গোড়ায় জল ঢেলে, যতই ডালপালা কাটি লাভ নেই। গোড়া শক্ত হবে, বিস্তার করবে শেকড়। ক’দিন পরই নতুন ডালপালায় ভরে উঠবে, বিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে গাছ। মৌলবাদের গোড়ায় জল ঢেলে, উপরের ডালপালা কেটে ছেটে লাভ কী? লাভ নেই কোনও। এই মৌলবাদ থেকেই জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে, বিস্তার ঘটে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের- ঘটছেও তাই।
Advertisement
ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে, তা সরানোর দাবি ছিল হেফাজতে ইসলামের। খুব বেশি দিন হেফাজতকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়নি। শখ মিটেছে, সুখ বোধ করছে হেফাজত এখন, তাদের দাবি মেনে নেয়াতে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায় বিচারের প্রতীকী ভাস্কর্যটি টেনে হিঁচড়ে সরানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণটি এখন জঞ্জাল মুক্ত, ভাস্কর্য মুক্ত, পবিত্র স্থান হয়ে উঠেছে। রমজানের আগে হেফাজতদের দাবি অনুসারে, পবিত্র করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ।
‘ভাস্কর্য’ না ‘মূর্তি’ এমন বিতর্ক যেমন করছে কেউ কেউ, তেমনি ইসলামি রাষ্ট্রে ভাস্কর্য, মূর্তি বা প্রতিকৃতি থাকা ‘জায়েজ’, ‘নাজায়েজ’ বিতর্কেরও অন্ত নেই। জগত এখন অনেক ছোট, গুগল সার্চ করলেই অন্য ইসলামিক রাষ্ট্রে প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য, মূর্তি আছে কিনা দেখতে পাওয়া যায়। জাস্ট গুগলে সার্চ করলেই হলো। জগত যতই ছোট হোক, মূর্খের কাছে তার কুয়ো’ই অনেক বড়, সেটাই তার জগত। কূপমণ্ডূক মানুষকে তাই বোঝানো সব সময়ই কঠিন যে, তাবৎ মুসলিম রাষ্ট্রে প্রতিকৃতি আর ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি রয়েছে।
তবে মুসলিম দেশ হিসেবে সৌদি আরবকে যদি উদাহরণ হিসেবে নেয়া হয় তাহলে মুসকিল। সে দেশে তো অন্য ধর্মের, অন্য বর্ণের, অন্য মতের কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। সৌদি আরবকে কট্টর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলাই ভাল।
Advertisement
শিল্প সবার জন্য নয়, অনেক পুরনো কথা। এতদিন পর এ কথা আবারও প্রমাণিত হলো। একজন শিল্পী যখন শিল্প সৃষ্টি করবেন, সেই শিল্পের ব্যাখ্যাটি তার নিজস্ব ও তিনিই সেটি জানবেন। কেন নারী আদল, কেন শাড়ি পরিহিত এমন অবান্তর প্রশ্নের ছড়াছড়ি। গ্রিক থেমিসের সঙ্গে বাঙালিয়ানার সংমিশ্রণে এক নতুন মাত্রা যোগ করা হয়েছিল ভাস্কর্যটিকে। ফুটে উঠেছিল ভিন্ন ধরনের নন্দন। ভাস্কর্যের অপসারণে শিল্প ও শিল্পী দুয়েরই অবমাননা হয়েছে।
প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য ইসলামে ‘বেদাত’ এমন কথার প্রচারে সমর্থন দিলে চারুকলা, জাতীয় নাট্যশালা, আর্ট গ্যালারি, শিল্পকলা একাডেমি এমন অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করা জরুরি হয়ে উঠবে। কেননা, ইসলাম অনুমোদন করে না এসবের অনেক কিছুই। শুধু তাই নয় প্রচলিত সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্য- সবই ‘বেদাত’ ইসলামে।
যে কোন প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য, স্থাপনা রাষ্ট্র তার প্রয়োজন অনুযায়ী স্থাপন, প্রতিস্থাপন, অপসারণ যে কোন কিছুই করতে পারে। নির্মাণ, পুনঃনির্মাণও পারে করতে। কিন্তু লক্ষণীয় ভাস্কর্য অপসারণটি কাদের চাওয়ায়, ইচ্ছায়, দাবিতে পূরণ করা হয়েছে। হয়েছে হেফাজতের শখ পূরণে। আমরা কি ভুলে গেছি হেফাজত কারা? ভুলে গেছি ২০১৩-এর ৫ মে কি হয়েছিল? যারা ধর্মের নামে মৌলবাদের রাজনীতি করে, যারা সারাদেশ অচল করে দিতে চেয়েছিল ১৩ দফার দাবিতে। যারা বীভৎস কর্মকাণ্ড করেছিল সারা ঢাকাজুড়ে। তছনছ করেছিল মতিঝিল। যারা হত্যা, খুনে, বীভৎসতায় বিশ্বাস করে, যারা মনে করে নারীরা ঘরের বার হলে ‘বেদাত’, নারীদের দেখলে যাদের তেতুঁল বলে মনে হয়, যারা নারীদের কেবল যৌনবস্তু ভাবে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ভাবে, যারা একই সঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখাকে বৈধ মনে করে, যারা আইন বহির্ভূত তিন তালাকের বীভৎসতায় বিশ্বাস করে- তাদের খুশি করতেই সরানো হয়েছে ভাস্কর্য। এ বড় লজ্জার, আপসকামিতার, মৌলবাদীদের সঙ্গে।
দেশকে যদি চাই পিছিয়ে দিতে। চাই অন্ধকারের পথে হাঁটতে, ফিরে যেতে চাই অসভ্য, আদিম সময়ে, তাহলেই কেবল ধর্মীয় মৌলবাদি গোষ্ঠীকে সমর্থন দেবো, পৃষ্ঠপোষকতা করবো নানাভাবে। পালবো, পুষবো, দুধ কলা দেবো খেতে। মনে রাখতে হবে, দুধ কলা দিয়ে পুষলেও সাপ শেষ পর্যন্ত ছোবলই দেবে।
Advertisement
সারা দুনিয়া যখন শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনের নতুন নতুন উচ্চতা স্পর্শ করছে, তখন ধর্মান্ধতার জালে আটকে যাচ্ছি আমরা। রাজনৈতিক লাভে, লোভে নিজেরাই পিছিয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আলো থেকে যোজন যোজন দূরে সরে পড়ছি। ভাস্কর্য একটি শৈল্পিক ভাবনা, সেটিকে ধর্মীয় চেতনা থেকে দেখতে হবে কেন। তাহলে তো চিত্রকলা, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, দর্শনের আরও অনেক কিছুই নিষিদ্ধ হবে। মৌলবাদকে সুযোগ দেয়া মানে অন্ধকারকে আহ্বান করা, অন্ধকারকে আহ্বান করা মানে বিজ্ঞানহীনতা, কূপমণ্ডূকতাকে সাধুবাদ জানানো। প্রগতিকে দূরে সরিয়ে দেয়া।
আজ ‘মূর্তি’ ‘নারীমূর্তি’ এসব বলে, ধর্মের অজুহাতে ভাস্কর্য অপসারণ হয়েছে, কাল না আবার এসব মৌলবাদীরা আস্কারা পেয়ে নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করে।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।jabberhossain@gmail.com
এইচআর/এমএস