কাতারের ওপর অাকস্মিক যে চোট পড়েছে তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত মে মাসে রিয়াদে ‘তলোয়ার নৃত্য’র সময়ই ঠিক করা হয়েছিল। এটা যে পূর্বপরিকল্পিত তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সফরে আসার আগে এই অঞ্চলের ব্যাপারে ভালোভাবে অবগত ছিলেন না ট্রাম্প।
Advertisement
সফরের আগেই সৌদি আরব ও আবু ধাবির দুই যুবরাজ আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের হাল-চাল সম্পর্কে ট্রাম্পকে ধারণা দেন। তাই তিনি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে একান্ত আলোচনায় কী বিষয়ে কথা বলবেন সেবিষয়েও ধারণা পান। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র কাতার সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের মূল হোতা বলে জানানো হয় ট্রাম্পকে। এ ধরনের তথ্য পাওয়ার পরও তিনি কাতারের কাছে মার্কিন অস্ত্রের সুন্দর বাণিজ্যের প্রত্যাশা পুনর্ব্যক্ত করেন।
সম্ভবত কেউ তাকে বলেননি যে, সৌদি অারব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও কাতারের মতো একই শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। তবে একটি বিষয় নিয়ে সন্দেহ আছে। সেটি হলো তিনি হয়তো জানতেন না যে, এই অঞ্চলে একমাত্র কাতারেই সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
এর কিছু পরেই কাতারি সংবাদ মাধ্যমে আমির শেখ তামিমের বরাত দিয়ে বলা হয়, ইরানের প্রতি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরোধীতা অন্যায্য। কাতারের সংবাদমাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়। তবে উভয় বিষয় নিয়ে উদ্বেগের অবকাশ রয়েছে। সংবাদমাধ্যম হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছিল বলে দোহা তাৎক্ষণিকভাবে দাবি করে। পরবর্তীতে মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (এফবিআই) সহায়তায় তদন্ত শুরু করে কাতার। এফবিআই জানায়, কাতারি সংবাদমাধ্যম হ্যাকিংয়ের জন্য রুশ হ্যাকাররা দায়ী। সম্ভবত সরকারি কোনো রুশ সংস্থা ফ্রিল্যান্সার হ্যাকারদের ভাড়া করে এ কাজ করেছিল।
Advertisement
এর পর পরই সৌদি অারব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর, ইয়েমেন (দেশটির সরকারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে) এবং লিবিয়া (দেশটির আংশিক শাসনের দাবিকারী সরকার) কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
কাতার এ ধরনের ঝামেলার মুখোমুখি তিন বছর আগেও হয়েছিল। কিন্তু এবারের সংকট আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবারে এটি শুধুমাত্র অবরুদ্ধ কিংবা কারাবন্দীর সমতূল্যই হয়ে পড়েনি বরং যন্ত্রণার মধ্যেও পড়েছে দেশটি।
শুধুমাত্র কূটনীতিকরাই নন বরং সব কাতারি নাগরিকরাই ওই দেশগুলো বহিষ্কৃত হওয়ার আদেশ পেয়েছেন। কাতারের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে দেশটিতে খাদ্য সরবরাহ ৪০ শতাংশ কমেছে। এছাড়া পরিবারগুলো বিভক্ত হয়ে পড়েছে, আমদানি নির্ভর দেশটিতে চরম খাদ্য ঘাটতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তবে প্রয়াজনীয় খাদ্য সামগ্রী কেনার পর্যাপ্ত সম্পদ আছে কাতারের।
মূল ঘটনা হচ্ছে, দেশটি সৌদি আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। যে প্রক্রিয়ায় সৌদি আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে তা বিশ্বের চোখে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে হওয়া উচিত। কিন্তু মার্কিন অস্ত্রের অন্যতম ক্রেতা কাতারের এ প্রক্রিয়া সৌদি আরব এমনকি আমিরাতের সঙ্গে মিলে না।
Advertisement
যদিও মজার বিষয় হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদির অবস্থানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকটে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনসহ অন্যান্য কম নির্বোধ সদস্যরা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছেন।
আল-কায়েদা ও এর অনুসারী সিরিয়ার জাবহাত আল-নুসরার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলাকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ শুধুমাত্র কাতারের বিরুদ্ধে নয়। আল-কায়েদা এবং আইএসকে অর্থায়নে একই ধরনের অভিযোগ আছে সৌদির বিরুদ্ধেও। অর্থায়নের এই সন্দেহ পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
তবে সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানসহ হিজবুল্লাহ, হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনকে কাতারের সমর্থন নিয়ে রিয়াদের উদ্বেগই বেশি দেখা যায়। লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, হিজবুল্লাহ এবং হামাস সৌদি আরবের জন্য সরাসরি কোনো হুমকি নয়। এ দুই সংগঠনই লেবানন এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি নীতির ফল এবং ইসরায়েলের শত্রু।
এটা কি কেবলমাত্র একটি কাকতালীয় বিষয় যে, ইরানকে প্রতিহত করতে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদির মনোভাব মিলে গেছে? এছাড়া আরেকটি দাবি আছে যে কাতারকে অবশ্যই আল-জাজিরা টেলিভিশন নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, যদি বন্ধ করা না হয়। কাতারের এই টেলিভিশন চ্যানেলটি বিভিন্ন ইস্যুতে মাঝে মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যে হইচই ফেলে দেয়। মিসরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির ঘৃণার পাত্র কাতারের এই চ্যানেলটি।
মধ্যপ্রাচ্যের এই নজিরবিহীন সংকটে কাতারের পাশে দাঁড়ানোর প্রস্তাব এসেছে ইরান, তুরস্কের কাছে থেকে। কাতারকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে এ দেশ দুটি। কাতারের জবাব দেয়ার অনেক কিছুই আছে কিন্তু কপটাচারী সৌদি আরব বিচারকের ভূমিকায় খুব কমই উপযুক্ত।
সূত্র : ডন, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।
এসআইএস/পিআর