২৫ থেকে ৩০ রান কম হয়েছে, স্কোরটা ৩৩০ হলে আর একজন স্পেশালিস্ট বোলার দলে থাকলে হয়তো চিত্রটা ভিন্ন হলেও হতে পারতো। গতকাল রাতে ওভালে ইংলিশদের কাছে ৩০৫ রান করে হারের পর অনেক কথা। তবে সব কথার সারমর্ম হলো ওপরেরটা।
Advertisement
সেটা হতো কি হতো না? তা নিয়ে ছোটখাটো বিতর্ক হতেই পারে। ক্রিকেট খেলাটাই এমন, যা শেষে অনেক রকম কথা হয়। কোনো খেলাকে এতটুকু ছোট না করে বলা- যা পৃথিবীর আর কোনো খেলা এত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয় না। কী করে হবে?
আর কোনো খেলা তো আর এত সময় ধরে চলে না। টেস্টের কথা বাদ। ওয়ানডেতে ৩০০ বলের প্রতিটিতে একটি করে ঘটনা ঘটে। একটি ভালো ও দৃষ্টিনন্দন শট দর্শক মন কেড়ে নেয়। আবার কোনো বোলারের অসাধারণ ডেলিভারি ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে উইকেটের পতন ঘটায়। দর্শক মনে আলোড়ন জাগে। একটি নয়নলোভা ক্যাচ, কোনো ডিরেক্ট থ্রো`তে রান আউট- প্রতি বলেই হতে পারে। অধিনায়কের বোলার ব্যবহার, ফিল্ডিং সেটিং- আরও কত ইস্যু থাকে।
তাই ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে নানা রকম হিসাব-নিকাশ। আলোচনা-পর্যালোচনা আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। প্রিয় দল জিতলে যেমন ভক্তরা আনন্দে মেতে ওঠেন, উল্লাস আর উৎসব আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। জয়ের রূপকার বা স্থপতি বনে যান জয়ের নায়ক। পান বীরোচিত সংবর্ধনা। প্রশংসা। স্তুতি।
Advertisement
আর হারলে ভক্ত-সমর্থকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আলোচনা-পর্যালোচনায়। সাথে তীর্যক সমালোচনাও থাকে। যার বা যাদের ব্যর্থতায় দল হারে তারা রীতিমকতো খলনায়ক বনে যান। এর কোনোটাই নতুন ঘটনা নয়। এটা চলে আসছে। হয়তো চলবে অনাদীকাল অবধি।
কাল ওভারে ইংলিশদের কাছে হারের ক্ষত এখনো দগদগে। বাজেটের মতো রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও নাগরিক জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কথাবার্তার পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে হার ও হারের ধরন নিয়ে নানা কথা গোটা দেশে।
তবে হার নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বেশির ভাগই শেষ ৫-৬ ওভারে হাতে পর্যাপ্ত উইকেট থাকার পরও হাত খুলে খেলতে না পারা আর একজন স্পেশালিস্ট বোলার কম খেলানোকে হারের বড় কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। তা নিয়ে বিস্তর কথাবার্তাই শুধু নয়, লেখালেখিও হয়েছে প্রচুর।
কিন্তু এর বাইরেও কথা আছে। ওই কারণ ছাড়াও বাংলাদেশের না পারার আরও কারণ আছে। যা সবার অলক্ষ্যে ঢাকা পড়ে আছে। শুনবেন কি সেই কারণ? কারণ হচ্ছে সাকিব আল হাসানের সেরাটা না পাওয়া। সময়ের প্রবাহতায় পারফরমারের সংখ্যা বেড়েছে। ব্যক্তি নির্ভরতা কমেছে বহুগুণে। এখন বেশ কজন ম্যাচ উইনার পেয়েছে বাংলাদেশ। তামিম, মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর চওড়া ব্যাট অন্যতম নির্ভরতা।
Advertisement
অধিনায়ক মাশরাফির দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া আর মোস্তাফিজের বোলিং নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক সময় টিম বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করছে। কিন্তু তারপরও সাকিব নির্ভরতা রয়েই গেছে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের কার্যকর অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স দলের প্রাণশক্তি।
যিনি একাই টু ইন ওয়ান- ওয়ানডেতে যে ক্রিকেটারের হাত ধরেই সর্বাধিক ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ; সেই সাকিব সেভাবে আলো ছড়াতে পারছেন না। এক কথায় সাকিবকে সাকিবের মতো করে পাচ্ছে না দল। তার ব্যাট সেভাবে কথা বলছে না। বলের ধারও আগের তুলনায় কম। সব মিলে সাকিব যে ভূমিকাটা রাখতেন, দলের সাফল্যে আনুপাতিক হারে তার যে একটা উল্লেখযোগ্য কার্যকর অবদান থাকত, তার অনেকটাই নেই। আর তার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের সামগ্রিক পারফরম্যান্স।
সাকিব বল হাতে নিয়মিতই প্রায় দুই থেকে তিন উইকেট পেতেন। এবং খুব বেশি রান না দিয়ে; গড় পড়তা ৪০-৪৫ রান দিয়ে। সেটা এখন তেমন হচ্ছে না। হোক ব্যাটিং উইকেট, ব্যাটম্যানদের স্বর্গ- তারপরও সাকিব বলে কথা। তার ৮ ওভারে ইংলিশরা ইচ্ছেমতো খেলে ৬২ রান তুলে নেবেন, আর একজন আউটও হবেন না- এ যে কল্পনারও অতীত!
এরকম পরিস্থিতিতে অনেকবার সাকিব বোলিংয়ে এসে ব্রেক থ্রু দিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পরের স্পেলে হয়তো আরও একটি উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে চালকের আসনে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। সাকিবের ক্যারিয়ার, তার অর্জন-প্রাপ্তি আর বল ও ব্যাট হাতে পাওয়া ক্রমাগত সাফল্যর ফিরিস্তির বর্ণনা দিয়েও শেষ করা যাবে না।
দেশের হয়ে সর্বাধিক ১৫ বার ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হওয়া একমাত্র ক্রিকেটার। সেই ১৫ বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার হাতে কি শুধু সাকিব শেষ হাসি হেসেছেন? নাহ। দল মানে বাংলাদেশ জিতেছে। এখন প্রশ্ন হলো সেই সাকিব আল হাসানের কাছ থেকে কি সেরাটা পাওয়া যাচ্ছে?
সাকিব দীর্ঘদিন ধরে দলের সাফল্যে যে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন, তা কি এখন রাখতে পারছেন না? এ নিয়েই আসলে এ প্রতিবেদন। ক্রিকেটার সাকিব অনেক বড়। পারফরমার সাকিব আরও বড়। সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের সেরা পারফরমার।
কিন্তু কঠিন সত্য হলো, প্রায় বছর খানেক সাকিব সেরা ফর্মে নেই। সেটা অস্বাভাবিক নয়। যে কোনো ক্রিকেটারেরই খারাপ সময় যায়। ফর্ম খারাপ হতেই পারে। শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে ভিভিয়ান রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা, জ্যাক ক্যালিস, ইমরান খান, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি- সবারই খারাপ সময় কাটিয়েছেন।
এখন খুঁটিয়ে দেখতে হবে সাকিবও সেই খারাপ সময় কাটাচ্ছেন কিনা? তার গুরু সালাউদ্দীন কিন্তু মাত্র কদিন আগে জাগো নিউজের সাথে আলাপে বলেছেন, সাকিবের বলে যে অ্যাকিউরিসি ছিল, তা কমেছে। আগে সাকিব কিছু আলগা ডেলিভারি দিয়ে মার খেলেও ঠিক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার একদম জায়গামতো বল করতে পারতেন। অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানের পক্ষেও যা মারা কঠিন ছিল।
এছাড়া ফ্লাইটে বৈচিত্র্য আর হঠাৎ হঠাৎ শার্প টার্ন- এ দুুটিও ছিল সাকিবের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। কিন্তু নির্মম সত্য হলো তার কোনোটাই এখন খুব চোখে পড়ছে না। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়ই সাকিব ফ্লাইটে বৈচিত্র্য এনে বহু ব্যাটসম্যানকে ঘোলা পানি খাইয়ে ছেড়েছেন। আবার কখনো কখনো কিছু ডেলিভারির স্বাভাবিকের অস্বাভাবিক দ্রুত ও বেশি স্পিন করে ব্যাটসম্যানকে ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়েছেন।
কিন্তু আজকাল তাও চোখে পড়ছে কম। সেটা যে গতকাল ওভালে বল হাতে কিছু করতে না পারার কারণেই বেশি বলা হচ্ছে, তাও নয়। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, সেই সাকিব নেই এখন। আগে আসুন তার ব্যাটিং পরিসংখ্যান দেখি। গত বিশ্বকাপের পর ৩৩ ইনিংসে কোনো শতরান নেই।
গত এপ্রিলে পাকিস্তানের সাথে তিন ম্যাচের সিরিজ থেকে গতকাল ওভালে ইংল্যান্ডের সাথে হওয়া খেলাগুলোয় সাকিবের ইনিংসগুলো একনজরে দেখুন: ৩১+৭+ ব্যাট করেননি + ৫২+৫১*+২০+৪৮+০*+ব্যাট করেননি + ১৬+৪৮+১৭+১৭+৫৯+৪+৩+৭৯+৫৪+৭২+১৮+৭+১৪+৬+১৯+১০। শেষ সেঞ্চুরি করেছেন প্রায় তিন বছর আগে; ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে(১০১)।
এতো গেল ব্যাটিংয়ের চিত্র। এবার আসুন বোলার সাকিবকে দেখি। যার ১৭৪ ম্যাচে ২২৪ উইকেট, সেই সাকিব শেষ ৩৩ ম্যাচে ১০ বার উইকেট পাননি! ভাবা যায়? স্বর্ণ সময়ের সাকিবের সাথে এটা মেলানো যায়? গত বছর ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১০ ম্যাচে উইকেট মোটে ৯ টি। এর মধ্যে ৫ খেলায় উইকেটশূন্য। সেরা বোলিং ৬৯ রানে ৩ উইকেট।
সর্বশেষ ৪ উইকেট পেয়েছেন দেড় বছর আগে; ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেরেবাংলায় আফগানিস্তানের সাথে (৪/৪৭)। তারপর ১৫ খেলায় (একটিতে বল করেননি) ১৪ বার বল হাতে নিয়ে একবারের জন্য চার উইকেটের পতন ঘটাতে পারেননি।
শেষ কথা, সাকিব গত প্রায় দশ বছর ব্যাট ও বল হাতে দুর্দান্ত পারফর্ম করে দলের সেরা অললাউন্ডার। সেই সঙ্গে বিশ্বেরও এক নম্বর অলরাউন্ডার। কিন্তু এখন কিছু দিন ধরে সেই অনুপাতে পারফরম্যান্স হচ্ছে না। সেটা যে শুধু তার পরিসংখ্যানকে দুর্বল করছে, তা নয়। দলকেও ভোগাচ্ছে। কারণ যতই সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বলা হোক না কেন, বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ সাকিব আল হাসান।
ব্যাট ও বলে দলের টালিকাশক্তিও। সেই পারফরমার যখন অনুজ্জ্বল ও অকার্যকর- তখন তা দলের পারফরম্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবেই। আসলে সেটাই হয়েছে। মাঝে কিছু ম্যাচ মোস্তাফিজ জিতিয়েছেন। তার বৈচিত্র্যে ভরা বোলিংয়ের কাছে অনেক বড় ব্যাটসম্যানই নাকানি-চুবানি খেয়েছেন। তাতে বাংলাদেশেরই লাভ হয়েছে। সাফল্যের ভাণ্ডার হয়েছে সমৃদ্ধ।
তাই সে অর্থে সাকিবের অনুজ্জ্বলতা ও কম কার্যকারিতা সেভাবে চোখে পড়েনি। কিন্তু এখন মোস্তাফিজের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় সাকিবের দ্যুতি ও ধারহীন বোলিংটা আর বেশি চোখে পড়ছে।
এআরবি/এনইউ/পিআর