রাঙামাটিতে পাহাড়ধসের ভয়াবহ ঘটনার এক সপ্তাহ আজ। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বিপর্যয়ে এখন পর্যন্ত কেবল রাঙামাটিতেই ১১৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। চারপাশে হাহাকার, স্বজন ও সর্বস্ব হারানোর আহাজারি এখনও থামেনি বিচ্ছিন্ন এ জনপদে। কিন্তু ঘটনার এক সপ্তাহ পার হলেও এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক তালিকা নিরূপণ করতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন।
Advertisement
রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, শহরসহ জেলায় ১৪৫ স্থানে ব্যাপক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। আর রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগ বলছে, ১৩ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় রাঙামাটিতে সরকারি বেসরকারি অনেক ভবন ও স্থাপনার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। যে তালিকায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঝুঁকিতে পড়েছে।
এদিকে ১৩ জুন পাহাড়ধসের পর রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নেন বহু মানুষ। তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিতে বসবাসকারী। কিন্তু ভবন ঝুঁকিতে পড়ায় আশ্রয় কেন্দ্রেও বিরাজ করছে শঙ্কা। এছাড়া দুর্যোগের পর নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলেও বিধ্বস্ত ভিটায় গিয়ে নতুন করে বাড়িঘর করার সাহস করছে না ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ভাবলেও পিছু ছাড়ছে না ভয়। পাহাড়ধসের দিন বিকেলে শহরের শিমুলতলী সংলগ্ন রাঙামাটি টেলিভিশন সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র ভবনে খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায় আশ্রিতরা রয়েছেন শঙ্কার মধ্যে। শঙ্কিত কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষও। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ঘেঁষে পাহাড়চূড়ায় নির্মিত ভবনের তিন দিকেই পাহাড়ধস হয়েছে।
ধসের ফলে পানি সরবরাহ সিস্টেমটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে বলে জানান, উপকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা টেলিভিশন প্রকৌশলী নাসিমুল হক। ওই সময় ভবনের চারপাশে পাহাড় ধসের স্থানগুলো ঘুরে দেখান। আবার ভারী বৃষ্টি হলে ভবনটির অবস্থা আরও মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
Advertisement
এই টিভি প্রকৌশলী জানান, বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ভবনের পূর্ব-উত্তর কোণসহ তিন দিকে পাহাড় ধস হয়েছে। ফলে ভবনটি এখন ঝুঁকিতে। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ায় এখানে পানির সংকট হচ্ছে। আশ্রিতদের মাঝে বাইরে থেকে নিয়ে এসে পানি সরবরাহ করা হলেও এত লোকজনের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে শৌচাগারসহ সার্বিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নোংরা হয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের প্রায় তিন শতাধিক মানুষ। তাদের অনেকে বাড়িঘর ও স্বজন হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকে ঝুঁকিতে বসবাসকারী।
আবদুল মজিদসহ (৫০) আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানকারীরা বলেন, বাড়িঘরসহ সব হারিয়ে এবং ঝুঁকি এড়াতে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। কিন্তু ভবনটির আশেপাশে ব্যাপক পাহাড়ধস হওয়ায় সেখানেও তারা শঙ্কিত।
তারা বলেন, ওই আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার, পানির তেমন কোনো সমস্যা নেই। ত্রাণও পাচ্ছেন যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু বাড়িঘর হারিয়ে বা বাড়িঘর ছেড়ে একস্থানে এত মানুষের গাদাগাদিতে নানান সংকটে পড়তে হচ্ছে। ওই কেন্দ্রে প্রায় ৭০টি পরিবারের তিন শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান তারা। পাহাড় ধসে সরকারি স্থাপনার মধ্যে অধিক ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে আঞ্চলিক পাসপোর্ট ভবন, বেতার ভবন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ভবন, সার্কিট হাউস, পুলিশ সুপারের বাংলো, জেলা প্রশাসকের বাংলো, মৎস্য ভবনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
Advertisement
টিভি উপকেন্দ্রের সামনে আঞ্চলিক পাসপোর্ট ভবন। দুর্ঘটনার দিন বিকেলে সেখানেও আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। কিন্তু ভবনটি পাহাড় ধসের ফলে ঝুঁকিতে পড়ায় কিছু দূরের বেতার ভবনে সরিয়ে নেয়া হয় আশ্রিতদের। তাছড়া ভবনটি করা হয়েছে পাহাড়ের ওপর ফেলা ময়লা-আবর্জনা স্তুপে। তারউপর আশেপাশে ব্যাপকহারে পাহাড় ধস হয়েছে। ফলে ফের ভারী বৃষ্টিতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ভবনের পর বেতার কেন্দ্র ভবন। আশেপাশে ব্যাপক পাহাড় ধসে সেটিও ঝুঁকিতে। সেখানে প্রায় কয়েকশ মানুষ আশ্রিত। ফের ধসের আশঙ্কায় শঙ্কিত তারা।
শহরের ভেদভেদীতে স্থাপিত উপজাতীয় যাদুঘরসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভবনের আশেপাশে ব্যাপক পাহাড় ধস হওয়ায় সেটিও মারাত্মক ঝুঁকিতে। ঝুঁকিতে সার্কিট হাউস। সার্কিট হাউসটির ধস রোধে কাজ করা হচ্ছে।
শহরের রিজার্ভবাজার চেঙ্গিমুখে অবস্থিত পুলিশ সুপারের বাংলোর সীমানাপ্রাচিরসহ পাহাড়ের একাংশ ধসে কাপ্তাই হ্রদে মিলিয়ে গেছে। ধসের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে মৎস্য ভবনটি। সরকারি স্থাপনার মতো সড়ক, বসতবাড়ি, ভবন ও দোকানপাটসহ ঝুঁকিতে অসংখ্য স্থাপনা। অভ্যন্তরীণসহ বিভিন্ন সড়কে লাল পতাকা ও বালুর বস্তা দিয়ে বিভাজক তৈরি করে ঝুঁকির চিহ্ন দেয়া হয়েছে।
রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী জহির রায়হান বলেন, শহরে ভবনগুলোর ক্ষতির নির্ধারণসহ তালিকা নিরূপণের কাজ চলছে।
রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কসহ অভ্যন্তরীণ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ধস হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন অংশে দেখা যায় ফাটলের চিত্র। এক সপ্তাহেও সচল হয়নি রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে যান চলাচল। তবে শিগগির হালকা যান চলাচল উপযোগী করা যাবে বলে জানান, জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান ও সামরিক কর্মকর্তারা।
জেলা প্রশাসক বলেন, পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বৈরি আবহাওয়া ছাড়া অন্য কোনো সংকট আর নেই। পাহাড় ধসের ঘটনায় উদ্ভুত সংকটগুলো মেকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে।
সুশীল প্রসাদ চাকমা/এফএ/পিআর