এতটা একতরফা ম্যাচ হবে কেউ ভাবতেই পারেনি। বরং, সবারই ভাবনা ছিল, পাকিস্তানকে কত সহজে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা ধরে রাখে ভারত; কিন্তু সব হিসেব উল্টে দিয়ে উল্টো ভারতকেই বিধ্বস্ত করলো পাকিস্তান। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ৩৩৯ রানের বিশাল লক্ষ্য দিয়ে ভারতকে ৩০.৩ ওভারে ১৫৮ রানেই অলআউট করে দিল পাকিস্তান। ঐতিহাসিক জয়টি এলো ১৮০ রানের বিশাল ব্যবধানে।
Advertisement
অবিশ্বাস্য এই জয়ের মধ্য দিয়ে বিশাল একটি খরা কাটাল পাকিস্তান। আইসিসির কোনো ইভেন্ট মানেই ভারত পাকিস্তানের কাছে অধরা। এর আগে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে গিয়েছিল পাকিস্তান। এছাড়া ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মোট ১১বার মুখোমুখি হয়ে প্রতিবারই ভারতের কাছে হেরেছে পাকিস্তান।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অবশ্য অনুপাতটা পাকিস্তানের পক্ষে বেশি। কারণ, এ নিয়ে ৫বার মুখোমুখি হয়ে তিনবারই জিতেছে পাকিস্তান। সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে উঠে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে ভারতকে বিধ্বস্ত করলো সরফরাজের পাকিস্তান। মূলতঃ ব্যাট হাতে ফাখর জামান এবং বল হাতে মোহাম্মদ আমিরের দুর্ধর্ষ বোলিংয়ের কাছেই হেরেছে ভারত।
যদিও মোহাম্মদ আমির, হাসান আলি আর শাদাব খানের ত্রিমুখি আক্রমণে যখন ভারত নিশ্চিত পরাজয় দেখতে শুরু করেছিল, তখন একাই লড়াই করেন অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া। পাকিস্তানি বোলারদের ভয়ঙ্কর বোলিংয়ের মুখে একাই দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। শুধু তাই নয়, জুনায়েদ খান, হাসান আলি কিংবা শাদাব খানদের সমানে পেটালেন তিনি এবং ৩২ বলেই হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করেন শেষ পর্যন্ত ৪৩ বলে খেলেন ৭৬ রানের ইনিংস।
Advertisement
পান্ডিয়ার ইনিংস যেন বাতি নিভে যাওয়ার আগে হঠাৎ জ্বলে ওঠা। তেমনই একটা ইনিংস খেলে গেলেন তিনি। ৪টি বাউন্ডারির সঙ্গে মারেন ৬টি ছক্কার মার। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে ৭৬ রান করে রান আউট হয়ে যান পান্ডিয়া। তবে আউট হওয়ার পর সতীর্থ জাদেজার ওপর ক্ষোভ ঝাড়তেও দেখা যায় তাকে।
পান্ডিয়ার জ্বলে ওঠার আগে মোহাম্মদ আমিরের আসল রূপটা এতদিনে টের পেলেন বিরাট কোহলিরা! গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে এই আমিরকেই পিটিয়েছিলেন শিখর ধাওয়ান, রোহিত শর্মারা। সেই আমিরই এবার অন্য রূপে ধরা দিলেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কাছে। রীতিমত আতঙ্ক হিসেবে। মোহাম্মদ আমিরের পেস তোপেই যে থর থর করে কাঁপতে শুরু করে ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপ! শুধু তাই নয়, তার আক্রমণেই মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি ভারত।
টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ভারতের সামনে ৩৩৯ রানের বিশাল পাহাড় দাঁড় করিয়ে দেয় পাকিস্তান। জবাব দিতে নেমে শুরুতেই মোহাম্মদ আমিরের বিধ্বংসী বোলিংয়ের মুখে ফিরে গেলেন রোহিত শর্মা। এরপর বিরাট কোহলিকে ক্রিজেই দাঁড়াতে দিলেন না পাকিস্তানের এই বাঁ-হাতি পেসার। সর্বশেষ ইনিংসের ৯ম ওভারে ২১ রান করা শিখর ধাওয়ানকেও ফিরিয়ে দিলেন মোহাম্মদ আমির।
৩৩৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামার পর প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই রোহিত শর্মাকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখান মোহাম্মদ আমির। কোনো রানই করতে পারেননি আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করা এই ব্যাটসম্যান। প্রথম ওভারে মাত্র ২ রান তুলতে পেরেছে ভারত। নিজের দ্বিতীয় ওভারে এসে বিরাট কোহলিকে নাচিয়ে ছেড়েছেন আমির।
Advertisement
ওই ওভারের তৃতীয় বলেই কোহলিকে সাজঘরে ফেরাতে পারতেন তিনি; কিন্তু স্লিপে দাঁড়ানো আজহার আলির হাত ফসকে বল গড়ায় মাটিতে। জীবন পেয়ে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলেন না ভারতীয় অধিনায়ক।
পরের বলেই আউট কোহলি! আমিরের বলে ব্যাট চালাতে গিয়ে পয়েন্টে শাদাব খানের হাতে ধরা পড়েন টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক। ব্যক্তিগত ৩ রান করতেই ক্রিজ ছাড়েন কোহলি। দলকে রেখে যান ঘোর বিপদে!
৩৩৯ রানের লক্ষ্য ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় ভারত। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রোহিত শর্মা সবার আগে ফেরেন সাজঘরে। ৯১, ৭৮, ১২ ও ১২৩*; চলতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চার ইনিংসে রোহিততের রানের পরিসংখ্যান। ভারতীয় ওপেনার ব্যাট হাতে কতটা ভয়ঙ্কর, তা বলে দিচ্ছে এই পরিসংখ্যানই। ফাইনালেও তার ব্যাট হাসবে, এমন প্রত্যাশাই ছিল ভারতীয় সমর্থকদের।
কিন্তু রোহিতকে আগে বাড়তে দিলেন না মোহাম্মদ আমির। ইনজুরি কাটিয়ে ফেরা পাকিস্তানি এই পেসার শুরুতেই সাজঘরে ফেরালেন ভয়ঙ্কর রোহিত শর্মাকে। আমিরের করা দ্বিতীয় বলে ব্যাট চালাতে গিয়ে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন রোহিত। ভারতীয় এই ওপেনার খুলতে পারেননি রানের খাতাই।
এরপর শিখর ধাওয়ানকেও ফিরিয়ে দেন মোহাম্মদ আমির। ১৪তম ওভারের তৃতীয় বলে আমিরের দুর্দান্ত আউট সুইং বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে ব্যাটের খোঁচা দেন ধাওয়ান। সেটিই গিয়ে জমা পড়ে সরফরাজের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো পাকিস্তান শিবির।
প্রথম স্পেল শেষ করে আমিরকে একটু বিশ্রাম দেন যেন পাকিস্তান অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। আক্রমণে নিয়ে আসলেন তরুণ স্পিনার শাদাব খান আর পেসার হাসান আলিকে। আক্রমণে এসে তারাও চেপে ধরলেন ভারতকে। ১৩তম ওভারের শেষ বলে যুবরাজ সিংয়ের বিপক্ষে জোরালো এলবিডব্লিউর আবেদন করলেন শাদাব খান। আম্পায়ার নাকচ করে দিলেন সেটা।
কিন্তু রিভিউ চেয়ে বসে পাকিস্তান। তাতে দেখা গেলো বল ছিল একেবারে লাইনের ওপরে এবং মিডল স্ট্যাম্পেই বল আঘাত হানতো। ফলে আম্পায়ার নিজের ভুল শিকার করে নিলেন এবং আউট ঘোষণা করলেন যুবরাজকে। ৩১ বলে ২২ রান করে ভারতের ইনিংসটাকে মেরামত শুরু করেছিলেন তিনি; কিন্তু এলবির ফাঁদে কাটা পড়ে ফিরতে হলো তাকে।
এ পর্যায়ে ভারতের ভরসার নাম ছিল শুধুমাত্র মহেন্দ্র সিং ধোনি। কিন্তু যুবরাজ ফিরে যাওয়ার পর তিনিও যেন সাহস হারিয়ে ফেললেন। ১৪তম ওভারে হাসান আলির ৩য় বলে স্কয়ার লেগে বল তুলে দিলেন। ফিল্ডার ইমাদ ওয়াসিম দুর্দান্ত ভঙ্গিতে তালুবন্দী করে নিলেন ক্যাচটা। ৫৪ রানেই পড়লো ভারতের ৫ উইকেট। ১৬ বল খেলে ৪ রান করে আউট হন ধোনি। ১৪ ওভারের মধ্যে ৫৪ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে এখন রীতিমত পরাজয় দেখতে শুরু করে দিয়েছে ভারত।
ধোনির আউট হওয়ার পর রবীন্দ্র জাদেজাকে নিয়ে একটু আশার আলো জালিয়েছিলেন পান্ডিয়া। গড়েন ৮০ রানের জুটি। ৭৬ রান করে পান্ডিয়া রান আউট হয়ে গেলে সেই আশাও শেষ হয়ে যায়। রবীন্দ্র জাদেজাকে তুলে নেন জুনায়েদ খান, বাবর আজমের হাতে ক্যাচে পরিণত করে। আউট হওয়ার আগে ১৫ রান করেন তিনি। এরপর অশ্বিনকে ১ রানে ফেরত পাঠন হাসান আলি।
৩১তম ওভারের তৃতীয় বলে সরফরাজের হাতে জসপ্রিত বুমরাহকে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন হাসান আলি। সঙ্গে সঙ্গেই বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো পাকিস্তান শিবির। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে প্রথমবারের মত উঠেই শিরোপা জিতে নিলো পাকিস্তান।
মোহাম্মদ আমির আর হাসান আলি নেন ৩টি করে উইকেট এবং শাদাব খান নেন ২ উইকেট। ১টি নেন জুনায়েদ খান এবং বাকিটি হলো রানআউট।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
পাকিস্তান: ৫০ ওভারে ৩৩৮/৪ (আজহার ৫৯, জামান ১১৪, বাবর ৪৬, মালিক ১২, হাফিজ ৫৭*, ওয়াসিম ২৫*; ভুবনেশ্বর ১/৪৪, বুমরাহ ০/৬৮, অশ্বিন ০/৭০, পান্ডিয়া ১/৫৩, জাদেজা ০/৬৭, কেদার ১/২৭)।
ভারত: ৩০.৩ ওভারে ১৫৮ (রোহিত ০, ধাওয়ান ২১, কোহলি ৫, যুবরাজ ২২, ধোনি ৪, কেদার ৯, পান্ডিয়া ৭৬, জাদেজা ১৫, অশ্বিন ১, ভুবনেশ্বর ১*, বুমরাহ ১; আমির ৩/১৬, জুনায়েদ ১/২০, হাফিজ ০/১৩, হাসান ৩/১৯, শাদাব ২/৬০, ওয়াসিম ০/৩, জামান ০/২৫)।
ফল: পাকিস্তান ১৮০ রানে জয়ী। ম্যাচ সেরা : ফাখর জামান, টুর্নামেন্ট সেরা : হাসান আলি। সর্বাধিক রান : শিখর ধাওয়ান, ৩৩৮, (ভারত)। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি : হাসান আলি, ১৩ (পাকিস্তান)।
আইএইচএস/