আর মাত্র কয়েকদিন। বছরের সবচেয়ে সেরা ম্যাচটির অপেক্ষায় আমরা সবাই। পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। ইতোমধ্যেই পুরো ক্রিকেট বিশ্বে এই ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মুখে মুখে ফিরছে এজবাস্টনে অনুষ্ঠিতব্য এই ম্যাচ নিয়ে আলোচনা। সারা বিশ্বের লক্ষ-কোটি ক্রিকেট ভক্তের মতো আমি নিজেও এই ম্যাচের উত্তেজনায় ভুগছি। প্রত্যাশা করছি, দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে অসাধারণ একটি ম্যাচ দেখার, যে দুই দলের মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যমণ্ডিত ক্রিকেট ইতিহাস।
Advertisement
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিই একমাত্র ইভেন্ট, যেখানে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের সাফল্য রয়েছে। ২০০৪ সালে এই এজবাস্টনেই আমরা ভারতের বিপক্ষে জিতেছিলাম এবং ২০০৯ সালে সেঞ্চুরিয়নেও তাদের হারিয়েছিলাম। এবারও আমার প্রত্যাশা সবুজ জার্সিধারীরা এজবাস্টনে আবারও জ্বলে উঠবেন এবং ভারতের বিপক্ষে নিজেদের রেকর্ডকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
ভারত-পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এটা যেমন ঠিক, তেমনি প্রচলিত ধারণার বিপরীত বিষয়ও আছে। অবশ্যই এখানে কিছু বৈপরিত্য রয়েছে। যেমন গৌতম গম্ভীর। আমি অবশ্যই বলতে পারি, তিনি কখনই বন্ধু মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। কফি শপে প্রায়ই আমরা একে অপরের দেখা পেয়েছি (সেখানেও দেখেছি তার মধ্যে বন্ধু মনোভাব নেই)।
এর কারণ হচ্ছে, কয়েক বছর আগে মাঠের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে তার কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছিল। এবং এ ঘটনা পুরো বিশ্বেই খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছে। যখন আমি এই জীবনে (ক্রিকেট ছেড়ে, বর্তমান জীবন) প্রবেশ করেছি, তখন বুঝতে পারছি ওই ঘটনা ছিল আসলে খেলারই একটা অংশ এবং ম্যাচের মোড়কে আবদ্ধ। গৌতম হয়তো সেটাকে কোনোভাবে ভুলতে পারছেন না। গৌতমের জন্য শুভ কামনা!
Advertisement
যখন গৌতম পুরোপুরি ব্যতিক্রম এক ব্যক্তি, তখন ভিন্ন দিকটাও তুলে ধরতে চাই। ভারতীয় অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গে আমার দারুণ সুসম্পর্ক রয়েছে। যুবরাজ সিং, জহির খান এবং হরভজন সিংয়ের সঙ্গে তো আমার চমৎকার সম্পর্ক। এই তিনজন সত্যিকার অর্থে আমার সতীর্থ। এই তিনজনের সঙ্গে আমার দারুণ কিছু মুহূর্তও রয়েছে। দুই দল যখন নিয়মিত খেলত এবং একে অপরের দেশে নিয়মিত সফর বিনিময় করত- তখন থেকেই আমাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল।
নিজেদের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে একসঙ্গে আমরা চলাফেরা করতাম। এমনকি একে অপরের বাড়িতে গিয়েও থাকতাম। এখন আমরা সবাই বিবাহিত। এ কারণেই হয়তো দায়িত্ব এবং গুরুত্বের বিষয়টা সবার কাছেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবুও যখন আমাদের একে অপরের সাক্ষাৎ পাই, তখন আমরা পুরনো দিনগুলোতে ফিরে যাই। শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার মধ্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনা করি।
একবার ভারতীয় দল পাকিস্তান সফর করতে এসেছিল। ওই সময় পুরো ভারতীয় দলটিকেই আমি আমার করাচির বাড়িতে দাওয়াত করেছিলাম। আমরা তাদের জন্য পাঠান স্টাইলে বিশেষ ধরনের খাবার প্রস্তুত করেছিলাম। যে ডিশটা ছিল মেষশাবক এবং খাশি দিয়ে পূর্ণ। যখন খাবার পরিবেশন করা হলো, তখন পুরো রুমে পূর্ণ নীরবতা বইছিল এবং আমার ভারতীয় বন্ধুরা সবাই তখন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। এই মুহূর্তে এসে আমি বুঝতে পারলাম আমার সম্মানিত অতিথিরা এ ধরনের খাবার খেতে কখনও অভ্যস্ত ছিলেন না।
তাদের মধ্যে আবার কয়েকজন ছিলেন নিরামিষভোজি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের জন্য ডিশ পরিবর্তন করে নিয়ে আসলাম ডাল এবং সবজিজাতীয় খাবার। আমি ওই সময় আসলে কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। লজ্জাও পেলাম। আমাদের মধ্যে সমান সংস্কৃতি না হওয়ার পর যে মেন্যু সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে খাবার তৈরি করে ফেলেছিলাম সেজন্য। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আগে থেকেই খাবারের মেন্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া খুব প্রয়োজন।
Advertisement
বর্তমান দলটির মধ্যে আরেকজন ক্রিকেটারকে আমি খুব পছন্দ এবং সম্মান করি। তিনি হচ্ছেন বর্তমান ভারতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। ব্যাট হাতে দুর্দান্ত এক ক্রিকেটার এবং তার অসাধারণ ফিট শরীরের মধ্যে রয়েছে দারুণ একটি আত্মা। আমি সব সময়ই তাকে স্মরণ করি, কারণ ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় কলকাতায় সে আমাকে ভারতীয় ক্রিকেটারদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি জার্সি উপহার দিয়েছিল। সেই জার্সিটি আমার সংগ্রহশালায় সর্বাগ্রে অবস্থান করছে। এই জার্সি শুধু আমাকে ভারতে এসে খেলা স্মরণই করায় না, ভারতীয় ক্রিকেটারদের অনেকের সঙ্গে যে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে সেটাও মনে করিয়ে দেয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো না থাকার কারণে আমাদের পরস্পরের মধ্যে ক্রিকেট সফর বন্ধ রয়েছে। শুধু সফরই নয়, ক্রিকেট খেলাটাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তবে ভারতীয় ক্রিকেট বন্ধুদের সঙ্গে ভালো সময়গুলো আমি খুব মিস করি এবং আমি নিশ্চিত তারাও আমার মতো এমন চিন্তা করে। আশা করি এ অবস্থান দ্রুত অবসান ঘটবে। আমাদের পুরনো বন্ধুদের পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটবে এবং আমরা আবারও স্মৃতিচারণে মেতে উঠতে পারব।
আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি, যখন শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, ভিভিএস লক্ষ্মণ, অনিল কুম্বলে, মহেন্দ্র সিং ধোনি, হরভজন সিং, জহির খান, যুবরাজ সিংদের সময়ে খেলতে পেরেছি। অন্যদিকে আমি খেলেছি আমাদের দলে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, ইনজামাম-উল হক, মোহাম্মদ ইউসুফ, শোয়েব আখতার, মঈন খান, সাঈদ আনোয়ার, সাকলায়েন মোস্তাকদের মতো ক্রিকেটারের সঙ্গে। আমি ভাবতেই পারি না, এর চেয়ে আর ভালো কিছু পেতে পারতাম।
পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে অনেকগুলো স্মরণীয়, রোমাঞ্চকর এবং শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, ওই ম্যাচগুলোর বেশ কয়েকটিতে ভারতের বিপক্ষে ভালো কিছু ইনিংস খেলতে পেরেছি। কানপুরে ২০০৫ সালে যে ওয়ানডে সেঞ্চুরিটা করেছিলাম, সেটা ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়। আমার ওই ইনিংসটিই ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানকে সিরিজে লিড এনে দিয়েছিল। প্রথম দুই ম্যাচ হারের পর শেষ পর্যন্ত সিরিজটি আমরা জিতেছিলাম ৪-২ ব্যবধানে।
কানপুরে সেঞ্চুরি করে পাকিস্তানকে লিড এনে দেয়ার পর যুবি, ভাজ্জি এবং জহির আমার হোটেল রুমে এসেছিল। এসে আমার সঙ্গে খুব মজা করল। কিছুটা টিজও করলেন এই বলে যে, তারা খুব সহজে সিরিজ জিতে যাবে। সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরি করে কোনো লাভ নেই। তারা নানা কথাবার্তা বলে আমাকে উত্তেজিত এবং রাগান্বিত করে তোলার চেষ্টা করছিল। শেষ পর্যন্ত ৪-২ ব্যবধানে জয়ের পর আল্লাহর কাছে আমি প্রার্থনা করলাম, চার ম্যাচে জয় দিয়ে আমাদের সম্মানটা ধরে রাখার জন্য।
আজ থেকে ১২ বছর পর আমি চিন্তা করতে পারছি, যুবি-ভাজ্জিরা এসে আমাকে যে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল, সেটা ছিল আমার জন্য অনুপ্রেরণার। বিশেষ করে কানপুরে সেঞ্চুরিটা করার পর তারা এসে আমাকে অনুপ্রেরণাই দিয়ে গিয়েছিল। ওটাই হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার অন্যতম সেরা একটি ইনিংস।
এজবাস্টনে আসন্ন ম্যাচটি নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। আশা করছি একটি ক্ল্যাসিক পাক-ভারত ম্যাচ দেখতে পাব আমরা। ভারত এমনিতেই শক্তিশালী দল। তার ওপর আমাদের বিপক্ষে সাম্প্রতিক সাফল্য তাদের মানসিকভাবে এগিয়ে রাখবে। ভারত এমনিতেই ব্যাটিং পাওয়ারহাউজ। সবসময়ই ব্যাটিং প্রতিভার জন্ম দেয়। আবার এই ব্যাটিংকেই দারুণ সহযোগিতা করে যাচ্ছে একটি সুশৃঙ্খল আক্রমণাত্মক বোলিং লাইনআপ।
তবে আমি মনে করি পাকিস্তানের বোলিং লাইনআইপই সবচেয়ে দুর্দান্ত। যারা ভারতীয় ব্যাটিংকে সব সময় চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত। বিশেষ করে ইংলিশ কন্ডিশনে। তবে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ যেমন হয়, তেমনই সর্বদা একটি স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ হবে এবারও। যে কারণে দুই দলকেই দিতে হবে চরম ধৈর্যের পরীক্ষা।
তবে যেহেতু ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হবে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে। সে কারণে খেলোয়াড়দের ওপর স্নায়ুর উত্তেজনা এবং চাপটা থাকবে একটু কমই। তবে যত কিছুই হোক, আমি চাই ইতিবাচক একটি ম্যাচ। এবং শেষ পর্যন্ত আমি পাকিস্তানের পক্ষেই কথা বলব এবং চাইব ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানই জিতুক।
সূত্র : আইসিসি-ক্রিকেট.কম
আইএইচএস/আরআইপি