প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা সমালোচনা এখনো চলছে। কর্মসংস্থানের কি দিকনির্দেশনা আছে তা এখনো পরিষ্কার নয় তবে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দেশীয় বেশ কিছু শিল্পের সুরক্ষার প্রস্তাবনা আছে বাজেটে।
Advertisement
দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। মোট দেশজ উৎপাদন-(জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানে পোশাক শিল্প বরাবর বড় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হলেও নতুন প্রযুক্তির কারণে এ খাতেও কর্মসংস্থান স্থবির। অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের শ্রমবাজার বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে সামষ্টিক কর্মকৌশল প্রণয়নের তাগিদ আছে নানা স্তর থেকে। ২০০৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ২ দশমিক ৭ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বাড়লেও ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এর হার নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮ শতাংশে। পোশাক খাতে নতুন নিয়োগ কার্যত বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কর্মরত আছেন। শ্রমজীবী তিন নারীর মধ্যে অন্তত একজন কাজ করেন পারিশ্রমিক ছাড়া।
সমস্যা চিহ্নিত করে শ্রমবাজারের পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা করা দরকার। দরকার পরিকল্পিত নগরায়ণ, শ্রমের গতিশীলতা ও উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব দেয়া। বাংলাদেশে জনসংখ্যার বোনাসকাল চললেও এর সুফল মিলছে না। সরকারি খাতে কর্মসংস্থার স্থবির থাকায় মূল ভূমিকা নিতে হবে বেসরকারি খাতকেই। কিন্তু ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ জিডিপি’র ২২/২৩ শতাংশে আটকে আছে নয় বছর ধরে।
প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায় একের পর এক কারখানা। কর্মহীন হয়ে পড়ে অসংখ্য শ্রমিক-কর্মচারী। বন্ধ কারখানার জমিতে গড়ে উঠে আবাসন। কর্মহীন মানুষগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। পরিসংখ্যানর ব্যুরোর বেকারের যে হিসাব, তার মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি। এখন এদেশের শিক্ষিত তরুণ আর মান সম্পন্ন কাজ নয়, কোন রকমে একটা কাজ চায়। বেসরকারি বিনিয়োগে বন্ধ্যাত্ব এটা স্থবির অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
Advertisement
আমাদের প্রবৃদ্ধি আছে, কর্মসংস্থান কমেছে। তাহলে জবলেস গ্রোথ বা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির পথে দেশ। যদি তা-না হয় তবে দীর্ঘ মেয়াদে কতটা স্বস্তি দিবে এই প্রবৃদ্ধি? শিক্ষিত মানুষের বেকারত্ব আসলে সম্পদের অপচয়। দেশের তারুণ্যের এক তৃতীয়াংশ যদি কর্মহীন থাকে তবে প্রবৃদ্ধি দিয়ে উন্নয়ন হবে কতটুকু? ১৬ কোটির দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ১৮.৮ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি। বছরে ৩০ লাখ যুবকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, সেটা চাকরি কিংবা ব্যবসা যাই হোক না কেন।
দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২৬-৩০ লাখ যুবক প্রবেশ করে। সরকার প্রতি বছর নিয়ম করে কিছু চাকরির ব্যবস্থা করে। কিন্তু বিপুল চাহিদার বড় অংশই প্রত্যাশা করে বেসরকারি খাতের কাছে। কিন্তু সেখানে এখন কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই। শুধু চাকরি নয়, আত্মনির্ভরতার কথা বলেন অনেকেই। কিন্তু আত্মনির্ভর হতে গেলে ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসায়ের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় সব শ্রেণির বেকার ব্যবসায়ে আগ্রহী হয় না। তাছাড়া ব্যবসায়ের জন্য পুঁজির প্রয়োজন যা ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায় না। ফলে নতুন উদ্যেক্তা তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী চাকরির প্রতি তাই বেশি আগ্রহী। কিন্তু প্রতিবছরই কমছে সেই সুযোগ।
সরকার প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের কথা বেশ জোরেশোরেই বলছে। পোশাকশিল্প নির্ভর রপ্তানি বাজারে গতি আছে, তাই আর কোন খাত নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবার দরকার নেই। অল্প কিছু মানুষ ভাল আছে, তাদের জন্য সম্ভোগশিল্প ও সেবার বিপুল বিস্তার। তাদের বেতন বাড়লো, এরা সাচ্ছল্যের মুখ দেখলেন, আরাম-ব্যসনে অভ্যস্ত হলেন, ক্রিকেট খেলায় মাতলেন। অন্যপক্ষে বেশির ভাগ মানুষের আয় ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। সরকারকে ঘিরে যে পণ্ডিতবর্গ বিরাজ করেন তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু, জাতীয় উপার্জনের বার্ষিক হার কোন স্তরে থাকবে, কত দশমিক কত হবে, তা নিয়ে। নতুন অর্থনীতির পরিণামে লক্ষ্মীছাড়া গরিবদের সংখ্যা কত বাড়লো তা আলোচনার দরকার কী?
গোটা শিল্পব্যবস্থা সংকীর্ণতর হচ্ছে। কর্মসংস্থান সেই তিমিরেই। দেশে বিদেশে রোড-শো হয়, কিন্তু এসব শোতে যেতে আসতে যে খরচ হয় সেই প্লেন ভাড়া উঠে কিনা তারও জবাবদিহিতা নেই। সরকারের পরম নির্লিপ্ত ভাব, অর্থমন্ত্রণালয় ও মুদ্রা ব্যবস্থার সর্বেসর্বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন ভাবনা চোখে পড়েনা কি করে বিনিয়োগ চাঞ্চল্য আনা যায়। শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলে সুযোগসন্ধানী মানুষের হাতে সর্বস্ব হারালেন সাধারণ মানুষ। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দূরস্থান। জমি, গ্যাস আর বিদ্যুতের সমস্যায় যারা ব্যবসা-বাণিজ্য আর শিল্পে আছেন, তারাই পালাবার পথ খুঁজছেন। অভূতপূর্ব, ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, কিন্তু সরকার ধ্যানমগ্ন। আমলাতন্ত্র আর কিছু মানুষ সম্ভোগে ব্যস্ত, ঝলমল করে বাজে রাস্তার উপর দাঁড়ানো রেস্তোরাঁ, আনন্দ-হুল্লোড় হয়। যেন কোনও ব্যথা নেই পৃথিবীতে।
Advertisement
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার হতাশাব্যঞ্জক। বিনিয়োগ বাড়িয়ে সেটা কিছুটা সামাল দেয়া সম্ভব। কিন্তু তার লক্ষণ নেই। আমলাতন্ত্রের মারপ্যাঁচে, অবকাঠামোর পুঁজি খাটিয়ে কেন ব্যর্থমনোরথ হতে যাবেন শিল্পোদ্যোক্তারা? দেশে অর্থব্যবস্থা একটি শ্বাসরোধকারী বৃত্তের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেছে। লুটপাটে আর্থিক খাত বিধ্বস্ত। উৎপাদন-শিল্পের উন্নতির জন্য যা প্রথম প্রয়োজন, তার নাম পরিবেশ। বিনিয়োগের পরিবেশ। বাংলাদেশে এই বস্তুটির সবিশেষ অভাব। বিশেষত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য। এই দেশে খাতায় কলমে লাইসেন্স রাজ্যের অবসান হলেও, আসলে হয়নি। ফলে, কোনও একটি শিল্প গড়তে হলে বিনিয়োগকারীকে কত যে পথ পেরোতে হয়, কত যে আইনের দাবি মেটাতে হয় তা যারা ভুক্তভোগী কেবল তারাই জানেন।
স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের পক্ষে অর্থায়নের ব্যাংকের জটিল সব চাহিদা, অবকাঠামো সুবিধার জন্য দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা মহা বিড়ম্বনা। বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা এই কাজ করবার জন্য আলাদা লোক রাখতে পারেন। মার খায় ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলি। বক্তৃতায় মন্ত্রীরা যতই বলেন ক্ষুদ্র, মাঝারি বিনিয়োগকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে, তাদের জন্য অধিক যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে, বাস্তবে তার অনুপস্থিতি ততই বেশি।
সন্তুষ্টি কেবল প্রবৃদ্ধি নিয়ে যা হয়েছে সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়ানোয়, রেমিট্যান্স আর পোশাক রপ্তানির কারণে। কিন্তু সেই পোশাক খাতও কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি দিতে পারছে না, বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে টালমাটাল জনশক্তি রপ্তানি খাত। অর্থনীতিতে যে ধরনের বৈচিত্র্যায়ণ দরকার, যার মাধ্যমে অধিক সংখ্যক মানুষকে কর্মসংস্থান দেয়া যাবে, সেখানে বড় ধরনের বিচ্যুতি আছে। এজন্য রফতানি বৈচিত্র্যকরণ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। দক্ষ শ্রমিক বাড়াতে হবে। রাজস্ব নীতি, প্রণোদনা, রেগুলেটরি পলিসি, ব্যবসা করার খরচ কমাবার চেষ্টা আছে কী? লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/জেআইএম