মন খারাপের মুহূর্তে রাজধানীর হাতিরঝিল যেন অনেকের ঠিকানা। বেড়াতে গেলে মুহূর্তেই ভালো হয়ে যায় মন। তাই ফুসরত পেলেই বন্ধু মহল, পরিবার, প্রিয় কিংবা প্রেয়সীর হাত ধরে যেখানে বসে জমপেস আড্ডা সেই হাতিরঝিলই কিনা এখন মরণ ফাঁদ!হাতিরঝিল উদ্বোধন ও জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি। প্রকল্পটি উদ্বোধনের পর থেকে গত দুই বছরে খুন ও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১৩ জন, আহত অর্ধশতাধিক। নিহতের মধ্যে রয়েছেন- দর্শনাথী, প্রেমিক যুগল, স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী, গার্মেন্টস কর্মী, এছাড়াও রয়েছেন কলেজ শিক্ষক। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় হাতিরঝিল যেন মৃত্যু উপত্যকা।রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে হাতিরঝিল একটি নান্দনিক স্থান হলেও বেপরোয়া গাড়ি চলাচল ও রাতের হাতিরঝিল অনিরাপদ হওয়ায় হরহামেশাই খুন ও সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে এখানে বেপরোয়া গাড়ির চলাচল। ঘুরতে এসে ফিরছেন লাশ হয়ে। জীবনের স্বাদ, আহ্লাদ, স্বপ্ন পূরণ নিমিষেই সাঙ্গ হচ্ছে সুন্দরপ্রিয় দর্শনার্থীদের। কিছুদিন পরপরই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। তবুও টনক নড়েনি প্রকল্প ও সংশ্লিষ্ট এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের।সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা জানান, এখানে যান চলাচলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। নেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। সুযোগে তাই পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলে মাইক্রো, মোটারসাইকেল কিংবা পাজেরো জিপ। হাতিরঝিল মনে হচ্ছে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।সরেজমিনে দেখা যায়, রামপুরা, গুলশান ও শিল্পাঞ্চল দিক থেকে আসার মুখে লোকজনের সমাগম বেশি হয়। বিশেষ করে ২ নং ব্রিজ এলাকায়। ব্রিজের উপর অনেক তরুণ-তরুণীর আড্ডা বসে। অনেকে তাদের প্রিয়জনকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসেন। ছোট ছেলে-মেয়েরা এদিন সেদিক ছোটাছুটি করে। তবে ব্রিজে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে আইন মানছে না চালকরা।ব্রিজের উপর দিয়ে তীব্র গতিতে গাড়ি চলার কারণে অভিভাবকরা একটু অসচেতন হলেই বাচ্চারা গাড়ির নীচে চাপা পড়তে পারে!হাতিরঝিলের ব্রিজ এবং রাস্তাগুলোতে বিশেষ করে ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচলের গতি কমিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারি হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় বাঁধন রানা (১৬) নামে একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও তিনজন।২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল রাজধানীর হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় সীতা আক্তার (১২) নামে সপ্তম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী নিহত হয়।একই বছরের ৫ জুন হাতিরঝিল থেকে হানিফ (৮৫) নামে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।২০১৪ সালের ১৭ মে হাতিরঝিল চল্লিশঘর বস্তির সামনে থেকে মো. জিয়াউল হক সেন্টু নামে এক ‘বিএনপি সমর্থকের’ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার বাড়ি নাটোর জেলার বড়াইগ্রামে।এর আগের বছর ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটর সাইকেল আরোহী শরিফ মাসিউল্লাহ (২৫) ও তানজিনা আনোয়ার সজনী (১৯) নামে দুই তরুণ-তরুণী নিহত হন।২০১৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দুর্ঘটনায় মারা যান এটিএন নিউজের ক্যামেরাম্যান মো. সাঈদ (৩০)। ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম (৪০) নিহত হন।সম্প্রতি খুনের ঘটনা ও অজ্ঞাত লাশেরও খোঁজ মিলছে হাতিরঝিলে। গত বছরের ৬ জুন হাতিরঝিল গোলচত্বরের পূর্ব এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের (২৫) লাশ উদ্ধার করছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ।একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিলের টঙ্গী ডাইভারশনে কালভার্টের নিচ থেকে গলিত অবস্থায় অজ্ঞাত (২৫) এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে রমনা থানা পুলিশ।চলতি মাসের ৬ তারিখে হাতিরঝিলের ২ নম্বর ব্রিজের নিচ থেকে গলা কাটা অবস্থায় রিফাত নামে এক কলেজ ছাত্রকে উদ্ধার করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।হাতিরঝিলে কেন এতো দুর্ঘটনা ঘটছে তা জানতে চাওয়া হলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. আবু ইউসুফ বলেন, এখানে সাধারণতঃ দুর্ঘটনা ঘটে না। তবে বেশির ভাগ সময়ই রাস্তা ক্লিয়ার থাকে। অনেকে যত্রতত্র রাস্তা পার হোন। পারাপারে হঠাৎ গাড়ী চাপায় পড়েন। এখানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও নিয়ন্ত্রিত বলে জানান তিনি।ঢাকা উত্তর ট্রাফিক বিভাগের (তেজগাঁও) এসি রাজিব আহমেদ জানান, এই এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অন্যান্য এলাকার চেয়ে উন্নত ও নিয়ন্ত্রিত। দ্রতগতির কারণে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য মোড়ে মোড়ে গতিরোধক (স্ট্রিট ব্রেকার) ব্যবস্থা রয়েছে।জেইউ/আরএস/আরআই
Advertisement