অধ্যাপক আবু আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। দেশের চলমান অর্থনীতি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র।
Advertisement
আলোচনায় গুরুত্ব পায় অর্থপাচার, খেলাপি ঋণ, ব্যাংক-বীমা, আসন্ন বাজেট ও নতুন ভ্যাটনীতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ। আলোচনা প্রসঙ্গে উঠে আসে রাজনীতি ও ভূরাজনীতির খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ও। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : দেশের অর্থনীতিতে নানা সম্ভবনার কথা গুরুত্ব পাচ্ছে। আছে শঙ্কার কথাও। কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন অর্থনীতির চলমান পরিস্থিতি?
অধ্যাপক আবু আহমেদ : অর্থনীতির চলমান ধারা খারাপ বলা যাবে না। মোটামুটি ভালো বলেই মনে করি। তবে আমাদের চাইতে দক্ষিণ এশিয়াতে অনেকেই ভালো করছে। প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটাও মন্দ না। প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জিত না হলেও ৭ শতাংশ হলেও ভালো বলা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি অর্জনের এ ধারাবাহিকতা আসলে কতদিন থাকবে?
Advertisement
অর্থনীতির চাকা আরও সচল করতে হলে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের কোটা পার হতে হবে। ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে আমাদের অর্থনীতির জন্য সুখের বার্তা নিয়ে আসবে। কিন্তু অর্থনীতির সূচক সে কথা বলে না। সূচকগুলো যেভাবে নাড়া দিচ্ছে, তাতে শঙ্কাই প্রকাশ পাচ্ছে। জাগো নিউজ : সূচকগুলো নিয়ে যদি বলতেন?
অধ্যাপক আবু আহমেদ : রেমিট্যান্স ভয়াবহ মাত্রায় কমে গেছে। সরকার বলছে, ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থাৎ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসছে। সরকারের তো এটি দেখার কথা। তা তারা দেখছে না।
রফতানির গতি কমে গেছে। ইতোমধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান শ্রীলংকাসহ কয়েকটি দেশকে জিএসপি সুবিধা দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের। বিনিয়োগ বাড়ছে না। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়েনি তেমন। গ্যাস ও টেলিকম সেক্টরে বিনিয়োগ থাকলেও এখানে বিনিয়োগকারী সংস্থার স্বার্থই বড় এবং এ বিনিয়োগগুলো প্রায় এককালীন। গ্যাস কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে এখন আবার বিক্রি করে দিচ্ছে।
বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের কথা বলা হলেও কোনোটি এখনও অপারেশনে যেতে পারেনি। কাঠামোই দাঁড় করাতে পারেনি। কবে উৎপাদন হবে তার কোনো দিনক্ষণ ধার্য করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়লেও এখন পর্যন্ত ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট করতে পারেনি। এ আকারের অর্থনীতি নিয়ে প্রতিটি রাষ্ট্রই ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট করেছে বেশ আগেই।
Advertisement
জাগো নিউজ : ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টে ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা থাকে কীনা?
অধ্যাপক আবু আহমেদ : বড় অর্থনৈতিক দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে পার্টনার হতে না পারলে আমাদের অর্থনীতি টেকসই নাও হতে পারে। বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করে রফতানির জায়গা পাচ্ছে না।
চায়না প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। আমরা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। পাকিস্তান লুফে নিয়েছে। সিল্করুটের মাধ্যমে পাকিস্তান এ অঞ্চলের দেশগুলোকে এখন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ দিতে পারছে। পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ৩- এ নেমে এসেছিল। এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত পাঁচ বছরে চীন পাকিস্তানকে যা দিয়েছে, তা বিগত দিনে সকল বৈদেশিক সাহায্য মিলে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশলী অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিক সফলতা আনছেন বটে কিন্তু কোনো কোনো সম্মেলন বয়কট করছেন তিনি। এতে বাংলাদেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। সম্মেলনে গিয়ে কার সঙ্গে কথা বলবেন আর কার সঙ্গে বলবেন না, সেটি অন্য হিসাব কিন্তু সৌজন্যের খাতিরে প্রতিটি সম্মেলনকে গুরুত্ব দেয়া দরকার।
জাগো নিউজ : ভৌগোলিক রাজনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। চীনকে অধিক গুরুত্ব দেয়া...
অধ্যাপক আবু আহমেদ : চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো সময়ের দাবি। রাজনীতি যদি আমাদের অর্থনীতি খেয়ে ফেলে তাহলে এগোনো যাবে না। ভৌগোলিক রাজনীতির কারণে আমরা যে দেশটিকে পীর মনে করছি, সেই দেশ তো আমাদের কিছুই দিতে পারছে না।
রিলায়েন্স, আম্বানির কথা শোনা যাচ্ছে। তারা কি বাংলাদেশে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে? অস্থিরতা তো তাদের মধ্যেই বেশি। উৎপাদন ব্যয় তার চেয়ে দ্বিগুণ দামে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চাইছে। একটি দেশকে গুরুত্ব দিয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশকে অবহেলা করার তো কোনো মানে হয় না। চায়না গভীর সমুদ্রবন্দর করে দিতে চাইছে। ভারতের মন রক্ষা করতে গিয়ে চায়নার প্রস্তাব আমরা ঝুলিয়ে রেখেছি। তাহলে ভারত করে দিক? তিস্তার পানিই যখন দিতে চায় না, তখন ভারত আমাদের স্বার্থে কী দেবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আমি মনে করি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রেখেও চীনের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করতে এখনই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা উচিত বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : গা ঝাড়া দেয়ার জন্য ক্ষমতা লাগে। জনভিত্তির দরকার। আপনি সে ভরসা পান?
অধ্যাপক আবু আহমেদ : সরকারপ্রধান তো বিশেষ ক্ষমতা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। সবই তো তার ইচ্ছামতো হচ্ছে। কোনো কিছু তো আটকে নেই। তাহলে এক্ষেত্রে পারবে না কেন?
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি দেখে বাংলাদেশ ভারতেরও ছায়ায় আছে। তাহলে বাংলাদেশে তারা বিনিয়োগ করতে চাইবে না। তারা ভারতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশে রফতানি করতে চাইবে। আমি মনে করি, চীনের সঙ্গে যদি ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টে যাওয়া যায় তাহলে আমাদের বড় উপকার হবে।
জাগো নিউজ : চায়নার পক্ষ থেকে যদি তেমন সাড়া না পাওয়া যায়।
অধ্যাপক আবু আহমেদ : চায়না আমাদের জন্য ফাইল টেবিলে তুলেই রেখেছে। আগ্রহ দেখানোর ব্যাপার হচ্ছে আমাদের। এ কারণে বিনিয়োগের পরিবেশও তৈরি হচ্ছে না।
জাগো নিউজ : বিশাল অংকের অর্থ বাইরে পাচার হচ্ছে বিনিয়োগের পরিবেশ না পেয়ে, বলছে জিএফআই নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।
অধ্যাপক আবু আহমেদ : খুব স্বাভাবিক কথা। মানুষের অর্থ আছে। এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকি থাকলে পাচার তো হবেই।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, কালো টাকা হলে সরকার তা ধরছে না কেন? দ্বিতীয়ত, কালো টাকা দেশে রাখতে চাইলে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। সারা দুনিয়ায় বড়লোকের অর্থ বিনিয়োগের প্রধান জায়গা হচ্ছে শেয়ারবাজার। আমাদের এখানে শেয়ারবাজারের সর্বনাশ করা হলো। এখন আর কেউ এখানে বিনিয়োগ করতে চায় না।
স্বর্ণের বাজার কালোবাজারিদের হাতে দিয়ে রেখেছে। এটি পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। স্বর্ণের বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকলে চোরাচালান বন্ধ হতো। স্বর্ণ হচ্ছে ঝুঁকি নিরসনের অন্যতম একটি মাধ্যম। উন্নত বিশ্ব শেয়ারবাজার, স্বর্ণের বাজার, বিষয়ভিত্তিক মার্কেটে বিনিয়োগের সুযোগ পায়। আমাদের এখানে তো এসব আস্থাহীন।
জাগো নিউজ : এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যাপক আবু আহমেদ : আমি মনে করি, স্বর্ণের বাজার উন্মুক্ত করলে অর্থপাচার রোধ হবে। বিমানবন্দর দিয়ে চোরাপথে স্বর্ণ আসছে, আর পুলিশ জব্দ করছে। বলে বেআইনি। আইন করে রাখছ কেন? স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকার কোনো শুল্কও পাচ্ছে না। বিষয়গুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না। উন্নত বিশ্ব স্বর্ণের বাজার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা দেখেও ধারণা নিতে পারে সরকার।
বিষয়ভিত্তিক মার্কেটের ওপর সরকার জোর দিতে পারে। যেমন পাট বা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমে বড়লোকেরা বিনিয়োগ করে নিজের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন। গোটা দুনিয়াতেই এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে।
এএসএস/এমএআর/পিআর