ভ্রমণ

প্রথম এভারেস্ট জয়ের গল্প

হিন্দু শাস্ত্র দেবীস্তোস্ত্রতে বলা হয়েছে, ‘ভূমণ্ডলে যতদিন পর্যন্ত পাহাড় ও অরণ্য রইবে ততদিন বিশ্ব টিকে থাকবে।’ পাহাড় সব সময়েই জাদুকরী ও বিচিত্র রহস্যময়তায় পূর্ণ। আর মানুষ রহস্যের পেছনেই ছুটে চলতে বেশি আগ্রহী। তাই মানুষের মন আর বসে থাকে না। পৃথিবীর সব থেকে দুর্গম স্থান পর্বত। সেই পর্বতে শ্বেত-শুভ্র বরফ শীতল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু যে বিন্দু তাহলো এভারেস্টের চূড়া। যাকে স্থানীয় মানুষ ঈশ্বর হিসেবে পূজা করে। আর এই ঈশ্বর সমতুল্য পর্বত আরোহণের নেশাও মানুষের মধ্যে থেমে রইলো না। পর্বতের প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই অজানাকে জানতে এগিয়ে চললো। যার ফলস্বরূপ মানুষ ২৯ মে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে পদচিহ্ন ফেলে।

Advertisement

সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি

প্রথমে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হত। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল অ্যান্ড্রু স্কট ওয়াহ হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত সওয়াজপুর স্টেশন থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ২৩০ কিলোমিটার বা ১৪০ মাইল দূরত্বে আরো একটি শৃঙ্গ লক্ষ্য করেন। প্রায় একই সময় জন আর্মস্ট্রং নামে তার এক কর্মচারীও আরো পশ্চিম থেকে এই চূড়াটি লক্ষ্য করেন এবং একে peak-b হিসেবে অভিহিত করেন। ওয়াহ পরবর্তীতে মন্তব্য করেন যে, যদিও পর্যবেক্ষণ হতে বোঝা যাচ্ছিলো যে peak-b কাঞ্চনজঙ্ঘা অপেক্ষা উচ্চতর, তা সত্ত্বেও প্রমাণের জন্য আরো নিকটতর স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন ছিলো। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেরাদুন শহরে অবস্থিত সদর-দফতরে বাঙালি গণিতবিদ ও পর্যবেক্ষক রাধানাথ শিকদার নিকলসনের মাপ-জোক থেকে ত্রিকোণমিতিক গণনা করে সর্বপ্রথম নির্ণয় করেন যে, এই শৃঙ্গ বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এছাড়াও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, এই শৃঙ্গের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৩৯.২ মিটার বা ২৯ হাজার ফুট হওয়ায় এই শৃঙ্গ সম্ভবত বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পরে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে একটি ভারতীয় জরিপে এই শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ণয় করা হয় ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার বা ২৯ হাজার ২৯ ফুট, যা ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে একটি চীনা জরিপ দ্বারা নিশ্চিত করা হয়।

নামকরণ

Advertisement

যদিও প্রথম দিকে পিক-১৫ নামে পরিচিত ছিলো পরে গবেষকদল পর্বতশৃঙ্গগুলোর নামকরণ স্থানীয় নামে রাখতে ইচ্ছুক ছিল, কিন্তু বিদেশিদের জন্যে তিব্বত ও নেপাল উন্মুক্ত না থাকায় তার স্থানীয় নামের অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু এই পর্বতের বেশ কয়েকটি স্থানীয় নাম ছিল, যেমন দার্জিলিং অঞ্চলে প্রচলিত দেওধুঙ্গা বা পবিত্র পর্বত, তিব্বতে প্রচলিত চোমোলাংমা, নেপালে সাগরমাথা। সার্ভেয়র জেনারেল জর্জ এভারেস্টের নামে এই শৃঙ্গের নামকরণের সুপারিশ করেন। যদিও জর্জ স্বয়ং তাঁর নিজের নাম ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন এবং তিনি রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিকে জানান যে, এভারেস্ট নামটি হিন্দিতে লেখা যায় না ও ভারতীয়রা উচ্চারণ করতে পারেন না। এরপরেও বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট।

প্রথম অভিযানসমূহ

১৮৫৫ সালে আলপাইন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন টমাস ডেন্ট তার বই ‘Above The Snow Line’ এ মন্তব্য করেন যে, এভারেস্ট পর্বতে আরোহণ করা সম্ভব। ব্রিটিশ পর্বতারোহীরা সর্বপ্রথম এই পর্বতশৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা শুরু করেন। নেপালে এই সময় বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় ব্রিটিশরা তিব্বতের দিক থেকে এই পর্বতের উত্তর শৈলশিরা ধরে বেশ কয়েকবার আরোহণের চেষ্টা করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে ব্রিটিশরা তিব্বতের দিক থেকে ৭ হাজার মিটার বা ২২ হাজার ৯৭০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত ওঠেন। এরপর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের অভিযানে এই পথে জর্জ ফিনচ প্রথমবারের মত অক্সিজেন ব্যবহার করে পর্বতারোহণ করেন। তিনি ৮ হাজার ৩২০ মিটার বা ২৭ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠে মানব ইতিহাসের নতুন কীর্তি স্থাপন করেন। যা ছিল সর্বপ্রথম কোনো মানুষের এই  উঁচুতে আরোহণ।

ম্যালোরি এবং কর্নেল ফেলিক্সও দ্বিতীয়বারের মতো ব্যর্থ অভিযান করেন। এই অভিযান থেকে নেমে আসার সময় তুষারধসে সাতজন মালবাহকের মৃত্যু হয়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের অভিযান এভারেস্ট আরোহণের ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় অভিযান। ম্যালোরি এবং ব্রুসের প্রাথমিক প্রচেষ্টা স্থগিত করতে হয় আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে। পরবর্তী প্রচেষ্টা চালান নর্টন এবং সমারভিল, তারা অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই অভিযানে নামেন এবং নর্টন ৮ হাজার ৫৫৮ মিটার বা ২৮ হাজার৭৭ ফুট আরোহণ করেন। ১৯২৪ সালের ৮ জুন জর্জ ম্যালোরি ও এন্ড্রু আরভিন উত্তর গিরিখাদ দিয়ে এভারেস্ট চূড়া বিজয়ের মিশন শুরু করেন। এই অভিযান থেকে তাদের আর ফিরে আসা হয়নি।

Advertisement

১৯৯৯ ম্যালোরি ও আরভিন রিসার্চ এক্সপেডিশন নর্থ ফেসের নিচে, ক্যাম্প-৬ এর পশ্চিমে একটি তুষার গহ্বর থেকে ম্যালোরির মৃতদেহ উদ্ধার করে। তারা দু’জন এভারেস্ট চূড়ায় ১৯৫৩ সালে হিলারি ও তেনজিংয়ের স্বীকৃত সর্বপ্রথম বিজয়ের আগে আরোহণ করতে পেরেছিলেন কি না তা নিয়ে পর্বতারোহী সমাজে বহু বিতর্ক রয়েছে। ১৯৫২ সালে এডওয়ার্ড উইস-ডুনান্টের নেতৃত্বাধীন একটি সুইস অভিযাত্রী দল নেপাল দিয়ে এভারেস্টে আরোহণ অভিযানের চেষ্টা করার অনুমতি লাভ করে।

দলটি খুম্বু আইসফলের মধ্যদিয়ে একটি রুট প্রতিষ্ঠা করে এবং দক্ষিণ গিরিখাদের ৭ হাজার ৯৮৬ মিটার বা ২৬ হাজার ২০১ ফুট আরোহণ করে। রেমন্ড ল্যাম্বার্ট এবং শেরপা তেনজিং নোরগে দক্ষিণ-পূর্ব রিজের ৮ হাজার ৫৯৫ মিটার বা ২৮ হাজার ১৯৯ ফুট ওপরে ওঠেন, যা ছিল উচ্চতা আরোহণে মানুষের নতুন রেকর্ড। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ২৯ জুন এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে নেপালের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব শৈলশিরা ধরে প্রথম এই শৃঙ্গ জয় করেন।

এই জয় নিয়েও একটু কথা আছে। যে কথাটি তেনজিং নোরগে তার ‘বায়োগ্রাফি অব তেনজিং’ এ বলেছেন। কথাটি হলো, ‘আমি অবশ্যই হিলারির আগে চূড়ায় পৌঁছেছি। সেটা হতে পারে এক গজ, এক ফুট কিংবা এক ইঞ্চি।’ কে আগে বা কে পরে সেটা এখন মুখ্য নয়। এভারেস্ট জয় হয়েছে সেটাই মুখ্য। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে চীনা পর্বতারোহী ওয়াং ফুঝোউ, গোনপো এবং চু ইয়িনহুয়া উত্তর শৈলশিরা ধরে প্রথম শৃঙ্গ জয় করেন।

যত রেকর্ড

১৯৭৮ সালের ৮ মে অস্ট্রিয়ার পিটার হেবলার এবং ইতালির রেইনহোল্ড মেসনার প্রথম অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট এর চূড়ায় সফলভাবে অরোহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ মে প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করার কৃতিত্ব লাভ করেন জাপানের জুনকো তাবেই। প্রথম প্রতিবন্ধী হিসেবে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টম হুইটেকার এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন। একটি কৃত্রিম পা নিয়েও তিনি এভারেস্ট জয় করে বিশ্ববাসীকে চমকে দেন। সবচেয়ে কম বয়সে জর্ডান রুমেরু (১৩), সবচেয়ে বেশি বার এভারেস্ট আরোহণ করে আপা শেরপা ও ফুরবা তাসি। তারা দু’জনেই ২১ বার করে আরোহণ করে এবং সবচেয়ে কম সময়ে বেসক্যাম্প থেকে আরোহণ করে পেম্বা দর্জি। তিনি সময় নেন মাত্র ৮ ঘণ্টা।

পর্বতারোহণে বাংলাদেশ

সমুদ্রসমতলের মানুষও এভারেস্টের চূড়া আরোহণ করেছে। বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা তুলে ধরেছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায়। এমএ মুহিত, নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরিন ও সজল খালেদ এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে। সজল খালেদ আরোহণ শেষে নেমে আসার পথে না ফেরার দেশে চলে যান।

কেন এভারেস্ট শৃঙ্গ আরোহণ করতে চান? এমন প্রশ্নে মহান পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরির বিখ্যাত উত্তর দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘কেননা এটা সেখানে রয়েছে।’

লেখক : পর্বতারোহী

এসইউ/আরআইপি