কিছুদিন আগে ঘূর্ণিঝড় মোরায় সর্বোচ্চ সতর্কতা সংকেত থাকায় প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ধসের ঘটনায় কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা সংকেত কিংবা পূর্বাভাসের ব্যবস্থা না থাকায় নিহতের সংখ্যা দেড়শ ছাড়িয়েছে। কোনো ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় সবুজ শ্যামল পাহাড়ে তিনদিন পরও মিলছে নতুন মরদেহের সন্ধান।সম্প্রতি পাহাড়ধসের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১৫৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রাঙামাটিতেই সর্বোচ্চ ১১১ জন, বান্দরবানে ছয়জন, কক্সবাজারে দু’জন, খাগড়াছড়িতে দু’জন এবং চট্টগ্রামে ৩৪ জন রয়েছেন।
Advertisement
বৃহস্পতিবার সকালে নিখোঁজ এক সেনা সদস্যসহ আরও চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবারের পাহাড়ধসের ঘটনায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ২০ থেকে ৩০ জন। উদ্ধার অভিযান চলছে।
গত ১০ বছরের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় পাহাড়ধসের ঘটনা। এর আগে বড় ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওইবার একদিনে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ১২৭ জন মারা যান। ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৫৮ এবং ২০১২ সালে পাড়ারধসে ৮৬ জনের মৃত্যু হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি বছর এ ধরনের ভূমিধসের ঘটনা ঘটলেও তা প্রতিরোধ এবং প্রাণহানি কমাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা সরকারের নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘূর্ণিঝড় বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পূর্বাভাসের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। এ বিষয়ে কোনো গবেষণাও হয়নি।
Advertisement
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক এস এম কামরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রস্তুতি নিয়ে পাহাড়ধস রোধ করা সম্ভব। সাইক্লোনসহ বড় যেসব দুর্যোগ হয় সেগুলো মোকাবেলায় পূর্ব সতর্কতার পদ্ধতি আছে। কয়েকদিন আগে ‘মোরা’ নিয়ে মিনিস্ট্রি, নাগরিক সমাজ, লোকজন খুবই সচেতন ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আগে থেকে পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ক্ষয়-ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। কিন্তু ভূমিধসে মাত্র পাঁচ জেলায় প্রায় দেড়শ মানুষ মারা গেল! এর অন্যতম কারণ হলো ভূমিধসের ব্যাপারে আমাদের পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না থাকা।’
তার মতে, ‘আমরা খুবই অসচেতন। সরকারও পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন করেনি। এছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণাও হয়নি কী কারণে, কী পরিমাণ ভূমিধস ঘটতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অপরিকল্পিত বসবাসই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধসের অন্যতম কারণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব জায়গায় ভূমিধস হচ্ছে সেখানে বাঙালি সেটেলারদের বসবাস। গত ৩০ বছরে এসব এলাকায় পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। পাহাড়ধস প্রতিরোধে পাহাড় কেটে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন বন্ধ করতে হবে। ভূমিধস কিংবা পাহাড়ধসের ব্যাপারে পূর্ব সতর্কতামূলক একটি প্রযুক্তিগত সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে।’
Advertisement
একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এটা ভালনারেবল এরিয়া (অরক্ষিত এলাকা)। আমাদেরই সচতেন হতে হবে, যাতে ওই এলাকায় আমরা বসবাস না করি।’
‘প্রতি বছর পাহাড়ধসে অসংখ্য প্রাণহানির জন্য রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় প্রশাসনই দায়ী’ বলে মনে করেন চট্টগ্রামের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী অধ্যাপক ইদ্রিস আলী।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার বানেভাসা মানুষদের এনে পাহাড়ের পাদদেশে ঘর তুলে থাকার জন্য ভাড়া দেয়া হয়। বস্তির এসব ঘরে কম ভাড়া হওয়ায় জীবনের ঝুঁকির নিয়ে সবকিছু হারানো মানুষগুলো আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। একটা শ্রেণি সেখান থেকে ভাড়া আদায় করে। অন্য শ্রেণি সেই টাকা ঘরের সোফায় বসে ভাগ পায়। এসবই হয় রাজনীতিবিদদের প্রভাবে। এক সময় তারা সেসব পাহাড় পুরোপুরি দখল করে ফেলে।’
‘এ জন্য প্রশাসন দায়ী’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন সবকিছু দেখেশুনেও চুপ থাকে। শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমের আগে নামমাত্র অভিযান চালায়। যাতে আসলে কোনো ফল আসে না।’
‘আগামী কয়েক বছরে চট্টগ্রাম পাহাড়শূন্য হবে’- এমন আশঙ্কা করে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালুর পরিমাণ বেশি। সেখানে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় কখনও বনায়ন হয়নি। যেসব গাছ আগে ছিল সেগুলোও কমছে। চট্টগ্রামে প্রায় একশর মতো পাহাড় ছিল। গত দুই দশকে প্রায় ৪০টির মতো পাহাড় দখল করে সমতলে পরিণত করা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক দশকে চট্টগ্রাম পাহাড়শূন্য হবে।’
জেপি/আরএস/এমএআর/আরআইপি