ব্রিটেনের নির্বাচনী ফলাফলে উচ্ছ্বসিত বাঙালি কমিউনিটি। প্রত্যাশা অনুযায়ীই হয়েছে এবারের নির্বাচনী ফলাফল। নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বাঙালি তিনকন্যা টিউলিপ সিদ্দিক, রোশনারা আলী ও রূপা হক। ১১ জন ব্রিটিশ-বাঙালি প্রার্থী বিভিন্ন দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মাত্র ওই তিনজন নিয়েই আশাবাদ ছিলেন কমিউনিটির লোকজন। বেথনাল গ্রিণ-বো আসন নিয়ে মূলত খুব একটা মাথাব্যথা ছিলো না কারো। কারণ এ আসন যে নিশ্চিত ছিলো, তা নির্বাচনের আগে আগে বোঝা যাচ্ছিলো। সে জন্যেই রোশনারা আলীর ভোট প্রাপ্তিটা ছিলো মোট ভোটের ৩২,৩৮৭ (৬১ শতাংশ)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি পেয়েছেন মাত্র ৮০৭০ ভোট। যেহেতু এ আসনে কোনো বাঙালি প্রার্থী ছিলেন না, সে হিসেবে সরকার গঠন করা কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীও ভোটের রাজনীতিতে এখানে যেন দাঁড়াতে পারেননি। যদিও আশঙ্কা ছিলো অনেকেরই অন্য কারণে। মাত্র ক‘দিন আগে টাওয়ার হ্যামলেটস এর নির্বাচিত মেয়র শক্তিশালী নেতা লুৎফুর রহমান পদচ্যুত হয়েছেন আদালতের রায়ে। এ নিয়ে একটা চাপা ক্ষোভ ছিলো বাঙালি কমিউনিটিতে। আর শঙ্কাও ছিলো সে কারণেই।বাঙালি কমিউনিটির প্রধান জায়গা যেহেতু টাওয়ার হ্যামলেটস, সেহেতু বেথনাল গ্রিন-বো সংসদীয় এলাকায় এ নিয়ে বাঙালিদের উচ্ছ্বাসও ছিলো। ২০১০ সালে প্রথম বিজয়ী হওয়া রোশনারা আলীকে নিয়ে যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল বাঙালি কমিউনিটির, সেই যাত্রাপথ এখন বলতে গেলে বন্ধুর নয়। অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট রোশনারা আলীর জাতীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা, কমিউনিটিকে নিয়ে তার সময়োপযোগী পদক্ষেপ তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে দিনের পর দিন, যা নির্বাচনে আবারো প্রমাণ হয়েছে।রোশনারা আলীর পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিকীর হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন। তা-ও অন্য কারণে। যদিও ব্রিটেনের রাজনীতিতে তা কোনো আলোচনার বিষয় হওয়ার প্রয়োজন ছিলো না, তবুও তা-ই যেন হয়েছে বাঙালি কমিউনিটিতে। যেহেতু টিউলিপের অন্য একটা পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বোনের মেয়ে, সে হিসেবে এ নিয়ে বাঙালি কমিউনিটিতে একটু বাড়তি আলোচনা ছিলোই। আওয়ামী রাজনীতির ধারার মানুষগুলো টিউলিপকে বিভিন্নভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। নির্বাচনের আগে টিউলিপের ফান্ড রাইজিং অনুষ্ঠানে এ ধারার মানুষগুলো বিভিন্নভাবে এগিয়ে এসেছেন। লেবার পার্টির কর্মীদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ব্যাপক সংখ্যক কর্মীরা অন্তত এ কাজটি করেছেন। শুধু লন্ডন নয়, লন্ডনের বাইরের বিভিন্ন শহর থেকে টিউলিপের পার্টির ফান্ড সংগ্রহে অংশ নিয়েছেন তারা।লেবার পার্টির এ আসনটিতে বাঙালিদের সংখ্যা অল্প। বাঙালিদের এখানে প্রভাব ফেলার কিছু নেই। সে জন্যে ব্রিটেনের রাজনীতিতে যা হবার তা-ই হয়েছে। পার্টির মনোনয়নই এখানে মূলত রাজনীতিতে টিকে থাকা কিংবা এগিয়ে যাবার প্রধান শক্তি। হয়তো সে কারণেই বাঙালিদের অতি উচ্ছ্বসিত হওয়ারও এখানে কিছু নেই, আর অন্যদিকে বাংলাদেশের সরকারবিরোধী কেউ কেউ কিংবা কিছু মৌলবাদী শক্তি টিউলিপের বিরোধিতা করলেও তা মূলধারার রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার মতো কোনো কারণও হয়ে উঠেনি। টিউলপ এখানে বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হননি ঠিকই, কিন্তু এরপরও বলতে হয়, গত নির্বাচনে যেখানে ৪২ ভোটের ব্যবধানে লেবার পার্টির প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন, সেখানে এবারে টিউলিপ ১১৩৮ ভোট বেশি পেয়েছেন। সে হিসেবে যে ব্যাপারটা জোর দিয়ে বলা যায়, নোংরামি ব্যাপারটা কেউ এখানে করতে চাইলেও তা হয়ে ওঠেনি, কারণ এটা বাঙালিদের এলাকা নয়।রাজনীতি এখানে চলে রাজনীতির মতোই। মাঠ থেকে উঠে আসতে হয়। চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে লিফলেট বিতরণ থেকে শুরু করে নিজের যোগ্যতাকে প্রথমে নিজের দলের কাছে তুলে ধরতে হয়, গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হয় নিজেকে দলের কাছে। তারপরই পার্টির মনোনয়ন আশা করা যায়। উচ্চ শিক্ষিত টিউলিপেরও সে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।বছরের পর বছর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে স্থানীয় জনগণের শোকে-সুখে থাকতে হয়েছে, কাজ করতে হয়েছে মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। পার্টি যে সংসদীয় এলাকায় ভালো অবস্থানে থাকে, সেখানে তার দল ভালো ফলাফল নিয়ে আসে। এটাই ব্রিটেনের কিংবা গণতন্ত্রের চর্চার দেশগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য। যারা বলেন টিউলিপ শেখ হাসিনার ভাগনি কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি সে জন্যে একপক্ষ যখন বলেন তাকে বিজয়ী করতে হবে কিংবা অন্যপক্ষ বলেন তাকে হারাতে হবে, তারা মূলত কোনো কিছুই করার ক্ষমতা রাখেন না, শুধু বাংলাদেশি রাজনীতির স্বপ্নালোকেই তারা বাস করেন।রুপা হকও একইভাবে কমিউনিটিতে নিয়ে এসেছেন একটা আশ্বাস। তিনিও ব্রিটেনে তার নিজস্ব একটা পাকাপোক্ত আসন তৈরি করতে দিনের পর দিন কাজ করেছেন। কাউন্সিলর-ডেপুটি মেয়র হিসেবে স্থানীয় কাউন্সিলে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন। পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। লেখালিখি করেন মূলধারার পত্র-পত্রিকায়। লেবার পার্টির হয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়েছেন। একটা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়েই শেষ পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মাত্র ২৭৪ ভোট বেশি পেয়ে তিনি জিতেছেন ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন এলাকায়।আগেই বলেছি বাঙালি কমিউনিটি উচ্ছ্বসিত। তারা মনে করছেন, এরা হয়তো বাঙালি কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করবে সংসদে। মোটেই তা নয়। এরা ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষা করতেই পার্টির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে প্রার্থী হয়েছিলেন। নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েই এরা এখন পার্লামেন্টে। বাঙালি কমিউনিটির জন্যে এ এক বিরাট পাওয়া। কিন্তু মনে রাখতে হবে অন্যান্য কমিউনিটির দিকে তাকালে আমাদের এ অর্জন খুব একটা বেশি নয়। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এমপি হয়েছেন এবার ১০ জন। ভারতীয়রা এ সংখ্যা অনেক আগেই ছুয়েছেন।আমরাও মনে করি আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। এ যাত্রায় রাজনীতিকদের সংখ্যা কম নয়। তবুও মনে হচ্ছে আরো দু‘একটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় আমাদের নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। শুধু গ্রাম্য গোঁড়ামিকে ধারণ করার কারণে ওল্ডহ্যামে বাঙালিদের শক্তিশালী নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। কেন জানি এখানে বাঙালি রাজনীতিকরা সমৃদ্ধ করতে পারছেন না কমিউনিটিকে। এবং সে জন্যেই চৌকস রাজনীতিবিদ না থাকায় স্থানীয় রাজনীতিতে বলিষ্ঠ কোনো কিছু আসছে না। অথচ অনেক আগেই ওল্ডহ্যামে এমপি প্রার্থী হবার কথা ছিলো।যেহেতু ব্রিটেনের এই তিন নারী নিজেদের যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েই ব্রিটেনের নেতৃত্বে এসেছেন, সেহেতু আমরা মনে করি সেদিন আর বেশি দূরে নয়, গ্রাম্য রাজনীতি সরে যাবেই। কূপমুণ্ডকতা, গ্রামের ধোঁয়া-তোলা, ধর্মের ঢাল সবকিছুকে পেছনে ফেলে আগামীর দিনগুলোতে আরো এগিয়ে যাবে ব্রিটিশ বাঙালিরা, এ আশা আমরা করতেই পারি।লেখক : লন্ডনপ্রবাসী কলামিস্টবিএ/আরআইপি
Advertisement