পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম বিশেষ করে ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া অবশ্য শুরু থেকেই অ্যাশেজ নিয়ে বেশি মাতামাতি করে। তাদের কাছে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড ম্যাচই সবচেয়ে বড়। ক্রিকেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জমজমাট লড়াই। অজি ও ব্রিটিশ মিডিয়া যাই মনে করুক না কেন, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড ক্রিকেট লড়াই নিয়ে যতই হৈ চৈ হোক না কেন, আসল সত্য হলো, ক্রিকেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দর্শকপ্রিয় লড়াই হলো ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ।
Advertisement
দুই প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দীর্ঘ শত্রুতাই আসলে ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। দুই দেশের মানুষের কাছে এটা শুধু ক্রিকেট লড়াই নয় রীতিমত ‘যুদ্ধ।’ আর অন্য যার কাছে হারলেও এ ক্রিকেট যুদ্ধে হারতে চায় না কেউই। তাই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ক্রিকেট ছাপিয়ে অন্যরকম উত্তেজনা-উত্তাপ। একটা ‘মার মার কাট কাট’ অবস্থা।
শুধু ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের কথা বলা কেন, এই একটি ক্রিকেট ম্যাচ যত আলোড়ন তোলে, সারা ক্রিকেট বিশ্বে সাড়া জাগায় আর কোন দলের ম্যাচই তত আলোড়ন জাগায় না। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় পাক-ভারত ক্রিকেট লড়াই মানেই একটা অন্যরকম উত্তেজনা।
তবে হ্যাঁ, এটা সত্যি আগের সেই জৌলুস নেই। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে আগে যতটা কথাবার্তা হতো, জল্পনা-কল্পনার ফানুস বাতাসে ভেসে বেড়াত, এখন তা কমেছে। সে উত্তেজনা, উৎসাহ আর উদ্দীপনাও কমেছে বেশ। তার একটাই কারণ, পাকিস্তানের অবনমন। দল হিসেবে পাকিস্তান এখন আর আগের জয়গায় নেই। ৭০, ৮০, ৯০ ও বর্তমান দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দল হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান ছিল প্রায় কাছাকাছি। দু`দলের শক্তির ভারসাম্য ছিল প্রায় সমান সমান। তারকা খ্যাতিও ছিল প্রায় একই রকম।
Advertisement
ভারতের মোহাম্মদ আজহার উদ্দিন, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, অজয় জাদেজা, যুবরাজ সিং, বীরেন্দর শেবাগ, অনিল কুম্বলে, জাভাগাল শ্রীনাথ ভেঙ্কটেশ প্রসাদ ও হরভাজন সিং অন্যদিকে হতো সাঈদ আনোয়ার, আমির সোহেল, ইনজামাম, সেলিম মালিক, ইজাজ আহমেদ, মোহাম্মদ ইউসুফ, ইউনুস খান, মঈন খান, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, রাজ্জাক ও সাকলাইন মোশতাকদের পাকিস্তান। হাড্ডাহাড্ডি হতো।
কিন্তু কালের আবর্তে পাকিস্তান এখন কাগজে কলমে অনেক দুর্বল ও কমজোরি দল। ভারতের লাইনআপ বিশ্বসেরা। এক ঝাঁক মেধাবী, বিশ্বমানের তারকা পারফরমারে সাজানো ভারতীয়দের ব্যাটিং ও বোলিং আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বরং সমৃদ্ধ। অনেকের মতে সেরাও। যেখানে বিরাট কোহলির মতো সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান, রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ানের মতো ড্যাশিং ওপেনার, মহেন্দ্র সিং ধোনি আর যুবরাজ সিংয়ের মত সেরা গ্রেট ফিনিশার, রবীন্দ্র জাদেজার মত তুখোর ও চৌকুশ ক্রিকেটার, রবি চন্দন অশ্বিনের মত সুনিয়ন্ত্রিত ও বুদ্ধিদীপ্ত অফস্পিনার আর মোহাম্মদ শামি, উমেশ যাদব এবং ভুবনেশ্বর কুমারদের মত পেসারের সংমিশ্রণ আছে। সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটিং লাইন আপ এখন ভারতের।
সব ধরনের ব্যাটসম্যান দলে বিদ্যমান। কোহলি, ধাওয়ান ও রোহিত শর্মা, তিনজনই প্রতিপক্ষ বোলিংকে তছনচ করে দিতে দারুণ দক্ষ। ঝড়ো ব্যাটিং আর পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠাউরে ধরে খেলার পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে তিনজনেরই। আর অধিনায়ক বিরাট কোহলি নম্বর ওয়ান ম্যাচ উইনার। যিনি উড়ন্ত সূচনার পর মাঝে দেখে ও ধরে খেলে শেষ পর্যন্ত দল জিতিয়ে বিজয়ীর বেশে সাজঘরেে ফিরতে পারেন।
পরে ধোনি ও যুবারাজ সিংহের মত ড্যাশিং উইলোবাজ। যারা নিজেদের দিনে যে কোন বোলিং শক্তিকে লন্ড ভণ্ড করে প্রতিপক্ষের হাত থেকে ম্যাচ নিজেদের হাতে নিয়ে আনার কাজে দারুণ পারদর্শী। শেষ দিকে রবীন্দ্র জাদেজা আর হার্দিক পান্ডিয়ার ব্যাটিংটাও প্লাস। দু`জনই বিগ হিটার। স্পিন-পেস দুই ধরনের বোলিংয়ের বিপক্ষেই বড় শট হাঁকাতে পারেন।
Advertisement
বোলিংটাও ততোধীক সমৃদ্ধ ধারালো এবং বৈচিত্রে ভরা। যেখানে ভুবনেশ্বরের সুইং, উমেশ যাদবের প্রচণ্ড গতি (১৪৫কিমি+) আর মোহাম্মদ শামির নিয়ন্ত্রিত বোলিং, সব মিলে ভারতীয় ফাস্টবোলিং এখন অন্যমাত্রায়। তার সঙ্গে অশ্বিনের অফস্পিন ও রবীন্দ্র জাদেজার বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিন, সব মিলে দুর্দান্ত বোলিং। যার তোড় সামলানো যে কোন ব্যাটিং শক্তির জন্য কঠিন।
সেখানে পাকিস্তান এখন সাধারণ মানের এক দল। যে দলে মিসবাহ উল হক, শহীদ আফ্রিদি আর ইউনুস খানের মত পারফরমারও নেই। স্বর্ণ সময়ের পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান দলটির শক্তির অনুপাত করতে দিলে অতিবড় পাকিস্তান ভক্তও হয়ত লজ্জা পাবেন। এক কথায় তারকাশূন্য এক দল। যে দলে একজন বিশ্বমানের পারফরমারও নেই। যে দেশের ব্যাটসম্যানরা ব্যাকরণে তত ভাল না হলেও সাহস, দৃঢ় সংকল্প আর স্ট্রোক প্লে‘র জন্য বিশ্বখ্যাত ছিলেন বহুকাল, সেই দেশে এখন এমন একজন ব্যাটসম্যানও নেই, যার ব্যাটিং দেখার অপক্ষোয় থাকা যায়।
দলটির চালিকশক্তি আসলে মোহাম্মদ হাফিজ আর শোয়েব মালিক। এ দুই ব্যাটসম্যান কাম অফস্পিনারকে ঘিরেই শক্তি আবর্তিত। যাদের অভিজ্ঞতা আছে। মেধা ও জাত, মানে যদিও দুজনার কেউই খুব বড় মাপের ব্যাটসম্যান নন। সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম, সেলিম মালিক, মোহাম্মদ ইউসুফ ও ইউনুস খানের ধারে কাছে নেই। তারপরও গড়পড়তা ও মাঝারি পারফরমেন্সটা করে যাচ্ছেন আর মোটামোটি ধারাবাহিকতাও আছে। সে কারণেই টিম পাকিস্তান শোয়েব মালিক ও হাফিজের ওপর নির্ভরশীল। সঙ্গে আহমেদ শেহজাদ, বাবর আজম গড়পড়তার চেয়ে একটু ভালো। অধিনায়ক সারফরাজ আহমেদের সাহসী ব্যাটিংও দলটির এখনকার অন্যতম নির্ভরতা। তারপরও ভারতীয়দের সুনিয়ন্ত্রিত ও ধারালো বোলিংয়ের তোড় সামলানো খুব কঠিন হবে।
তবে পাকিস্তানিদের বোলিংটা তুলনামূলক ধারালো। বৈচিত্রও বেশি। পেস বোলিং ডিপার্টমেন্ট বেশ সংগঠিত। মোহাম্মদ আমির, জুনায়েদ খান ও ওয়াহাব রিয়াজ যে কোন ব্যাটিং শক্তিকে কাপিয়ে দিতে পারেন। সাথে বাঁহাতি ইমাদ ওয়াসিম নাম্বার ওয়ান স্পিনার।
বাংলাদেশের সঙ্গে গা গরমের ম্যাচে শেষ দিকে ঝড় তোলা আনকোরা তরুণ ফাহিম আশরাফকেও হয়তো একাদশে দেখা যাবে। এ তরুণের আন্তর্জাতিক অভিষেক হতে পারে আজ। সঙ্গে আরেক পেসার হাসান আলী আর লেগস্পিনার সাদাব খানকে ধরা হয় ভবিষ্যত সম্ভাবনা।
তারপরও বিরাট কোহলি, শিখর ধাওয়ান, রোহিত শর্মা, রাহানে, যুবরাজ ও ধোনির মত পরিণত ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেজে খাওয়া উইলোবাজদের থামানোর মত বোলারের অভাব পরিষ্কার। এক আমিরই যদি কিছু করেন। আজ তাই এজবাস্টনে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ে বিরাট কোহলির দল সব হিসেবেই ফেবারিট।
দু`দলের ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান আর ম্যাচ জেতানোর রেকর্ড ঘাটলে ভারতীয়দের সামনে পাকিস্তানিরা বেশ দূর্বল। পিছিয়েও। তার প্রমাণ গত চার, পাঁচ বছরে পাঁচটি আইসিসি ইভেন্টে যতবার ভারত ও পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছে , ততবারই জিতেছে ভারতীয়রা। হেরেছে পাকিস্তানীরা।
২০১২ সালের বিশ্ব টি-টোয়েন্টি, ২০১৩ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ২০১৪ সালের বিশ্ব টি-টোয়েন্টি, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ও ২০১৬ সালের বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসর, পাঁচবারই শেষ হাসি ভারতের। তার চেয়ে বড় কথা হলো এর একটে ম্যাচও জমেনি। পাকিস্তান-ভারত ম্যাচে যে টান টান উত্তেজনা থাকে, ধুন্ধুমার লড়াই হয়, তার ছিটেফোটাও ছিল না। ছিল না কারণ ভারত অনেক বেশি শক্তিশালি। আর পাকিস্তান ততটাই দূর্বল।
ভারত-পাকিস্তান এখন আর মহারণ নয়। অসম শক্তির লড়াই। তাই ধুন্ধুমার লড়াইয়ের বদলে একপেশে ম্যাচ। আজ এজবাস্টনেও কি তাই হবে? তারকা আর বিশ্বমানের পারফরমারে ঠাসা বিরাট কোহলির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে সরফরাজ আহমেদের অনভিজ্ঞ ও মাঝারি শক্তির দল?
এআরবি/এমআর/জেআইএম