ইদানিং ‘সাকসেস’ ব্যাপারটা নিয়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হচ্ছে। সাকসেসফুল মানুষকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। এমনকী কর্মজীবনে সাফলতার দেখা পাওয়া মানুষদের সংবর্ধনা-গণসংবর্ধনা দিতেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- সাকসেসফুল আসলে কারা? যারা দেশের সবচেয়ে উঁচু সরকারি চাকরি করছেন কিংবা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন অথবা বিশাল কর্পোরেট জব করছেন। নাকি এমন কেউ- গ্রামের সেই সাদাসিধে স্কুলশিক্ষক যিনি যুগের পর যুগ এরকম বিভিন্ন সরকারি বড় চাকুরে‚ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার‚ ব্যাংকার তথা মানুষ তৈরির কারখানায় অবিরাম অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন? একজনকে সাকসেসফুল পারসন বলার মাপকাঠিটাই বা কী? কেনই বা একজনকে আমরা সাকসেসফুল পারসন বলবো? উঁচু চেয়ার বা উঁচু পদ দখল করলে কিংবা ব্যাংক ব্যালেন্স অর্জন করে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করলেই কি একজনকে সাকসেসফুল পারসন বলবো? সাফল্য আসলে তাহলে কী? এর সংজ্ঞাই বা কী হওয়া উচিত?
Advertisement
এক পরিচিত বড় ভাই আছেন যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে নিজগ্রামে গিয়ে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন কিন্ডার গার্টেন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সময়ের পরিক্রমায় সেই কিন্ডার গার্টেনে পড়ুয়া অনেকেই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র! তাহলে কি আমরা সেই বড় ভাইকে ‘সফলদের’ একজন বলতে পারি না?
আমার গ্রামের পাশের একটি গ্রামে ছোটবেলায় আমরা ছোটরা কেউই যেতাম না। যেতাম না মানে যেতে ভয় পেতাম। কারণ ওই এলাকার ছেলেরা খুব একটা সুবিধার ছিল না। যাকে পেতো তাকেই অনর্থক মারধর করতো আর অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতো। ছোট ছিলাম বিধায় বুঝতাম না তারা কেন এমন করতো। আসলে ওই গ্রামে কোন স্কুল ছিলো না আর অন্যান্য স্কুলগুলোও অনেক দূরে ছিল; ফলে ওদের ভেতরটা পরিবর্তন হওয়ার মতো কোন উপাদান ওরা খুঁজে পেতো না বরং সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়াতো। হঠাৎ একদিন ওখানে এক শিক্ষিত তরুণের উদ্যোগে টিনশেড স্কুল দাঁড়িয়ে গেল যা দেখে লোকজন হাসাহাসি করতে লাগলো। তরুণকে অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছিল সেই সময়। ৪-৫ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু করা টিনশেড ঘরটি আজ দোতলা বিশিষ্ট পাকা বিল্ডিংয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর ৯০ সালের সেই তরুণটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক! সমাজকে বদলে দেওয়া সেইদিনের সেই মানুষটিকে কি আমরা সাকসেসফুল বলতে পারি না? ভদ্রলোক একটি গণসংবর্ধনা আশা করতেই পারেন আমাদের কাছ থেকে।
যা হোক‚ বলছিলাম সাফল্য নিয়ে। আমার আরেক পরিচিত একজন পড়াশোনা শেষ করে এলাকায় খামার করেছেন। যেখানে হাস-মুরগী পালন থেকে শুরু করে মাছ চাষ‚ গবাদি পশু পালন করেন। সেইসঙ্গে ফল-মূল আর সবজিও উৎপাদিত হয়। ভদ্রলোক আমাদের খাদ্যের জোগানের পাশাপাশি নিজের কর্মসংস্থানসহ প্রায় ২০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন। ওনাকে কি আমরা সফলদের কাতারে রাখতে পারি না?
Advertisement
আরেক বন্ধু চাকরি না খুঁজে শুরুতেই নিজ এলাকায় রড-সিমেন্টের দোকান খুলে বসেছেন। সব মিলিয়ে তার দোকানে এখন ৭ জনের মতো কাজ করে। এরমধ্যে আছেন ২ জন সেলসম্যান‚ একজন ম্যানেজার‚ মালপত্র ওঠানো-নামানোর জন্য দু’জন আর দু’জন আছে গ্রাহকদের অর্ডার নিশ্চিন্তে পৌঁছে দেওয়ার কাজে। সেই বন্ধুর ব্যবসায়ের ওপর নির্ভর করে চলছে ৮টি পরিবার। আবার নিজ এলাকায় বসবাস করার কারণে স্থানীয় লোকজনের যেকোন সমস্যা সমাধানে সবার আগেই হাজির হয়ে যায় বন্ধুটি। কেউ অসুস্থ তো শোনামাত্র তিনি হাজির হয়ে যান। টাকার অভাবে কেউ বই-খাতা কিনতে পারছে না তো ওর কাছে গেলে নিমিষেই সমাধান হয়ে যায়। সমাজে অবদান রেখে যাওয়া এই বন্ধুটিকে কি আমরা ফেইলর বলবো?
এতো কিছু বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে দু’টি- এক. সরকারি চাকরি-ব্যাংকসহ অন্যান্য যেসব কর্পোরেট জবকে আমরা যেভাবে হাইলাইট করছি প্রতিনিয়ত‚ তাতে দিন দিন কতিপয় সিলেক্টেড চাকরির ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে কম্পিটিশন আর তুমুল কম্পিটিশনে টিকতে না পেরে হতাশায় ভুগছেন অনেকেই। অথচ চাইলে এদের অনেকেই চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিতে পারতেন। বেকারত্বের খাতায় নাম না লিখিয়ে সমাজ পরিবর্তনে সহজেই অবদান রাখতে পারতেন।
দুই. সাফল্যের মাপকাঠি হওয়া উচিত- একজন মানুষ সমাজে কীভাবে এবং কতটুকু অবদান রাখলেন তার উপর ভিত্তি করে। সবাইকে সরকারি বড় চাকরিজীবী‚ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যাংকার কিংবা বড় কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তার চেয়ে বরং নতুন কিছু করুন যা সমাজকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত।
Advertisement
এসইউ/পিআর