ড. কামাল হোসেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও খ্যাতি রয়েছে আইন পেশায়। গণফোরামের সভাপতি তিনি।
Advertisement
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় রাজনীতির নানা প্রসঙ্গও। চলমান সংকট উত্তরণে গুরুত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি-আদর্শের ওপর। তিন পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব আজ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : রাজনীতির নানা সংকটের কথা বলছিলেন আগের পর্বে। সংকট মোকাবেলায় আপনার পরামর্শ কী?
ড. কামাল হোসেন : যে সংকট বিরাজমান, তা থেকে রেহাই পেতে সরকারের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। সরকার চাইলেই অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যাবে।
Advertisement
জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক, এটি সবার আগে সরকারকে বুঝতে হবে। এটি বুঝতে পারলে সমাধানের পথ সরকারই বের করতে পারবে।
জাতির মুক্তির স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতের পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্য থাকতেই হবে। আইনের চোখে সবাই সমান- এই বিষয়ে তো কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না।
১৯৭০ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খানকে বলেছিলেন, ‘তুমি (ইয়াহিয়া) কী নির্বাচন করলে যে পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেল।’ ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘গোয়েন্দারা আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে, বাঙালি কখনও ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। নির্বাচন দিলে তারা আরও বিভাজিত হবে এবং আমাদের খেলতে আরও সুবিধা হবে।’
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন দেশে ফিরছিলাম তখন ঢাকার রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ। এমন মানুষের সমাগম দেখে বঙ্গবন্ধুকে তখন চিন্তিত মনে হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, লিডার আপনি চিন্তিত কেন? তিনি বললেন, ‘দেখ স্বাধীনতার জন্য সমস্ত বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছি। জানি না, সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারব কিনা?’
Advertisement
বঙ্গবন্ধু এই জাতিকে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলেন, অন্য কোনো রাজনীতিক তা বুঝতে পারেননি। আমাদের সকল অর্জন হয়েছে ঐক্যের মধ্য দিয়েই।
জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। এখন নানা প্রশ্নেই জাতি বিভক্ত। জীবনের এ বেলায় এসে এই বিভাজন কতটুকু ভাবায়?
ড. কামাল হোসেন : রাজনীতির এমন চরিত্র দেখে বড় কষ্ট পাই। রাজনীতি আজ ক্যান্সারে আক্রান্ত। পাকিস্তান আমলে যেমন ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদ তৈরির চেষ্টা চলেছিল, এখনও তেমন বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ : রাজনীতির রোগমুক্তির জন্য করণীয়?
ড. কামাল হোসেন : আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। মিথ্যা দিয়ে টিকে থাকা যায় না। মিথ্যা ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ওই মামলা দিয়েই পাকিস্তান সরকার বড় ধাক্কা খেল। ওই মামলার পরে বঙ্গবন্ধুর বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে গেল।
১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভোলায় গিয়েছিলাম। ফিরতি পথে পটুয়াখালীর আমতলীতে দেখি ১২ বছরের এক কিশোর বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে এবং পাকিস্তানের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘লিডার এবার আর আমাদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।’ নভেম্বরের কথা। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেই তার প্রমাণ পেলাম।
সংকট উত্তরণে এই ইতিহাস সাধারণের সামনে পৌঁছে দেয়া সময়ের দাবি। আমাদের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই সবাইকে ঘুরে দাঁড়ানো দরকার।
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর দেখান আদর্শ থেকেই সংকটের উত্তরণ ঘটবে। জাতীয় স্বার্থে আওয়ামী লীগই ঐক্যের ডাক দিতে পারে।
জাগো নিউজ : হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের সঙ্গে আপস করে ঐক্যের ডাক দেয়া যায়?
ড. কামাল হোসেন : জাতীয় স্বার্থে হেফাজতের সঙ্গেও ঐক্য হতে পারে। কিন্তু আগে তো দেশ। সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ স্বীকার করতে হবে। হেফাজত তো সংবিধানই স্বীকার করে না।
জাগো নিউজ : এই পরিস্থিতির মধ্যে দেশ যাচ্ছে কোথায়?
ড. কামাল হোসেন : দেশ কোথায় যাচ্ছে, তা সরকারই ভালো জানে। আপাতত সহজ কোনো সমাধান নেই, তা সহজেই বলা যায়।
ত্যাগ ও অর্জনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলেই আওয়ামী লীগ ঠিক পথে চলতে পারবে। বাঙালিকে বেশিদিন দমিয়ে রাখা যায় না- এই ইতিহাস সম্পর্কে আওয়ামী লীগই ভালো জানে।
যারা সাময়িকভাবে লাভের জন্য জনগণের অধিকার দমিয়ে রাতে চায় তাদের পরিণতি ভালো হয় না, সে ইতিহাসও আমাদের সামনে আছে।
জাগো নিউজ : শেষ ভরসা তাহলে সাধারণের ওপরই?
ড. কামাল হোসেন : আমি আশাবাদী মানুষ। আশা নিয়েই বেঁচে আছি। রাজনীতির নামে যে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষই শুধরে নেবে। সাধারণ মানুষই রাজনীতির সঠিক পথ নির্ধারণ করে দেবে। সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
এএসএস/এমএআর/এমএস