আন্তর্জাতিক

‘আমাদের মেরো না’: আইএসের তাণ্ডব থেকে বাঁচার আকুতি ফিলিপাইনে

ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের মারায়ি শহরে এক সপ্তাহ ধরে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নৃশংস তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন দেশটির হাজার হাজার মানুষ। বাসা-বাড়ি, হাসপাতালে ঢুকে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে জঙ্গিরা। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে তারা এই তাণ্ডব শুরু করেছে। জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন দেশটির খ্রিস্টানরা।

Advertisement

শহরের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে ফিলিপাইন সেনাবাহিনী বিমান হামলা শুরু করেছে। কিন্তু ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সেনা ও জঙ্গিদের লড়াইয়ে শহরে আটকা পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

মারায়ি শহরের প্রবেশ পথের একটি প্রধান সেতুর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। এরপরই মারায়ি থেকে কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছেন স্থানীয়রা। মারায়ি শহরে লুকিয়ে থাকার পর শনিবার পালিয়ে এসেছেন ৩৮ জনের একটি দল। তারা বলছেন, মারায়ির একটি গোপন জায়গা থেকে তারা পালিয়ে এসেছেন। মারায়ি শহরের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে স্থানীয় একটি গোষ্ঠীর হাতে; যারা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট’র (আইএস) সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ফিলিপাইনের মিন্দানাও দ্বীপের একটি শহর মারায়ি। দুই সপ্তাহ আগে শহরটিতে আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে স্থানীয আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের মার্শাল ল জারি করেন।

Advertisement

মারায়ির একটি হাইস্কুলের শিক্ষক জেরোনা সেদ্রোমে (২৭) বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন, গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর আমরা প্রত্যেক রাতে অন্ধকারে মেঝেতে শুয়ে ছিলাম। ফ্রিজ ও অন্যান্য আসবাবপত্র দিয়ে ঘরের দরজার সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলাম।

তিনি বলেন, ‘আইএসের যোদ্ধারা এরপরও বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করে এবং দ্বিতীয় চেষ্টায় সফল হয়। তাই আমরা বাড়ির নিচের একটি সুড়ঙ্গে লুকিয়ে ছিলাম।’

মিন্দানাওয়ে আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে দেশটির আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর এ লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৭৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে; এদের অধিকাংশই আইএস যোদ্ধা। এছাড়া নিহতদের মধ্যে কিছু সেনাসদস্য ও কয়েক ডজন বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন।

২ লাখেরও বেশি মুসলিম অধ্যুষিত ফিলিপাইনের এই শহরের নেতা ইসনিলন হ্যাপিলনকে গ্রেফতারে সরকারি বাহিনীর চেষ্টার পর শত শত বন্দুকধারী গত ২৩ মে শহরে তাণ্ডব চালায়। ফিলিপিনো সেনাবাহিনী বলছে, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ৫০ জনেরও বেশি বন্দুকধারীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মারায়ি শহরের কেন্দ্রস্থল। এ সময় একজন ক্যাথলিক পুরোহিতসহ কমপক্ষে ১৫ জনকে জিম্মি করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককেই মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে জঙ্গিরা।

Advertisement

মানবিক উদ্বেগ

মারায়ি শহরের এই জিম্মিদশা থেকে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে এলেও কর্তৃপক্ষ বলছে, শহরটিতে এখনো দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আটকা পড়েছেন। সেখানে খাবার এবং পানি ছাড়াই দিন কাটাতে হচ্ছে আটকা পড়াদের। আইন-শঙ্খলাবাহিনী আটকা পড়াদের উদ্ধারে অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে। অনেকেই আহত হয়ে পড়েছেন। মিন্দানাওয়ের এই শহরের অধিকাংশ এলাকা আইএস যোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণ করছে।

শুক্রবার  ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস বলেছে, পালিয়ে আসা লোকজনের স্রোত সামলাতে কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করায় খাবার, পরিষ্কার পানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্যানিটেশন এর চাহিদা বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক এই দাতব্য সংস্থা বলছে, মারায়ির এই লড়াই থেকে যারা পালানোর চেষ্টা করলেও অনেকেই শহর থেকে বের হতে পারছেন না। নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরো কঠোর করায় শহরে সরকারি যানবাহনের পরিবহন স্থগিত রয়েছে।

দেশটির সামরিক বাহিনী বলছে, বিমান থেকে কামান ও রকেট ছোড়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে বোমাও নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এছাড়া সেনাবাহিনী সাঁজোয়া যান ও রকেট বিরোধী ট্যাংক ও বিস্ফোরক নিয়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে।

শনিবার লড়াই তীব্র হওয়ায় মিন্দানাওয়ের দানসালান কলেজের ২৩ শিক্ষকসহ অন্তত ৭০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে এক বছর বয়সী এক শিশুসহ আরো সাত শিশুও রয়েছে।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশআইএস জঙ্গিদের তাণ্ডবে কীভাবে খাদ্য ও পানীয় ছাড়া বেঁচে ছিলেন তা উঠে এসেছে শহর থেকে পালিয়ে আসা মানুষের কণ্ঠে। একজন শিক্ষক এএফপিকে বলেন, তারা বৃষ্টির পানি ও বোতলের পানি খেয়ে বেঁচে ছিলেন। ‘বৃষ্টি না হলে আমাদের খাওয়ার জন্য কোনো পানিও থাকতো না। আমরা কিছুই খেতাম না।’- বলেন, ২৫ বছর বয়সী শিক্ষক জ্যান রোজ সেদ্রোমে।

জ্যানের বড় বোন বলেন, তারা মোবাইলের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে সরকারি উদ্ধারকারীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করেছিলেন। পরে যখন জঙ্গিরা সেতুর নিয়ন্ত্রণ হারায় তখন তাদের উদ্ধার করা হয়। রেজেনি অ্যাপাও নামের অপর এক শিক্ষক বলেন, শহর ছাড়ার সময় আমরা অন্তত তিনটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। এই মরদেহগুলোর ওপর পোকা-মাকড় উড়ছে। প্রচুর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, আমরা বুঝতে পােই যে, নিহতরা আইএস জঙ্গি ছিল; কারণ তারা কালো কাপড় ও মুখোশ পরিহিত ছিল।

আইসক্রিম তৈরির কারখানার ২৮ বছর বয়সী শ্রমিক আর্নল্ড বালো বলেন, তিনি এক হাতে এক শিশু ও অন্যহাতে আধা-মিটার একটি ছুরি নিয়ে শহর ছেড়েছেন। বন্দুকধারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই ছুরিই তার একমাত্র সুরক্ষা।

বালো বলেন, শহর ছেড়ে আসার সময় কাছের একটি ভবনের ছাদ থেকে এক বন্দুকধারী স্নাইপার রাইফেল নিয়ে তার দিকে তাক করেন। এসময় তাকে ছুরি ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বন্দুকধারীকে বলেন, আপনার নির্দেশ অনুযায়ী আমি কাজ করবো। দয়া করে আমাদের মেরো না। পরে ছুরি মাটিতে রাখার পর ওই বন্দুকধারী বালোকে শহর ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দেন।

সূত্র : আল-জাজিরা, এএফপি।

এসআইএস/আরআইপি