দেশজুড়ে

‘মোরা’ মোকাবেলায় লাখো মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা আর বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত পৃথক প্রস্তুতি সভা করে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

Advertisement

ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ৩৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। এটি কক্সবাজারের কুতুবদিয়া হয়ে হাতিয়া ও স্বন্দীপে আঘাত হানতে পারে। তাই বিকেল থেকে কুতুবুদিয়ার উত্তর ও দক্ষিণ ধুরুং, আলী আকবর ডেইল এলাকাসহ পুরো উপজেলায় ৫২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক এলাকার লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে কাজ করছে। রাত ১০টায় ফলোআপ মিটিং করবে জেলা প্রশাসন।

এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। বেড়েছে পানির প্রবাহ। ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙছে কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়ি ও ঝাউবিথী। তলিয়ে যাচ্ছে বালিয়াড়ির ‘ওয়াকওয়ে’।

জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জানানো হয়, উপকূলের অন্তত তিনলাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনার সিদ্ধান্তের পর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ে নিরাপদে নিয়ে আসা লোকজনের জন্য সেহেরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথম সভার পরপরই উপকূলবর্তী এলাকাসমূহে দুপুর ১টা থেকে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত ও সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে চলছে সতর্কতামূলক মাইকিং।

Advertisement

কক্সবাজারের ৮টি উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামসহ মেডিকেল টিম গঠনসহ সর্বাত্মক আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ছুটিতে থাকা চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করেছে প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, উপকূলের ৫৩৭টি আশ্রায়ন কেন্দ্রকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া ঘোষণা দেয়া হয়েছে উপকূলবর্তী সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ী আশ্রায়ন কেন্দ্র। পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থার পাশাপাশি ৪ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ৮৮টি মেডিকেল টিম। খোলা হয়েছে উপজেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম।

জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় হওয়ায় গত উন্নয়ন সমন্বয় ও জেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিংসহ সব বৈঠকে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করার পরামর্শ সংশ্লিষ্ট সকলকে দেয়া হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সন্ধ্যার আগে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ও উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণকে সরিয়ে আনার নির্দেশনা নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। খোলা রাখা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো। শুকনো খাবার মজুদ ও সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, উদ্ধারকারী দল, দমকল বাহিনী, রেড ক্রিসন্টে সদস্যদের সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

Advertisement

তিনি আরও জানান, উপকূলীয় এলাকা থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে আগত জনসাধারণের যানমাল ও সম্পদ রক্ষার্থে আনসার-ভিডিপি সদস্যদেরকে পাহারায় থাকা, সমুদ্রে যাওয়া মাঝধরা ট্রলার ফেরত আনা, জনসাধারণসহ সকল উপজেলায় উদ্ধার কার্যক্রমে ন্যস্ত সকল সদস্যদেরকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

বৈঠকে কুতুবদিয়ার প্রতিটি ইউনিয়ন, মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কুতুবজুম, সদরের পোকখালী, চৌফলদন্ডী, খুরুশকুল, পেকুয়ার রাজাখালী, উজানটিয়া, মগনামা, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, সেন্টমার্টিন ও বাহারছড়া ইউনিয়নের লোকজনকে বিকেলের আগে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। যারা আসতে চাইবে না তাদের জোর করে নিয়ে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের সভায় কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ সোমবার বিকেল নাগাদ কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ৩৪৫ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি ক্রমে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি সোমবার রাত নাগাদ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমের সময় উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এখন বাতাসের গতিবেগ কম থাকলেও সন্ধ্যার পর গতিবেগ বাড়তে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে জোয়ার থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমনটি হলে উপকূলে জলোচ্ছাসের পরিমাণও বাড়তে পারে।

তিনি আরও জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার এবং সমুদ্রগামী জাহাজকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার পর রোববার মধ্যরাতে সেটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দফতর ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যানেলের তালিকা অনুযায়ী তখন এর নাম দেয়া হয় ‘মোরা’ (MORA)।

আবহাওয়াবিদ নাজমুল জানান, ‘মোরা’ থ্যাইল্যান্ডের প্রস্তাবিত নাম। নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়ার পরপরই সমুদ্র বন্দরগুলোকে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়। পরে ভোর ৬টায় সঙ্কেত বাড়িয়ে ৪ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত এবং ৯টায় বিপদ সংকেত জারি করা হয়।

সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/জেআইএম