খেলাধুলা

ভারতকে হারানোর সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের

স্বপ্নের ফাইনাল হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ক্রিকেট বিশ্বের আট শীর্ষ ও অভিজাত দলের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের খুব কাছাকাছি এখন মাশরাফির দল। আর একটি মাত্র সিঁড়ি, সে ধাপ অতিক্রম করতে পারলেই ফাইনালে পৌঁছে যাবে আগামীর ক্রিকেট সম্ভাবনা ‘বাংলাদেশ’।

Advertisement

সিঁড়ি বা ধাপ, যাই বলা হোক না কেন, তা টপকাতে হলে ভারতকে হারাতে হবে। যদিও একটি মাত্র সিঁড়ি; কিন্তু সেটা যে আর আট-দশটা সিঁড়ির মতো নয়! অনেক লম্বা-চওড়া আর খাড়া। কাজেই তা অতিক্রম করা সহজ নয়। বেশ কঠিন।

এক কথায় রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষা। টাইগাররা সে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে? ফাইনাল যতই হাতছানি দিয়ে ডাকুক, সেমির লড়াইয়ে ভারতকে হারানোর সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের?

বিরাট কোহলির বাহিনীর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবে মাশরাফির দল? রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনি, রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দন অশ্বিন, হারদিক পান্ডিয়া আর ভুবেনেশ্বর-উমেশ যাদবদের ব্যাট ও বলের লড়াইয়ে হারাতে সুসজ্জিত দল, প্রয়োজনীয় রসদ ও কার্যকর অব্যর্থ অস্ত্র দরকার। মাশরাফি, তামিম, সৌম্য, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ, মোস্তাফিজদের মধ্যে কি তা আছে?

Advertisement

১৫ জুন (বৃহস্পতিবার) যত এগিয়ে আসছে কোটি বাংলাদেশ ভক্ত-সমর্থকের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন, স্বাধ, ইচ্ছা তত প্রবল হচ্ছে। পাশাপাশি উপরের প্রশ্নগুলোও কিন্তু কারও কারও মনে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে।

গোটা দেশ প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বিশ্ব আসরের সেমিফাইনালে খেলার আনন্দে উদ্বেলিত, ফাইনালে ওঠার স্বপ্নে বিভোর। এটা যেমন ঠিক, পাশাপাশি একটা অস্ফুট সংশয়ও আছে। সে সংশয় মাখা প্রশ্ন ওঠা মানেই যে টিম বাংলাদেশ দুর্বল, মাশরাফি বাহিনীর সামর্থ্য সীমিত তাও নয়।

আসলে ক্রিকেটীয় যুক্তি, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় ভারতকে এগিয়ে রাখা ছাড়া উপায়ও নেই। সব হিসাব ও সমীকরণে ফেবারিট ভারত। বাংলাদেশ ‘আন্ডারডগ’। কোটি ভক্ত যতই ১৫ জুন সেমির লড়াইয়ে ভারতীয়দের হারানোর স্বপ্নে বিভোর থাকুক না কেন, কঠিন সত্য হলো ওই লড়াই শুরুর আগে সব ক্রিকেট পন্ডিত, বোদ্ধা-বিশ্লেষক বিরাট কোহলির দলকেই এগিয়ে রাখছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, ভারতের এ সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দলকে হারানোর সামর্থ্য কি আছে বাংলাদেশের? ‘না নেই- সেটাও বলা যাবে না। আছে। অবশ্যই আছে। সেটা কিন্তু শুধু কাগজে কলমের হিসাবেই নয়, বাস্তবেও আছে।

Advertisement

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র দুই বছর আগে ২০১৫ সালের এই জুনে ভারতকে ঘরের মাটিতে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে সে সত্যই প্রতিষ্ঠা করেছে টাইগাররা। ‘আমরা ভারতকে হারাতে পারি। ভারতীয়দের হারানোর পর্যাপ্ত শক্তি ও সামর্থ্য আছে আমাদের।’ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মাশরাফি বাহিনী। সময়ের ফারাক মাত্র দুই বছর।

তখনকার ভারত এখনকার দলের চেয়ে কমজোরি ছিল, তাই হারানো গেছে- এমন ভাবনার কোনো কারণ নেই। এমন চিন্তার পক্ষে একটি ক্রিকেটীয় যুক্তিও খাটবে না। কারণ ব্যক্তিগত দক্ষতা, মুন্সিয়ানা, মেধা এবং সামর্থে্যর তুলনা করলে এবার বিরাট কোহলির নেতৃত্বে যে দলটি চ্যাস্পিয়ন্স ট্রফি খেলছে, তার চেয়ে দুই বছর আগে টাইগারদের কাছে হার মানা দলটি মোটেই দুর্বল-কমজোরি ও অনভিজ্ঞ ছিল না।

মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ওই দলেও রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, বিরাট কোহলি, আজিঙ্কা রাহানে, রবিচন্দন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজা, ভুবেনেশ্বর কুমার এবং উমেষ যাদবের মতো পারফরমাররা ছিলেন।

সেই দল প্রথম দুই খেলায় মাশরাফি বাহিনীর নজরকাড়া পারফরম্যান্সের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, রাহানে, ধোনির মতো বিশ্বমানের তারকা ব্যাটসম্যানরা মোস্তাফিজের বিষাক্ত সুইং, কাটার আর স্লোয়ারের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিল।

প্রথম দুই ম্যাচে মোস্তাফিজ (৫/৫০ + ৬/৪৩) = ১১ উইকেট দখল করে ভারতীয় ব্যাটিংয়ে ধস নামান। মোস্তাফিজের বোলিং তোড়ের মুখে প্রথম দুই ম্যাচে ভারতের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ২২৮। অন্যদিকে তামিম, সৌম্য, সাকিব, মুশফিক ও সাব্বিরা বুক ফুলিয়ে ব্যাট করেছেন। তাদের সাহস, আস্থা আর আত্মবিশ্বাসের মিশেলের ব্যাটিংয়ের পথে ভুবেনেশ্বর কুমার, উমেষ যাদব, অশ্বিন আর রবীন্দ্র জাদেজা এতটুকু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি।

কাজেই তখন পারলে মাশরাফি, তামিম, সৌম্য, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ এবং মোস্তাফিজরা এখন কেন পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, সেটা দুই বছর আগের কথা। এ দীর্ঘ সময়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এমনকি গঙ্গায়ও অনেক পানি গড়িয়ে গেছে।

তাছাড়া ভেন্যু আলাদা। পরিবেশও ভিন্ন। আর ভারতীয় দলও সময়ের প্রবাহমানতায় আরও সমৃদ্ধ, আরও শক্তিশালী। দুই বছর আগে ঢাকায় বাংলাদেশের কাছে হার মানা দলটির শক্তি ও সামর্থ্য বেড়েছে আরও। ব্যাটিংটা আগের মতোই আছে। ধার বেড়েছে বোলিংয়ের। সব মিলে টিম ইন্ডিয়ার আসলেই শক্তি বেড়েছে। একটা আদর্শ ওয়ানডে দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে এখন কোহলির দল।

ব্যাটিং এবং বোলিং- দুয়ে মিলে ভারত সত্যিই দারুণ একটি দল। প্রতিপক্ষ হিসেবেও বেশ কঠিন। তাই বলে যে তারা দূর্দমনীয়, তাদের হারানো যাবেই না- এমন নয়। ভুলে গেলে চলবে না কোহলি-ধোনিরাও কিন্তু মানুষ। অতিমানব নন। তাদের সামর্থে্যরও একটা পরিসীমা আছে। তাদেরও খারাপ দিন যায়। গেছে। সামনেও যাবে।

এ দলটিও যে খুব ভালো খেলতে খেলতে একদিন মুখ থুবড়ে পড়বে না, বা পড়েন না- তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এই তো গ্রুপ ম্যাচে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে সহজে হারালেই একই দল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৩২১ রানের বড়সড় পুঁজি নিয়েও হেরেছে। কাজেই মাশরাফির দল ভারতীয়দের হারাতে পারবে না, তেমন নয়।

টিম বাংলাদেশের অবশ্যই সামর্থ্য আছে ভারতকে হারানোর। সে সামর্থে্যর প্রমাণ তারা অতীতে দিয়েছে। আগামীতেও দেবে। বাংলাদেশের তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম আর মাহমুদউল্লাহও কিন্তু গত দুই বছরে অনেক উন্নতি করেছেন। পরিসংখ্যান সে সাক্ষীই দিচ্ছে। তাদের যেকোনো পরিস্থিতিতে হাল ধরার সামর্থ্য বেড়েছে।

তামিম নিজের রূপ পাল্টে এখন অনেক বেশি দায়িত্ব সচেতন। দলকে একটা লম্বা ইনিংস উপহার দেয়ার চেষ্টা থাকে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে গত দুই বছর তার ব্যাট থেকে সবচেয়ে বেশি রান এসেছে। সবচেয়ে বেশি শতরান ও অর্ধশতকও হাঁকিয়েছেন তামিম।

পরিশ্রমি আর অধ্যবসয়ী মুশফিক এখন নির্ভরতার প্রতিমূর্তি। উইকেটে সেট হতে পারলে তার ব্যাটও অনেক বিশ্বস্ত। আর মাহমুদউল্লাহ তো বিপদের বন্ধু। সংকটে ভালো খেলা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। তারচেয়ে বড় কথা নিজেকে ঘষে মেজে অনেক উন্নত করা মাহমুদউল্লাহর বিগ ম্যাচ টেম্পারমেন্ট বেড়েছে অনেক।

তাইতো ২০১৫’র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সাথে বড় ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পর এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের সাথে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি করেছেন। তবে সে তুলনায় অধিনায়ক মাশরাফি, প্রাণ ভোমরা সাকিব আল হাসান ও কাটার মাস্টার মোস্তাফিজ- এ তিনজন আগের তুলনায় একটু ম্লান।

এক সময় ভারতের ত্রাস ছিলেন মাশরাফি। ভারতের সাথে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম জয়ের নায়ক ও রূপকার মাশরাফি। ২০০৭ সালে বিশ্বকাপে ভারত হেরেছিল আসলে নড়াইল এক্সপ্রেসের বিধ্বংসী (৪/৩৮) বোলিংয়ে।

কিন্তু অধিনায়কের সাম্প্রতিক বোলিংয়ে আগের সেই ধার অনুপস্থিত। মেধা-প্রজ্ঞার সাথে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা খাটিয়ে ব্যাটসম্যানকে বেঁধে রাখার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন ভালোই। যে কারণে তার বলে তেমন রান উঠছে না; কিন্তু আগে যেমন বল হাতে আগুন ঝরিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটিং লাইনআপকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিতে পারতেন, এখন মাশরাফির বলে সেই বারুদটা আর নেই। আর দুই বছর আগে সিরিজ বিজয়ের অন্যতম রূপকার মোস্তাফিজও কাঁধের অপারেশনের পর সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না। কাটার ধরছে খুব কম। স্লোয়ারেও কাজ হচ্ছে না তেমন।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট হাতে সামর্থে্যর সত্যিকার প্রমাণ দিয়ে হারা ম্যাচ জেতালেও অলরাউন্ডার সাকিবের কাছ থেকে ‘চ্যাম্পিয়ন সাকিবের’ সার্ভিস মিলছে না। বিশেষ করে বোলিংটা একটু কমজোরি মনে হচ্ছে।

কিন্তু আসল কথা হলো, ১৫ জুন ভারতকে হারাতে হলে মাশরাফির দলকে সামর্থে্যর সেরাটা উপহার দিতে হবে। ব্যাটিং ও বোলিংয়ে যতটা ভালো খেলা সম্ভব, তাই খেলতে হবে। আর যাদের কথা বলা হলো তাদের বড় অংশকে জ্বলে উঠতেই হবে। তবেই কেবল জেতা সম্ভব।

সেদিন হয়তো ব্যাটিংয়ে হয়েছে, বৃহস্পতিবার বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনে যে আবারও তেমন অনন্য অসাধারণ লড়াকু ও ম্যাচ জেতানো ব্যাটিংই লাগবে এমন নয়। অধিনায়ক মাশরাফি, মোস্তাফিজ, রুবেল ও সাকিব- যে কারোর একটি ক্ষুরধার বোলিং স্পেলও খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

একদম শেষ কথা হলো, নিজেদের সামর্থে্যর ওপর বিশ্বাস, আস্থা রাখতে হবে পুরোপুরি। আমরা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে এসেছি নিজ যোগ্যতায়। আমাদের ফাইনাল খেলার সামর্থ্য আছে। ভারত কাগজে-কলমে আমাদের চেয়ে ভালো দল তাতে কি হয়েছে? ফেবারিটরা কি আন্ডারডগের কাছে হারে না? হারে। আমরাও এই ভারতকে হারিয়েছি।

চেষ্টা থাকলে আর জায়গা মতো সঠিক কাজ করতে পারলে আবার জিততে পারি। এই বিশ্বাসটা থাকতে হবে ভেতরে। ব্যাটিং-বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে ছন্দ পাওয়া জরুরি। আর কোনোভাবে ছন্দ ফিরে পেলে তা হারানো চলবে না। কেউ উইকেটে সেট হয়ে আউট হওয়া যাবে না। বা জুটি গড়ে ওঠার পর হঠাৎ তা ভাঙা চলবে না। মনে রাখতে হবে, ভারতীয়দের একবার ব্যাকফুটে ঠেলে দিলেই চলবে না। সেই চাপটা ধরে রাখতে হবে শেষ অবধি। বল ও ব্যাট হাতে ডেথ ওভার তথা শেষ অংশে ভালো খেলা খুব জরুরি।

গত বছর বেঙ্গালুরুর এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে বিশ্ব টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একজন ফিনিশারের অভাবে নিশ্চিত জয় হয়েছে হাতছাড়া। চার উইকেট হাতে রেখে ৬ বলে ১১ রান করতে গিয়ে প্রথম তিন বলে ৯ রান করে জয়ের খুব কাছে গিয়ে নিজেদের ভুলে জয় হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা মাথায় রেখে শিক্ষা নিতে হবে। তাহলেই হয়তো জয়ের দেখা মিলতে পারে।

এআরবি/আইএইচএস/