বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি। ঘরের পেছনে মাটির টুকরো পড়েছে। খাওয়া দাওয়া তাড়াতাড়ি শেষ কর। দুপুরেও মাটিগুলো পরিষ্কার করতে পারিনি। তাই রাতে খাওয়ার পরে তোর বাবাকে নিয়ে মাটিগুলো পরিষ্কার করব।এই বলে সুমি বড়ুয়া তার সন্তানদের ভাত খেতে দেন। সবার ভাত খাওয়া শেষে সুমি ও তার স্বামী স্বপন ঘরের পেছনের মাটি পরিষ্কার করতে লাগলেন। সেই সঙ্গে তিন সন্তান মায়ের আশ্বাস পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।সোমবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে স্বামী স্বপন আর সুমি ঘরে ঢুকে পড়া মাটি পরিষ্কার করতে লাগলেন। সুমির তিন সন্তান। তিন জনের বয়স ১০ বছরের নিচে। বড় সন্তানের নাম মিতু আদর করে সবাই ডাকতেন সেতু বড়ুয়া, আর মেজ ছেলের নাম ছিল হৃদয় তার ডাক নাম শুভ বড়ুয়া আর সবার ছোট লতা। এই তিন সন্তানকে নিয়ে স্বপন আর সুমির সুখের সংসার। বান্দরবানের লেমুঝিড়ি আগাপাড়া গ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে টিনের চালা দিয়ে তৈরি ছোট একটা কুটিরে তারা সুখে বসবাস করতেন। চারপাশের পাহাড় আর সবুজের মাঝখানেই তাদের বসবাস। বাড়ির আঙিনায় ছোটাছুটি করত হাসি মাখা তিনটি মুখ।সুমির ভাষ্য, মেয়েদের ঘুমিয়ে পড়ার পরে আমরা মাটি পরিষ্কার করতে থাকি। কিন্তু মাটি পরিষ্কার করতে করতে দেখি বড় মাটির খণ্ড আমাদের টিনের চালে পড়ছে। আর আমি আর আমার স্বামীকে প্রায় ২০ ফুট দূরে ঠেলে নিয়ে যায় মাটি। আর মাটিতে তলিয়ে যায় ঘুমিয়ে থাকা আমার সোনার টুকরা সন্তানেরা। যাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার সব স্বপ্ন শেষ। আমার সন্তানদের কেড়ে নিয়েছে সৃষ্টিকর্তা। ফিরিয়ে দাও আমার সন্তানদের।বলতে বলতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন সুমি। যে স্বপ্ন নিয়ে তার তিন সন্তানকে গড়ে তুলার স্বপ্ন দেখেছিল সেই লালিত স্বপ্ন ধ্বংস করে দিল পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটি।সুমি আরও বলেন, তিন সন্তানকে ঘুমিয়ে যেতে বললাম। কিন্তু এই ঘুম যে শেষ ঘুম হবে সেটা জানতাম না। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল থেকে কাদায় তলিয়ে থাকা তিন সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করে দমকল বাহিনীর সদস্যরা। সারা শরীরে কাদায় ভরা তিন সন্তানের মরদেহ দেখে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন সুমি।আর পাহাড় ধসে সুমি কম আঘাতগ্রস্ত হলেও বেশি আঘাতগ্রস্ত হয়েছিলেন তার স্বামী স্বপন। তাই উদ্ধারকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন।হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা স্বপন বলেন, আমি কি নিয়ে বাঁচব? আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমারা সন্তানেরা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।৭৫ বছর ছুঁই ছুঁই সুমি বড়ুয়ার বাবা লাল মোহন আর্তনাদ করে বলেন, বহুবার তাদের বলেছিলাম ঘর ছেড়ে চলে যেতে। মেয়ে আমার কথা শুনেনি। নাতি-নাতনিদের আমার বাড়িতে এনে রাখতে বলেছিলাম শুনেনি। আজ আমার কথা শুনলে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না । গত সোমবার বান্দরবানের পৃথক স্থানে ঘরে পাহাড়ে মাটি ধসে পড়ে নারী ও শিশুসহ ছয়জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে সুমির তিন সন্তানও রয়েছে।দুদিনের টানা বর্ষণে রাঙামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে এবং গাছ চাপায় ১৪৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন সেনা সদস্যও রয়েছেন।এএম
Advertisement