিবুল ফিরলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে। তবে অন্য ভূমিকায়। নির্বাচক হিসেবে। অবসরোত্তর জীবনে ভালই আছেন বাংলাদশ ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান। যাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক এখনো বলেন, ‘ও ছিল গরিবের আজহার উদ্দিন!’
হ্যাঁ, গরিবের আজহার উদ্দিন। বাংলাদেশ তো ক্রিকেট বিশে^ এক সময় গরিব-ই ছিল। ক্রিকেটীয় দীনতাকে সঙ্গী করে টেস্ট ক্রিকেটে এক দশকের বেশি সময় পার করতে হয়েছে তাকে। তবে সেই সময়েও বাংলাদেশ দলে একজন হাবিবুল ছিলেন। আজহারের মত কবজির মোচড়ে মাঠে কিছুটা শিল্পের ছোঁয়া দিতে পারতেন যিনি। আজহারের মতো টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি দিয়ে হয়তো তার ক্যারিয়ার শুরু হয়নি। কিন্তু এক সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলে ‘মিস্টার ফিফটি’! হাবিবুল মাঠে নামা মানে হচ্ছে, কমপক্ষে একটা হাফ সেঞ্চুরি।
কিন্তু যার মুখে প্রথম শুনেছিলাম, ‘হাবিবুল, ও তো গরিবের আজহার উদ্দিন’ তিনি অবশ্য আজহার উদ্দিনের মতো ক্যারিয়ারে প্রথম টেস্টেই এলিটদের সরণিতে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তবে আজহার উদ্দিনও অভিজাত ঐ সরণির বাসিন্দা নন। নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টে আজহারের সেঞ্চুরি আছে। একটা নয়, পর পর তিন টেস্টেই তিনটা সেঞ্চুরি আজহারের। তবে দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরিয়ানদের তালিকায় শুধু আজহার নন। তার দেশেরও কেউ নেই।
ঐ তালিকায় আমিনুল ইসলাম বুলবুলের আগে আছেন মাত্র দু’জন। অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান। আর জিম্বাবুয়ের ডেভ হটন। একশ চল্লিশ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ঐ তালিকার তৃতীয় নাম- আমিনুল ইসলাম বুলবুল। হাবিবুলের মত না হলেও তার ক্যারিয়ারও ঝুঁকির মুখেই ছিল। ফর্ম নেই। চাপ নিতে পারছেন না। এই আওয়াজ তুলে তার সঙ্গে কোন কথা না বলেই সরিয়ে দেয়া হয়েছিল তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে। কিন্তু সেই বুলবুল অভিষেক টেস্টের চাপ সামলে খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ১৪৫ রানের ইনিংস। উইকেটে থাকলেন ৫৩৫ মিনিট। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে যোগ্যতা দিয়ে।
পৃথিবীশুদ্ধ মানুষকে সেটা বোঝানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই যেন ব্যাট করলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তবে টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট করার কাজটা খুব কঠিন কাজ না! সেটা নাকি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নন স্ট্রাইক এন্ডে দাঁড়িয়ে অন্য একজনের ব্যাটিং দেখে। সেই ভদ্রলোকের নাম অবশ্য হাবিবুল বাশার। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের চেয়ে মাত্র ৫৭ মিনিট আগে যিনি টেস্ট উইকেটে পা রেখেছিলেন। ‘সুমনের ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল ব্যাটিংটা খুব সহজ।’
মেলবোর্ন প্রবাসী আমিনুল ইসলাম বুলবুল ঢাকায় এসে ক্রিকেট আড্ডায় বহুবার কথাটা বলেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের একটা রেকর্ড আগামী প্রজন্মের কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের পক্ষে ভাঙা সম্ভব হবে না। দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি। ঐ একটা ইনিংসের কারণেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে যার অমরত্ব পেয়ে যাওয়ার কথা, অবসরের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায়নি। এখনও চাইছে তেমন কথা বলা যাবে না। তাই ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইন থেকে ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির প্রশ্ন, ‘আমিনুলকে কেন বাংলাদেশ ক্রিকেট কাজে লাগায় না!’
উত্তরটা যাদের ভাল জানা তারা নিশ্চুপ থাকেন। অথবা বলেন, ‘ও তো আসতে চায় না। আমাদের তো কিছু বলে না।’ আইসিসির ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে এশিয়া অঞ্চল নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন বুলবুল। মেলবোর্নে পরিবার আর কাজ নিয়ে খারাপ আছেন তিনি তা বলা যাবে না। ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার এক সময়ের খুব প্রভাবশালী ক্রিকেট সাংবাদিক এখন যিনি ডেপুটি এডিটর, সেই বন্ধু বিজয় লোকপল্লী দিল্লিতে বসে বছর খানেক আগে এক কফি আড্ডায় বলছিলেন,‘ তোমাদের অভিষেক টেস্টেও কে কেমন আছে জানি না। তবে শুনেছি তাদের অনেকেই ক্রিকেট প্রশাসনে জড়িয়েছেন। এটা এক দিকে ভাল।’ তারপর হাসতে হাসতে বললেন,‘ ক্রিকেট ইতিহাস অবশ্য সবাইকে কী মনে রাখবে?’
ক্রিকেট রিপোর্টার হিসেবে বিজয় কখনো ঠিক আর পাঁচজন ভারতীয় বা ইংলিশ প্রেসের মতো নন। ভারতীয় হিসেবে শুধু ভারতের ক্রিকেটার কিংবা ইংলিশদের মত শুধু ইংলিশ টিমের খোঁজ-খবরে ব্যস্ত থাকতে হবে সেই তত্ত্বেও তিনি বিশ্বাসী নন। তাই গত ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের পর বুলবুলকে নিয়ে ‘দ্য হিন্দু’তে বড় একটা স্টোরি লিখেছিলেন। বিশ্বজুড়ে এতো তারকা থাকতে কেন বুলবুল? এই প্রশ্নের উত্তরে দিল্লি নিবাসী বিজয়ের উত্তর; ‘ভারতীয় সাংবাদিক হিসেবে অনেক স্টার-সুপার স্টার-মেগা স্টারের সঙ্গে কথা বলেছি।
তাদের একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বিশ্বকাপ জয়ী অনেক অধিনায়কের সঙ্গে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি। ভারতীয় হিসেবে আমরা অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যান পেয়েছি। কিন্তু এমন কাউকে পাইনি যে ভারতের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন! ঐ কৃতিত্ব তো দেখিয়েছেন মাত্র তিনজন। তাদের দু’জন আবার সেটা করেছেন ভারতের বিপক্ষে। তৃতীয় জন কাজটা করেছিলেন ভারত টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখার পঞ্চান্ন বছর আগে। এবং সেটা ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার সত্তর বছর আগে। অস্ট্রেলিয়ান সেই চার্লস ব্যানারম্যানকে খুঁজে পাওয়ার সুযোগ নেই। ডেভ হটন আর আমিনুলকে দেখছি। আমিনুল দিল্লিতে, আর তাঁর সাথে কথা বলবো না! তা হলে আমি সেই গোরা (ইংরেজ) ক্রিকেট সাংবাদিক হয়ে গেলাম! যেটা কোনদিন হতে চাই না।’
কোন ভারতীয় তাদের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করতে পারেননি। কোন ইংলিশও পারেননি। তাই বুলবুলের সেঞ্চুরি করা ব্যাটটার প্রতি ইংরেজদের হয়তো বাড়তি একটু আগ্রহ ছিল। বুলবুলের সেঞ্চুরি করা সেই ব্যাট ইংলিশরাই সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছে। আর যে বলটায় বুলবুল আউট হয়েছিলেন সেটা থাকার কথা এক ভারতীয়র কাছে। দেশের অভিষেক টেস্টে যে তিনজন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করেছিলেন, তাদের দুজনের আউটের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার ভূমিকা ছিল। জিম্বাবুয়ের ডেভ হটনের ১২১ রানের ইনিংস শেষ হয় শ্রীনাথের বলে। কিরণ মোরের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়েছিলেন ঐ জিম্বাবুয়ান।
আর আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের ইনিংসে দাড়ি টেনে দিতেও সেই শ্রীনাথের হাত। অজিত আগাকারের বলে শ্রীনাথের হাতে ক্যাচ দিলেন বুলবুল। শোকস্তব্ধ গোটা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। সঙ্গে গোটা দেশ। কারণ, চালর্স ব্যানারম্যানের ১৬৫ রানের ইনিংসকে ছাড়িয়ে যাবেন বুলবুল। প্রেসবক্স তখন ব্যস্ত ব্যানারম্যানের ইনিংসের খুঁটিনাটি খুঁজে বের করতে। কিন্তু সিডনির সমাধিতে শান্তিতেই ঘুমিয়ে থাকতে পারলেন ব্যানারম্যান। ১৬৫ রান করে রিটায়ার্ড হার্ট হয়েছিলেন চার্লস ব্যানারম্যান। তার সেই রেকর্ড অক্ষতই রইলো। এবং এখনো আছে।
বুলবুলেরও আক্ষেপের তেমন কিছু থাকার কথা নয়। কারণ, অভিষেক টেস্ট মানেই তো ব্যানারম্যান। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বল ফেস করেছিলেন তিনি। টেস্টে প্রথম রান করেছিলেন তিনি। প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। মরণের ওপারে থাকুন না তিনি শান্তিতে। আর শান্তিতে থাকার জন্য-ই কী আমিনুল ইসলাম বুলবুল চলে গেলেন ব্যানারম্যান যেখানে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন সেই মেলবোর্নে!
হ্যাঁ, মেলবোর্ন এখন বুলবুলের স্থায়ী ঠিকানা। আর মেলবোর্নে তার বাড়ির নম্বরও ঠিক ১০০! ক্রিকেট ঈশ্বর আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে সুযোগ দেননি চার্লস ব্যানারম্যানের ইনিংসকে ছাপিয়ে যাওয়ার। কিন্তু ঈশ্বর এক জায়গায় তাদের দু’জনকে আবার মিলিয়ে দিলেন। দু’জনের হাতে ধরিয়ে দিলেন অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট!
একজনকে দিয়েছিলেন ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর আগে। আরেকজনকে দিলেন ক্যারিয়ার শেষে। হ্যাঁ, চার্লস ব্যানারম্যানের জন্ম তো ইংল্যান্ডে। বাবা-মার সাথে অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে। ব্যানারম্যানকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি বুলবুল। কিন্তু যেটা পারলেন সেটাই কম কী! দেশের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান। দেশের প্রথম বিশ্বকাপে অধিনায়ক। ক্রিকেটীয় অমরত্ব পেতে আর কী-ই বা দরকার পড়ে!
অভিষেক টেস্ট হয়তো অমরত্ব দেয়নি আরেকজনকে। কিন্তু দেশজ ক্রিকেটে তিনি এমন একটা জায়গায় তাকে ঠিক নড়ানো যাবে না। সরানো যাবে না। বিশাল আকৃতির মানুষটা তার চওড়া কাঁধে করেই বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন বিশ্বকাপে। তারপরই বাংলাদেশের সামনে খুলে যায় টেস্ট ক্রিকেটের দরোজা। আর বাংলাদেশের প্রথম টেস্টে তিনিও ছিলেন। শুধু ছিলেন না। বাংলাদেশের মিডল অর্ডারে অন্যতম ভরসা হিসেবেই ছিলেন। পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে আকরাম খান করেছিলেন ৩৫ রান। স্কোরটা হয়তো খুব বড় নয়।
তবে আকরাম ছিলেন আকরামের মেজাজেই। বুলবুলের সঙ্গে রানের একটা পার্টনারশিপ গড়েছিলেন। তবে অভিষেক টেস্ট নয়। আকরামকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম ‘পিলার’ হিসেবে। তামিম-মুশফিকদের এখনকার ডাবল সেঞ্চুরিতে আবেগের দমকা হাওয়াও সেটাকে নড়াতে পারবে না। অন্তত ইতিহাস মনস্কদের মন থেকে।
সেই আকরাম অবশ্য মাঠ থেকে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে পারেননি। সংবাদ সম্মেলন করে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তবে অবসরোত্তর জীবনে ভালভাবেই আছেন ক্রিকেটে। কখনো নির্বাচক। কখনো নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান। কখনো বিসিবি পরিচালক। আবার সেই আকরাম খানও কখনো কখনো অভিমানী! অভিমান করে পদত্যাগও করতে পারেন নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যানের পদ থেকে! তারপরও বলতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আকরাম খানের যা ডিপোজিট তাতে অবসরোত্তর জীবনের বাকি দিনগুলো ভালভাবেই পার করতে পারবেন তিনি।
অভিমান! নাকি উন্নত নিরাপদ জীবনের হাতছানি! তা হয়তো শুধু তিনি নিজেই জানেন। তবে আপাতত মনে হয় উন্নত নিরাপদ জীবন আর পরবর্তী প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে ক্রিকেট ছেড়ে প্রবাস জীবনকে বেছে নিয়েছেন আল-শাহরিয়ার রোকন। অভিষেক টেস্টের প্রথম একাদশেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাঁর প্রতিভা নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। বলা হয়েছে। তবে স্কোরশিটে সেই প্রতিভার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি তিনি। আর এই না পারাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ট্র্যাজেডি না রহস্য তা নিয়ে গবেষণাও হতে পারে।
গবেষণা যাদের করার তারা হয়তো করবেন। সেটা ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানে আল-শাহরিয়ার নিউজিল্যান্ডের প্রবাসী। আর প্রবাস জীবনে কোচিংকেই বেছে নিয়েছেন ক্যারিয়ার হিসেবে। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমাজ যদি অংক আর সৌন্দর্যের দ্বন্দ্বে সৌন্দর্যের পক্ষ নেয়, তাহলে মনে রাখতে হবে আল-শাহরিয়ারকে। বাহারি খেলা-ই ছিল তার দর্শন। ওটাই ছিল তার কাঙ্খিত ক্রিকেট। জন্মটা আর একটু পরে হলে, টি- টোয়েন্টির এই জমানায় আল-শাহরিয়ার হতে পারতেন বাংলাদেশ দলের বড় এক সম্পদ। ওর চেয়ে ভাল স্ট্রোক মেকার শত টেস্ট খেলা বাংলাদেশ কী পেয়েছে?
ক্রিকেটীয় সম্পদশালী বাংলাদেশ নয়। তিনি ছিলেন ক্রিকেটীয়ভাবে দরিদ্র বাংলাদেশের উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক সৈনিক। উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলটের কাউন্টার পার্ট হিসেবে ভারতীয় দলে যার অভিষেক হয়েছিল সেই সাবা করিমের চেয়েও অনেক এগিয়ে ছিলেন। শুধু সাবা কেন? তার সময়ে অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক উইকেট কিপার ছিলেন পাইলট। অভিষেক টেস্টে সাত নম্বরে ব্যাট করতে নামা পাইলটের চেয়ে দুই ইনিংস মিলিয়ে বেশি সময় ব্যাট করেছিলেন শুধু মাত্র একজন। আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
প্রথম ইনিংসে নট আউটও থাকলেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে পরবর্তীতে সেঞ্চুরিও করেছেন পাইলট। অধিনায়কত্ব করেছেন। তবে অভিষেক টেস্ট নিয়ে পাইলটের আক্ষেপ থাকতে পারে একটা কারণে। গ্লাভস হাতে তার কোন ডিসমিসাল ছিল না! বরং ভারতীয় উইকেট কিপার সাবা করিমকে স্টাম্পড করেছিলেন পাইলটের জায়গায় গ্লাভস হাতে নেয়া শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ! তবে ক্রিকেট ছেড়েও পাইলট এখন ক্রিকেটেই আছেন। কোচিং করাচ্ছেন। একাডেমি চালাচ্ছেন। টুর্নামেন্ট আয়োজন করছেন। টক শো করছেন। ক্রিকেটের প্রায় সব জায়গাতেই আছেন তিনি। বলা যায় বিখ্যাত ফুটবলার বাবার ক্রিকেটার ছেলের ডিএনএ-তেই ক্রিকেট।
আরেকজন তার বিখ্যাত ফুটবলার মামা-কে দেখে হতে চেয়েছিলেন ফুটবলার। শেষ পর্যন্ত তিনি হলেন ক্রিকেটার। এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটে যার নামটা অমোচনীয় হয়েই থাকলো। কারণ, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক তিনি। নাঈমুর রহমান দুর্জয় বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চাইলেও কী তার নাম মুছে ফেলা যাবে? তিনি তো ইতিহাসের অংশ হয়েই আছেন। দুর্জয় যখন অভিষেক টেস্টে টস করতে নামলেন, তখনই ক্রিকেট গ্রহে প্রথম বার পা রাখলেন দুই বাঙালি টেস্ট অধিনায়ক! দুর্জয়ের প্রথম টেস্ট।
আর ভারতের অধিনায়ক হিসেবে সৌরভ গাঙ্গুলিরও ছিল ওটা প্রথম টেস্ট। অধিনায়ক হিসেবে দুর্জয় পরাজিত দলেই ছিলেন। কিন্তু ঐ টেস্ট মনে রাখার জন্য তার ব্যক্তিগত অর্জন কম ছিল না। ভারতের প্রথম ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়েছিলেন এই অফ স্পিনার। ইনিংসে ছয় উইকেট দিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল যার তিনি খুব বেশি দিন টেস্ট খেলতে পারেননি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে রাজনীতির মেরুকরণ আর ফর্মের বিশ্বাস ঘাতকতা একটু আগেভাগে দাড়ি টেনে দেয় দুর্জয়ের টেস্ট ক্যারিয়ারে।
ক্রিকেট মাঠ ছাড়ার পর নিয়তি তাকে ঠেলে দিয়েছে সেই রাজনীতির মাঠে। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে বাবার পথ ধরে রাজনীতিতেই ব্যস্ত এখন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক। দুর্জয় পুরোপুরি রাজনীতিবিদ। বাবার উত্তাধিকার আর ক্রিকেটের সৌজন্যে জাতীয় সংসদের সদস্যও তিনি। ক্রিকেট উত্তর জীবনে রাজনীতিতে কতদূর যাবেন নাঈমুর রহমান তা হয়তো সময় বলবে। তবে দেশের ক্রিকেটীয় রাজসিংহাসনে তিনি বসেই আছেন। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ককে চাইলেও কী ইতিহাস থেকে সরিয়ে ফেলা যাবে?
ইতিহাস। এদেশের ক্রিকেট সমাজ। কে কীভাবে তাকে মনে রাখলেন বা না রাখলেন তা নিয়ে মোটেও ভাবিত নন তিনি। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল বাঁহাতি স্পিনার তিনি। শুধু স্পিনার বলছি কেন, তিনি সফল অলরাউন্ডার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে যিনি সেঞ্চুরি করলেন, সেই বাঁ-হাতি স্পিনারকে অলরাউন্ডার বলবেন না কেন! বাঙালির কাছে মোহাম্মদ রফিক অলরাউন্ডার।
অভিষেক টেস্টে নাঈমুরের অফ স্পিনের সাফল্যের পাশে হয়তো ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে গোটা তিনেক উইকেট নিয়ে ছিলেন। আর বাংলাদেশ বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ইকনোমি রেট ছিল তার। বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি বলও করেছিলেন এই বাঁহাতি স্পিনার। পরবর্তীতে তিনিই হয়ে গেলেন বাংলাদেশ দলের মূল স্ট্রাইক বোলার। বহু ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু মোহাম্মদ রফিক প্রতিপক্ষের জন্য হয়ে থাকলেন এক ইনিংসের বোলার!
কারণ, বাংলাদেশের নড়বড়ে ব্যাটিংয়ে প্রতিপক্ষকে দ্বিতীয় ইনিংসে খুব বেশি ব্যাট করতে হয়নি তার সময়। এই আক্ষেপটা মোহাম্মদ রফিককে নিশ্চিত পোড়ায়। কিন্তু তিনি কতোটা দগ্ধ হন তা বোঝা কঠিন। কারণ, বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে উঠে আসা লোকটা ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার পর এখন বুড়িগঙ্গার মত নিস্তরঙ্গ। ক্রিকেটীয় ঢেউ তার মনের তটে খুব বেশি আচড়ে পড়ে কী! বলা কঠিন। আবার ক্রিকেট একেবারে ভুলে আছেন তাও নয়। ব্যবসা আর কেরানীগঞ্জের ক্রিকেট। এই নিয়ে খুব একটা খারাপ নেই বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারের বাসিন্দা।
খারাপ নেই বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বল করেছিলেন যিনি। ক্রিকেটের সঙ্গেই আছেন। ক্রিকেট ছাড়ার পর এখন বিসিবির বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক। ব্যবসা, বিসিবির বেতন সব মিলিয়ে ভালই আছেন হাসিবুল হোসেন শান্ত। কিন্তু তার আক্ষেপ- মানুষ নাকি ভুলেই গেছেন তিনি টেস্ট খেলেছেন! শুধু অভিষেক টেস্ট খেলেননি। এরপর আরো গোটা চারেক টেস্ট খেলেছেন শান্ত।
অভিষেক টেস্টে ভারতের প্রথম ইনিংসে কোন উইকেট তিনি পাননি; কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের একমাত্র উইকেটটা তিনি-ই নিয়েছিলেন। আর তাতেই অভিষেক টেস্টে দশ উইকেটের হার এড়াতে পেরেছিল বাংলাদেশ। তবে নিজের আক্ষেপের ওপর আবার শান্ত নিজেই সান্ত্বনার প্রলেপ বুলিয়ে বলতে পারেন; ‘বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে প্রথম বল করেছি আমি। বিশ্বকাপেও প্রথম বল করেছি দেশের পক্ষে। আর বাংলাদেশ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ^কাপে গিয়েছিল আমার প্যাড থেকে আসা উইনিং রানে।’ আইসিসি ট্রফিতে শান্তর প্যাড থেকে আসা সেই উইনিং রানের ছবিটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্মরণীয় এক ফ্রেম।
তবে অভিষেক টেস্টে নতুন বলে হাসিবুল হোসেন শান্তর পার্টনার ছিলেন যিনি সেই বিকাশ রঞ্জন দাস (পরবর্তীতে মাহমুদুল হাসান) এখন আর ক্রিকেটীয় হিসাব-নিকেশের মধ্যে নেই। তিনি এখন পুরোদস্তুর ব্যাংকার। একটা বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তার এক সময়ের টিমমেটরা এখন তাকে নিয়ে প্রায়ই বলেন; ‘ও বল করতো বাঁহাতে। কিন্তু ব্যাংক সামলায় দুই হাতে! দারুণ করিতকর্মা। যেমন কাজ করছেন তেমনি মোটা বেতনও পাচ্ছে।’
ক্রিকেট ক্যারিয়ার খুব বেশি বিকশিত করতে না পারলেও ক্রিকেট উত্তর জীবনে তিনি ভাল আছেন। অনেকের চেয়ে ভাল আছেন। টিমমেটদের কাছ থেকে এই সার্টিফিকেট বিকাশের জন্য খুব কম প্রাপ্তি নয়। তবে বড় প্রাপ্তি অবশ্যই বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের প্রথম এগারতে জায়গা করে নেয়া।
স্ট্যাটটিকস নামক স্ক্যান রিপোর্ট দিয়ে অবশ্য অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেহারা বোঝার চেষ্টা এখন না করাই ভাল। একুশ শতকের প্রথম দশকের শুরুতে টেস্ট খেলতে নেমেছিল যে বাংলাদেশ, তার ক্রিকেটীয় চেহারা মোটেও আজকের মত ঝকঝকে উজ্জ্বল ছিল না। তবে ভারতের বিপক্ষে ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর শুরু হওয়া সেই টেস্টের গুরুত্ব ছিল অনেক। সেদিন যারা বাংলাদেশ ক্যাপ পরে টেস্ট গ্রহে প্রথম পা রেখেছিলেন সেই এগার জনের প্রত্যেকেই নিজের মত করেই ভাল আছেন। তবে নিশ্চয়ই সবাই ভাল আছেন, অন্য একটা কথা ভেবে। তারাই তো টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম বংশ।
আইএইচএস/জেআইএম