মানবপাচারকারীদের হাতে পড়ার পর উদ্ধার ১৪ বছর বয়সী বাংলাদেশি কিশোর আবসার উদ্দিন বর্ণনা দিল নিজের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ তাকে কাটাতে হয়েছে সীমাহীন অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে। চোখের সামনে মানবপাচারকারীদের হাতে নিজের স্বজনদের খুনের লোমহর্ষক খুনের অমানবিক দৃশ্যের স্বাক্ষী সে। যাদের সাগরে ছুড়ে মেরে ফেলা হয়েছিল।সম্ভবত আবসার উদ্দিন নিজের এ কষ্টের গল্প বলতেই বেঁচে গেছে এমনটিই জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। গত শুক্রবার শত শত বাংলাদেশি এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গার সঙ্গে ডুবন্ত নৌকা হতে তাকে উদ্ধার করে ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা।‘আমি আমার বাড়িতে ফিরতে চাই, মায়ের কাছে যেতে চাই’ ল্যাংসা শহরের একটি বাড়িতে অভিবাসীদের আশ্রয় কেন্দ্র হতে এএফপি’র প্রতিবেদকের কাছে এমনই আকুতি জানায় সে। প্রায় দু’মাসের কঠোর অগ্নিপরীক্ষার পর সুমাত্রার উত্তর উপকূলের এ জায়গায় তারা আশ্রয় পায়।একটি দরিদ্র পরিবার ক্ষীণকায় এ কিশোর মোবাইলে প্রথমবারের মত নিজের মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে চলে আসার পর সমুদ্রে দীর্ঘ সময় অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটানোর পর প্রথমবার মায়ের সঙ্গে কথা বললো সে। অপর প্রান্ত থেকে তার মায়েরও কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।এমন অসংখ্য দুর্দশার শিকারের মধ্যে প্রায় ৯শ` অভিবাসীকে শুক্রবার উদ্ধার করা হয়। অভিবাসী ইস্যুতে থাইল্যান্ড কঠোর অবস্থানে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানবপাচারকারীরা বিপাকে পড়ে। এই রুটগুলোতে সম্প্রতি ব্যাপক অভিযান শুরু করে থাইল্যান্ড। এরপর গণকবর আবিষ্কারসহ বিভিন্ন অমানবিক ঘটনা সামনে আসতে শুরু করে।সম্প্রতি ব্যাপক সংখ্যায় অবৈধ অভিবাসী মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াতে পৌঁছাতে শুরু করেছে। এর মধ্যে শত শত এখনো সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্নদেশ এই অঞ্চলগুলোকে তাদের সমুদ্রসীমা খোলা রাখার আহ্বান জানাচ্ছে।উদ্ধার বাংলাদেশি আবসার উদ্দিনের নৌকা হতে এমন আরো ভয়ানক কাহিনী বের হয়ে আসছে। উদ্ধার অনেক অভিবাসীই জানিয়েছেন- নৌকায় বা ট্রলারে মানুষকে খুন করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়ার লোমহর্ষক ঘটনার কথা। বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গারা সবাই একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানায়।আবসারউদ্দিন জানায়, নিহতদের মধ্যে তার ছোট চাচা মাইনউদ্দিন (১৬) এবং অপর এক আত্মীয় নবি হোসেনও (১৮) রয়েছে। যাদেরকে তার সঙ্গে অপহরণ করা হয়েছিল।সে আরো জানায়, তার অভুক্ত চাচা মাইনউদ্দিন খেতে চাইলে ট্রলারের মাঝি তাকে মারতে শুরু করে। নবি হোসেন বাধা দিলে তাকেও মারা হয়। এরপর তাদের দু’জনকেই নির্মমভাবে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়।আবসার উদ্দিন আরো জানায়, আমি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে তাদের আর্তচিৎকার শুনেছি। কিন্তু আমি এত ছোট মানুষ প্রতিরোধ করার সাহস পাইনি। জোরে জোরে চিৎকার করে কেঁদেছি এবং তাদের জন্য দোয়া করেছি।টেকনাফের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত হতে আসা ছয় কিশোরের মধ্যে আফসার উদ্দিন একজন। এর মধ্যে কার দু’জন আত্মীয় ও এক বন্ধু ছিল। আফসার উদ্দিন জানায়, একদিন সকালের নাস্তার পর এক আগন্তুক আমাদের একটি বাগানে যেতে বলে। সেখানে গেলে তারা আমাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং মারতে মারতে অভিবাসীদের নৌকায় তুলে। প্রথমদিকে তারা (পাচারকারীরা) দিনে দু’বার ভাত এবং ভাল পানি খেতে দিত। তবে এরপর জোর করে বিস্কুট আর সমুদ্রের পানি খাওয়ায়।সে আরো জানায়, আমি প্রায় ১০০ লোককে না খেয়ে মারা যেতে দেখেছি যাদের লাশগুলো সাগরে ফেলে দেয়া হয়।সে আরো জানায়, বৃহস্পতিবার যখন আমরা ভাসতে ভাসতে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের কাছে আসি তখন গোলমাল বাধে। রোহিঙ্গারা বন্দুক এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশিদের উপর হামলা চালায়। সেময় ট্রলারটি ডুবতে শুরু করলে ইন্দোনেশিয়ার মাঝিরা আমাদের এসে উদ্ধার করে।রোহিঙ্গারা আমাদের মারতে শুরু করলে অনেকেই বাঁচার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসময় একটি পানির ড্রামে আমি ভাসতে শুরু করি। আমার বন্ধু যে আমার সঙ্গে ছিল বেঁচে গেলেও এখন অসুস্থ।যদিও মোহাম্মদ তৈয়ব আলী নামের একজন রোহিঙ্গা অভিযোগ করেন বাংলাদেশিরা শিশু এবং বাচ্চাদের জন্য সংরক্ষিত খাবার নিতে চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে।এদিকে বাংলাদেশ হতে আফসারউদ্দিনের বড় ভাই জালালউদ্দিন তাদের তিন স্বজনের নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এই দুই ধরণের অভিবাসীরা অন্য দেশে পাড়ি জমায় দুই কারণে- মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এবং বাংলাদেশিরা দারিদ্রের অভিশাপ দূর করতে।এসএইচএস/আরএস/আরআইপি
Advertisement