নড়াইলের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়র শতাধিক ছাত্রী ছেলেদের মতোই বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। এখন আর তাদের ভ্যানে বা অন্য কোনো বাহনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বাবা মায়ের কাছ থেকেও বাড়তি টাকাও নিতে হয় না। সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করায় প্রথমদিকে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করলেও ছাত্রীরা এসব কর্ণপাত করেনি।
Advertisement
সব বাধাকে উপেক্ষা করে এবং নারীর নিরাপত্তাহীনতা, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, যৌতুক, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়।
জানা গেছে, নড়াইল শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে নিভৃত পল্লীতে গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দোগাছি, মালিয়াট, বাকলি, হাতিয়াড়া, গুয়াখোলা, হাতিয়াড়া, বেনাহাটি, কমলাপুরসহ এগারোটি গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে। এখানকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট কাঁচা। ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরের শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
স্কুলে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। এই দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে ছাত্রীদের সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাতায়াতের পরামর্শ দেয়া হয়। চার বছর পূর্বে হাতেগোনা কয়েকজন ছাত্রী সাইকেলে যাতায়াত করলেও বর্তমানে শতাধিক ছাত্রী নিয়মিত সাইকেলে নিয়ে যাতায়াত করছে।
Advertisement
ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মালিয়াট গ্রামের পূজা বিশ্বাস জানায়, এক সময়ে ৫ কি.মি. ভ্যানে ও পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত সে। ঠিকমতো ক্লাস ধরতে পারতো না।
পূজা বিশ্বাস বলে, তখন আমরা কয়েকজন ছাত্রী মনে করলাম ছেলেরা যদি সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে পারে তাহলে আমরা কেন পারবো না ? তখন স্কুলের শিক্ষক ও আমাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে সাইকেল কেনার সিদ্ধান্ত নেই। তারপর আমাদের দেখাদেখি এখন শতাধিক মেয়ে স্কুলে সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করে।
দশম শ্রেণির ছাত্রী খুশি সিকদার বলে, প্রথমদিকে সাইকেল চালিয়ে আসলে এলাকার বখাটেরা বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতো। এটা আমরা প্রতিহত করে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসি। এলাকার বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দূর করে সাহসিকতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাবো।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী দীপ্তি পাঠক বলে, আগে ভ্যানে স্কুলে আসতে অনেক সময় নষ্ট হতো। ঠিকমত ক্লাস ধরতে পারতাম না। এখন আমরা নিয়মিত ক্লাস করতে পারি এবং পড়াশোনাও ভালো হচ্ছে। তবে সাইকেলে চালিয়ে যাতায়াতের সময় রাস্তার অন্যান্য যানবাহন সাইড দিতে চায় না। অনেকে ব্যঙ্গ করে।
Advertisement
দশম শ্রেণির ছাত্রী সেজুতি রায় বলে, স্কুলে সাইকেল গ্যারেজ না থাকায় স্কুলের সামনে বিক্ষিপ্তভাবে সাইকেল রাখতে হয়। কিছুদিন আগে বান্ধবীদের দুটি সাইকেল চুরি হয়ে গেছে। স্কুলে একটি সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণের প্রয়োজন।
স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র সোহাগ গুপ্ত বলে, বর্তমানে স্কুলের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে আসছে। পথে অনেকে তাদের ব্যঙ্গ করার চেষ্টা করলে আমরা সবাই তখন এক সঙ্গে প্রতিহত করি।
দুই ছাত্রীর বাবা বাকলি গ্রামের অমিতোষ বিশ্বাস ও খোকন সিকদার বলেন, সামাজিক কুসংস্কারসহ বিভিন্ন কারণে বাইসাইকেল চালিয়ে মেয়ে স্কুলে যাবে বিষয়টি প্রথমে মানতে চাইনি। পরে মেয়ের আগ্রহ এবং স্কুলের শিক্ষকদের অনুরোধে মেয়েকে সাইকেল কিনে দেই। এখন দেখছি সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল।
স্থানীয় শেখহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাপস পাঠক বলেন, গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াতের ঘটনাটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। এভাবে দেশের অন্য স্কুলের মেয়েরা যদি স্কুলে যাওয়ার বাহন হিসেবে বাইসাইকেলকে বেছে নিত তাহলে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি পড়াশোনায় মনোযোগী হবে।
গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, স্কুলে প্রায় তিনশত ছাত্রছাত্রী মধ্যে ১৪৩ জন ছাত্রী। যানবাহনের সমস্যার জন্য স্কুলে আসতে তাদের অনেক সময় লাগে এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে তারা ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগী হতে পারে না। শিক্ষকরা প্রথমে মেয়েদের সাইকেল চালনায় অনুপ্রেরণা দেন এবং অভিভাবকদের বোঝান। এতে অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে এবং নিয়মিত ও সময়মত স্কুলে উপস্থিত হতে পারছে। ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ বছর এ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ছয়জন জিপিএ-৫ পেয়েছে এবং বিজ্ঞান বিভাগে শতভাগ পাস করেছে। তবে অবকাঠামো সমস্যার কারণে সাইকেল রাখার জায়গা নেই। শিক্ষার্থীদের পাঠদানও ব্যাহত হচ্ছে।
হাফিজুল নিলু/আরএআর/এমএস