বিনিয়োগে স্থবিরতা। ঋণ নিচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে অলস টাকা। তাই পরিচালন ব্যয় হ্রাস করতে ব্যাংকগুলো কমাচ্ছে আমানতের সুদ হার। এর ধারাবাহিকতায় গড় আমানতের সুদহার পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
Advertisement
তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল শেষে ব্যাংকিং খাতে গড় আমানতের সুদহার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ।
একই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। একমাস আগে অর্থাৎ মার্চে ব্যাংকিং খাতে গড় আমানতের সুদহার ছিল ৫ দশমিক ০১ শতাংশ। আর ঋণের হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমানতের সুদহার গত এক বছরের ব্যবধানে কমেছে দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার কমেছে ১ দশমিক ০২ শতাংশ। আর দুই বছরের ব্যবধানে আমানতের সুদহার কমেছে ২ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার কমেছে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ।
Advertisement
২০১৬ সালের এপ্রিলে আমানতের সুদহার ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর আগের বছর ২০১৫ সালের এপ্রিলে আমানতের সুদহার ছিল ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। আর ঋণের হার ছিল ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি ও আমানতের সুদহার কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংকে টাকা রাখতে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে যাবে। যা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। অন্যদিকে ধারাবাহিক সুদহার কমায় এক ব্যাংকে টাকা রেখে লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লা বেশি ভারি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানতের মুনাফা দিয়ে অনেকে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। তাই আমানতের সুদহার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকা উচিত নয়। যেখানে দেশে বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের উপরে, যেখানে আমানতের সুদহার ৫ শতাংশ বা তার নিচে থাকা অর্থনীতির জন্য ভালো না। এতে অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ ব্যয় হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী, জনতা ও সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত হার ৪ দশমিক ২১ শতাংশ এবং জনতার আমানত হার ৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং সোনালীর আমানত হার ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ।
Advertisement
বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের আমানত হার ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ, সিটি ব্যাংকের ৪ শতাংশ, ইউনাইটেড কর্মাসিয়াল ব্যাংকের ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ, পূবালী ব্যাংকের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ, উত্তরা ব্যাংকের ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংকের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংকের ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ১ দশমিক ২৭ শতাংশ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ২ দশমিক ৯১ শতাংশ, হাবিব ব্যাংকের ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ, সিটি ব্যাংক এন এ এর দশমিক ১৩ শতাংশ, কর্মাসিয়াল ব্যাংক অব সিলন ব্যাংকের ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ, উরি ব্যাংকের ২ দশমিক ১১ শতাংশ, এইচএসবিসির ১ দশমিক ৩৩ এবং ব্যাংক আল ফালাহর ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানতের সুদ দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক। আমানতকারীদের ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ব্যাংকটি। আর সবচেয়ে কম সুদ দিচ্ছে বিদেশি সিটি ব্যাংক এন এ। বাংকটির আমানত হার দশমকি ১৩ শতাংশ।
এদিকে আমানতের সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদ ঋণের সুদের তুলনায় দ্রুত কমে অনেক ক্ষেত্রে ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
আমানতের সুদের অত্যাধিক হ্রাস সঞ্চয় প্রবণতাকে ক্ষুণ্ন করছে এবং সঞ্চয়ের বদলে অপচয়মূলক ভোগ ও অন্যান্য অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের প্রবণতার ঝুঁকি বাড়ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দায় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে, যা বাঞ্ছনীয় নয়।
এ অবস্থায় আমানতের উপর সুদের নিম্নগামী প্রবণতা রোধের বিষয়ে সক্রিয় থাকার জন্য পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এক্ষেত্রে ঋণের সুদ নিম্নগামী রাখতে ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) কমাতে বলা হয়। এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়সহ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়। তবে কার্যত এই পরামর্শ আমলেই নেয়নি কোনো ব্যাংক। ফলে পুরো ব্যাংক খাতে আমানতের সুদ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
এদিকে স্প্রেড বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এখনও তা মানেনি দেশি-বিদেশি ১৫টি ব্যাংক। এই সীমা লঙ্ঘনে সবার শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক ও ডাচ বাংলা ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
জানা গেছে, সুলভ বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামানোর দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি অনুযায়ী, ঋণের সুদহার কমাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর বিভিন্ন সময়ে চাপ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় সর্বশেষ ‘স্প্রেড’সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিংয়ের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে যে সব ব্যাংকের স্প্রেড সীমা অতিক্রম করবে তাদের ক্যামেলস রেটিং নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান স্প্রেড সীমা ৫ শতাংশের নিচে আনতে বরাবরই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে গড় স্প্রেড ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। কিছু ব্যাংক নির্ধারিত সীমার উপরে রয়েছে তাদের আমরা স্প্রেড হার নামিয়ে আনার তাগিদ দিচ্ছি।
এসআই/এমএমএ/এএইচ/জেআইএম