গুরু-শিষ্য দুজনায় কি অদ্ভুত মিল! এবার যিনি গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের কোচ, সেই মোহাম্মদ সালাউদ্দীনও প্রথমবার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে কোচিং শুরু করেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। সেটা ছিল ২০০১ সালের কথা। সেবার ভিক্টোরিয়ার হয়ে কোচিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমবারই লিগ বিজয়ী হয়েছিলেন কোচ সালাউদ্দীন।
Advertisement
এবার নাসির হোসেন প্রথমবার লিগে অধিনায়কত্ব করে জিতলেন লিগ শিরোপা। তার নেতৃত্বে শেষ হাসি হাসল গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স। যদিও পুরো লিগ খেলা হয়নি তার। লিগ আর সুপার লিগ মিলে আটটি ম্যাচে মাঠে নেমেছেন নাসির। মোদ্দা কথা পুরো লিগ যাত্রার ৫০% দলের হয়ে মাঠে ছিলেন।
আর তার প্রায় ৯০ ভাগ সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নাসির। ব্যাট হাতে আট ইনিংসে ছয়বার নটআউট থেকে ৪৮০ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ১১ উইকেট শিকারী নাসির ক্যারিয়ারের সেরা অলরাউন্ড পারফরমেন্স দেখিয়ে দলের সাফল্যের অন্যতম রূপকার।
তবে নাসিরের জন্য প্রাইম দোলেশ্বরের সাথে শেষ ম্যাচটি ভাল কাটেনি। প্রথম কথা এ ম্যাচে তার দল হেরেছে। তবে সমীকরণটা এমনই ছিল যে, শেষ ম্যাচে প্রাইম দোলেশ্বর গাজী গ্রুপ ত্রিকেটার্সকে হারালেও কোন লাভ হবে না।
Advertisement
নাসিরের গাজী গ্রুপই হবে চ্যাম্পিয়ন। কারণ, আবাহনী আগের দিনই শেখ জামালের সাথে জিতে গেছে। গাজী গ্রুপ শেষ দিন প্রাইম দোলেশ্বরের কাছে হারার অর্থ আবাহনী, প্রাইম দোলেশ্বর আর গাজী গ্রুপের পয়েন্ট সমান, ১৬ খেলায় ২৪।
তখন তিন দলের পারস্পরিক মোকাবিলায় লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারিত হওয়ার কথা। সেখানে গাজী গ্রুপ প্রাইম দোলেশ্বর ও আবাহনীর চেয়ে এগিয়ে ছিল। গাজী গ্রুপ প্রথম লিগ ও সুপার লিগ দুই পর্বেই আবাহনীকে হারিয়েছে।
আর প্রাইম দোলেশ্বরের সাথেও প্রথম লিগে জিতে আছে। আজ শেষ দিন প্রাইম দোলেশ্বরের কাছে গাজী গ্রুপ ৬ উইকেটে হারায় সেই হিসেব নিকেশেই শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছে লিগ ভাগ্য। যাতে তিন দলের পয়েন্ট সমান হয়ে গেলেও, ওই তিন দলের প্রথম ও সুপার লিগ মিলে পারস্পরিক মোকাবেলায় বেশি ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন নাসির হোসেনের গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স।
বৃষ্টি বিঘ্নিত ও দু’দিনে শেষ হওয়া ম্যাচে দল হারাই শুধু নয়, কথা বলেনি নাসিরের ব্যাটও। আগের সাত ইনিংসে ছয়বার নট আউট থেকে ৪৭৭ রান করা নাসির শেষ খেলায় আউট হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন মাত্র ৩ রানে।
Advertisement
এই ম্যাচে ২৩ রান করে নটআউট থাকলে এবারের লিগে তার ব্যাটিং গড় দাঁড়াতো ৫০০। ২৩-এর ওপরে যত বেশি রান করে নটআউট থাকতেন, গড় হতো ৫০০ প্লাস। এক লিগে মাত্র আট খেলায় ৫০০ রান! তাও ৫০০ প্লাস গড় নিয়ে, ভাবা যায়!
সে বিরল কৃতিত্বের খুব কাছে গিয়ে তা ছোঁয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও নাসিরের এবারের লিগের গড় ২৪০। সেটাই লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে কোনো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানের কোন আসরে সর্বাধিক।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে কোনো ব্যাটসম্যান এর আগে আট ম্যাচ খেলে ২৪০ গড়ে ৪৮০ রান করেছে, এমন রেকর্ডও নেই। সাথে অফস্পিন বোলিং করে ১১ উইকেট দখলও করেছেন। কাজেই সব মিলে দারুণ এক সফল লিগ শেষ করলেন নাসির।
প্রিমিয়ার লিগে প্রথমবার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেই দল চ্যাম্পিয়ন। এ অনুভুতি কেমন? লিগ যাত্রা কেমন ছিল? গাজী গ্রুপ কি সেরা ও যোগ্য দল হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন? নিজের এ অবিস্মরনীয় পারফরমেন্সকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন নাসির? জাতৗয় দলে ফেরা নিয়েই বা তার চিন্তা-ভাবনা কি?
আজ সন্ধ্যায় জাগো নিউজের সাথে এসব বিষয়ে একান্তে অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন নাসির। সেখানেই শোনালেন জাতীয় দলে তার ফেরা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কথা।
আসুন দেখা যাক সে কথোপকোথন...
জাগো নিউজ : শেষ ম্যাচ হারলেও আপনারাই হতেন চ্যাম্পিয়ন, তারপরও শেষ ম্যাচ জিততে না পারা কি উৎসব-আনন্দে খানিক ভাটা? সেটা কি অপূর্ণতা?
নাসির : হ্যাঁ, শেষ ম্যাচ জিততে পারিনি। কিছুটা আফসোস তো থেকেই গেল। শেষ ম্যাচ জিতলে খুব ভাল লাগতো। সত্যি কথা বলতে কি, শেষ ম্যাচটা জিতে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারায় আমাদের বিজয় উৎসব খানিকটা ফিকে হয়ে গেছে।
চ্যাম্পিয়ন হবার আনন্দ বা মজাটা একটু হলেও কম পেয়েছি। বারবার মনে হয়েছে জিতে লিগ শেষ করতে পারলে ভাল লাগার মাত্রা বেশি হতো। তারপরও দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স চ্যাম্পিয়ন। আমরা সবাই খুশি। ক্লাব কর্তা, কোচিং স্টাফ আমরা- সবার মুখে চ্যাম্পিয়নের হাসি। সেটাও অনেক বড় খুশির।
জাগো নিউজ : আপনার অধিনায়কত্বে দল লিগ চ্যাম্পিয়ন, কেমন লাগছে?
নাসির : খুব ভাল লাগছে। ভাল লাগার মাত্রাটা এই কারণে বেশি যে- ঢাকা লিগে এটাই আমার প্রথম ক্যাপ্টেন্সি। যে বার করলাম সেবারই চ্যাম্পিয়ন। আর প্রথম বছরই আমার দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কাজেই এটা ভাল লাগার উপলক্ষ্য হয়ে গেছে। তারপরও কিছু ভুল-ত্রুটি ছিল। এখনো শেখার অনেক কিছু আছে। অবশ্যই খুব ভাল লাগছে। নিজেও পারফরম করেছি। দলও চ্যাম্পিয়ন হলো। সব মিলে খুব ভাল লেগেছে।
জাগো নিউজ : লিগ শুরুর আগে চ্যাম্পিয়ন হবো, আর নিজে খুব ভাল পারফর্ম করে দেখিয়ে দিতে হবে এমন কোন সংকল্প কি ছিল?
নাসির : কোন জেদ ছিল না। আমি জাতীয় দলের বাইরে থেকেও কখনো এমন চিন্তা করিনি যে, আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে। কারণ জেদ করে কিছু লাভও হতো না। সবচেয়ে বড় কথা কোনটাই আমার হাতে ছিল না। আমি একা চাইলে বা পারফর্ম করলেই গাজী চ্যাম্পিয়ন হতো না।
আর গাজী চ্যাম্পিয়ন হলেই আমি জাতীয় দলে ফিরবো- এমন ভাবারও কোন যৌক্তিকতা নেই। আমার দলে ফেরা নির্ভর করছে টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদের ওপর। সেটা মাথায় রেখেই লিগ শুরু করেছি।
হ্যাঁ, আর সবার মত আমিও কঠিন পরিশ্রম করেছি। পুরো দল ভাল পারফর্ম করার জন্য চেষ্টা করেছে। সবাই পরিশ্রম করেছে।
জাগো নিউজ : আবাহনী, প্রাইম দোলেশ্বর ও প্রাইম ব্যাংকের চেয়ে কোন জায়গায় গাজী সবার চেয়ে ভাল ছিল?
নাসির : ওভারঅল ব্যালান্সড সাইড। সবাই পারফরম করেছে। যারা সিনিয়র ও অভিজ্ঞ তারা সবাই অবদান রেখেছে। আমি যতটুকু খেলেছি, পারফরম করেছি। সৌরভ (মুমিনুল) ভাল করেছে। বিজয়ও (এনামুল হক) পারফর্ম করেছে। অমি ভাই (জহুরুল ইসলাম) আর নাদিফ ভাই পারফর্ম করেছে। পেসার আবু হায়দার রনির কথা না বললেই নয়। এরকম গরমে ফ্ল্যাট উইকেটে একজন পেসারের সর্বোচ্চ উইকেট, সহজ ব্যাপার নয়। রনি তাই করে দেখিয়েছে।
আমাদের কোন চাপ ছিল না। টিম ম্যানেজমেন্ট এবং ক্লাব কর্মকর্তারা এক মুহুর্তের জন্য কোন বাড়তি চাপ দেননি। কোচিং স্টাফ ভাল ছিল। আমরাই নির্ভার ছিলাম। সবাই ফ্রি হয়ে নিজের সেরাটা খেলার চেষ্টা করেছি। খেলার মত পরিবেশও ছিল। সোজা কথা কখনোই মাথায় আসেনি যে আমরা হারবো।
জাগো নিউজ : ইংল্যান্ডে বসে সুপার লিগে প্রথম ম্যাচ হারার কথা শুনে কি মনে হয়েছে?
নাসির : বুঝেছি টিম আমাকে মিস করছে। আমি বুঝেছি টিমে আমার দরকার। তখন খারাপ লেগেছে।
জাগো নিউজ : পরিসংখ্যান ও কোচ সালাউদ্দীন ও আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, নাসির নিজের পারফর্মেন্সকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে?
নাসির : আমি বলবো এটাই আমার দায়িত্ব। পারফর্ম করাই আমার কাজ। সবার এক একটা দায়িত্ব ছিল। ওপেনারের কাজ কি, কিংবা মিডল ও লোয়ার অর্ডারের কাজ কি, সব ভাগ করা ছিল। সবার ভুমিকা ছিল। আমি স্যারকে বলেছি, চারে ব্যাট করবো। সেখানে নেমে ৫০ ওভার খেলে আসবো। আপনি যখন জানবেন আপনার নিজের কাজ কি, তখন সেটা মাথায় নিয়ে অগ্রসর হবেন, জানবেন আমি এটাই আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য- আমাকে সেটাই করতে হবে। তখন কাজ করাটা আরও ভাল হয়।
জাগো নিউজ : বাদ পড়ার সময় পারফরমেন্স কি খারাপ ছিল? সেটা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নাসির : আসলে পারফরমেন্স খারাপ ছিল কি না- সেটা মূল্যায়ন করার দায়িত্ব আমার নয়। আমি সব সময় বলি দলে ঢোকা আর বাদ পড়া আসলে আমার হাতে নয়। খেলোয়াড় হিসেবে আমার কাজ হলো খেলা। নির্বাচকরা যা ভাল মনে করেছেন সেটাই সঠিক। আমার বলার কিছুই নেই। আমি বর্তমান নিয়েই ভাবতে চাই। ইনশাল্লাহ চেষ্টা করছি কামব্যাক করার জন্য। আমি আশা করছি আবার জাতীয় দলে কামব্যাক করবো।
এআরবি/আইএইচএস/পিআর