বার্মিংহামে পাকিস্তানের সাথে প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের হার নিয়ে নানা কথা। আক্ষেপ-অনুশোচনা। বাড়াবাড়ি কিংবা আবেগতাড়িত সংলাপ নয়, আজও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ওই ম্যাচ। অনেকেই এটাকে নিকট অতীত বা সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তুতি ম্যাচ বলেও মন্তব্য করেছেন।
Advertisement
যেখানে তামিম ইকবালের শতরান আর ইমরুল কায়েস, মুশফিকুর রহীম, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে এক জয়ের স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়েছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। সেই হার তাই যন্ত্রণার কাটার মতো বিঁধছে ভক্তদের মনে।
আফসোস মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, জেতা ম্যাচ হাতছাড়া। দ্বিতীয়ত, ‘ফাহিম আশরাফ’ নামের এক আনকোরা তরুণের উইলোর দাপটে ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়া। যে ক্রিকেটারের এখনো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারই শুরু হয়নি, যিনি জীবনে কখনো ওয়ানডে খেলেননি, সেই ফাহিম আশরাফ নয় নম্বরে নেমে ২১৩.৩৩ স্ট্রাইকরেটে ৩০ বলে ৬৪ রান করে বাংলাদেশকে হারিয়ে দেয়ার কারণেই কথা হচ্ছে বেশি।
বাংলাদেশের ভক্ত ও সমর্থকদের বড় অংশের ঘুরেফিরে একটাই কথা, ওই অবস্থায় কেউ কি ম্যাচ হারে? ওয়ানডে অভিষেক না হওয়া কে এই ফাহিম আশরাফ? তবে কি তার প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট এ’র পরিসংখ্যান খুব সমৃদ্ধ? সমৃদ্ধ তো বহুদূরে, শুনে অবাক হবেন, ফাহিম আশরাফের পরিসংখ্যান খুবই দুর্বল। জীর্ন-শীর্ন।
Advertisement
পাঞ্জাবের কাসুরে জন্ম নেয়া এ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান কাম ডান-হাতি মিডিয়াম পেসার মানে অলরাউন্ডারের বর্তমান বয়স ২৩ বছর ১৩২ দিন। ফয়সলাবাদের হয়ে ৩১ টি প্রথম শ্রেণির খেলায় রান করেছেন সাকুল্যে ১২০৭। সেঞ্চুরি দুটি, হাফ সেঞ্চুরি চারটি। গড় ৩৩.৬২ আর স্ট্রাইক রেট ৬৩.৮৬।
লিস্ট এ’র পরিসংখ্যান আরও জীর্ন; ৩৮ খেলায় ৩০ বার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে সাকুল্যে সংগ্রহ ৩৮৮ রান। কোনো শতরান নেই। একটি মাত্র হাফ সেঞ্চুরি। গড় বেশ খারাপ, ১৫.৫২। আর স্ট্রাইক রেট ৮৩.২৬। এমন এক আনকোরা পারফরমারের ব্যাটিং তাণ্ডবে মাশরাফি, তাসকিন, শফিউল, সাকিব ও মিরাজের বোলিং দুমড়েমুচড়ে যাওয়াই যত প্রশ্নের খোরাক।
এ কারণেই ভক্ত ও সমর্থকদের যতবার ২৭ মে পাকিস্তানের কাছে গা গরমের ম্যাচে হারের কথা মনে হচ্ছে, প্রতিবারই ফাহিম আশরাফ উঠে আসছেন আলোচনায়। এটা ঠিক, ফাহিম আশরাফ এখনো আনকোরা। তার হাতে জয়ের সাজানো মঞ্চ ভাঙায় মনঃকষ্টটা একটু বেশি। সেটাও সত্য। যৌক্তিকও। অনেকেরই আক্ষেপ, ফাহিম আশরাফের বদলে শোয়েব মালিক পাকিস্তানের জয়ের নায়ক হলেও মনকে প্রবোধ দেয়া যেত। কারণ ইতিহাস জানান দিচ্ছে, শোয়েব মালিক পারেন ব্যবধান গড়ে দিতে। এসব পরিস্থিতিতে তার বেশ কিছু ম্যাচ জেতানো ইনিংস আছে। যেমন পারতেন আব্দুর রাজ্জাক আর শহীদ আফ্রিদিও।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এই তো ২০১৪ সালের ৪ মার্চ মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের রবিন লিগে ৩২৬ রানের বড়সড় স্কোর গড়ে জয়ের স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। আফ্রিদির এক ঝড়ো ইনিংসে ভেঙে চুরমার হয়েছিল সে স্বপ্ন। সাত নম্বরে নেমে ২৫ বলে সাত বিরাট ছক্কা ও দুই বাউন্ডারিতে ৫৯ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়েছিলেন শহিদ আফ্রিদি।
Advertisement
ঢাকার মাঠে বাংলাদেশের দর্শক-ভক্তদের প্রথম হতাশায় ডোবান মঈন খান। সময়কাল ১৯৮৭-১৯৮৮। বেক্সিমকো এশীয় যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) ক্রিকেটের আজকের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে পাকিস্তানিদের টুটি চেপে ধরেছিলেন বাংলার যুবারা। ৯০‘র ঘরে ৭ উইকেট হারিয়ে বসা পাকিস্তানের ত্রাণকর্তা হয়ে দেখা দেন মঈন খান। পরবর্তীতে হার্ডহিটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এবং ক্রিকেটের ব্যাকরণের বাইরে বেশ কিছু অদ্ভুত শট খেলা মঈন খান তখনো ছিলেন অানকোরা তরুণ। সংকটে তার হাত ধরে ২০০’র আশপাশে চলে যাওয়া পাকিস্তানকে আর শেষ অবধি ধরা সম্ভব হয়নি।
জাভেদ ওমর, জাহাঙ্গীর আলম, হাবিুল বাশার সুমন, সেলিম শাহেদ, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন ও হালিম শাহ’র মতো পারফরমারে গড়া বাংলাদেশ যুব দল শেষ পর্যন্ত মঈন খানের কাছেই হেরে যায়। হয়তো ভাবছেন, গতকালকের জয়ের প্রসঙ্গ তুলতে আবার সেই ১৯৮৭-র যুব এশিয়া কাপের প্রসঙ্গ তোলা কেন?
তোলা এই কারণে যে, পাকিস্তানের ইতিহাস জানাচ্ছে বিভিন্ন সময় আনকোরা ও অখ্যাত ক্রিকেটারের হাত ধরে স্মরণীয় অর্জন বা প্রাপ্তি। প্রাসঙ্গিক কারণেই এখানে পাকিস্তানের তিন তিনজন বড় অলরাউন্ডার ও সত্যিকার মাচ উইনারের কথা উপস্থাপন করছি। যারা এই ফাহিম আশরাফের মতো অত নিচে ব্যাটিং শুরু করেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের নম্বর ওয়ান ম্যাচ উইনার বনে গিয়েছিলেন।
অবাক করার মতো সত্য এই যে, আফ্রিদি, রাজ্জাক ও শোয়েব মালিক- তিনজনেরই অভিষেক হয়েছিল মূলত বোলার হিসেবে। যারা পরবর্তীতে নিজেদের ব্যাটিং যোগ্যতা, মেধা ও সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েই প্রতিষ্ঠ হন। প্রথমে দেখা যাক আফ্রিদির পরিসংখ্যান। পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি ৩৯৮ ওয়ানডে ম্যাচে ৬৮৯২ রান করেছেন ছয় সেঞ্চুরি আর ৩৯ হাফ সেঞ্চুরিতে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর নাইরোবির আগা খান স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডে কেনিয়ার সাথে অভিষেক ম্যাচে ব্যাটিং পাননি আফ্রিদি। কারণ তাকে দলে নেয়া হয়েছিল লেগস্পিনার হিসেবে। নেটে কোচ জাভেদ মিয়াদাদ আর সিনিয়র ব্যাটসম্যান সাঈদ আনোয়ার তার অবলীলায় যাকে তাকে ইচ্ছেমতো আক্রমণাত্মক শটস খেলতে দেখে পরের ম্যাচে তিন নম্বরে খেলার সুযোগ করে দেন।
১৯৯৬ সালের ৪ অক্টোবর নাইরোবি জিম খানা মাঠে শ্রীলঙ্কার সাথে পরের খেলায় তিন নম্বরে নেমে ৪০ বলে ১০২ করে বিশ্বরেকর্ড গড়ে হৈচৈ ফেলে দেন আফ্রিদি। ১০ নম্বর পজিশনে ক্যারিয়ার শুরু করা লেগস্পিনার আফ্রিদি সময়ের প্রবাহতায় ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পান। ম্যাচ উইনারও বনে যান।
আফ্রিদিই শেষ নন। পাকিস্তানে আরও দুজন ক্রিকেটার গত দেড়যুগে বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে অলরাউন্ডারের তকমা গায়ে মেখে বিশ্ব মানের পারফরমার বনে গেছেন। যার একজন আব্দুর রাজ্জাক। আর অন্যজন শোয়েব মালিক।
১৯৯৬ সালের ১ নভেম্বর লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের সাথে পেসার হিসেবে ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু রাজ্জাকের। অভিষেকে ব্যাটিং পাননি। ৭.৩ ওভার বল করে ২৯ রানে ২ উইকেট পেয়েই সন্তুষ্ট থাকেন।দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম ব্যাটিংয়ে নামেন ১১ নম্বর পজিশনে। কোন বল মোকাবিলা না করে ০ নটআউট।
এরপর ১১ থেকে নয় নম্বর পজিশনে ঘোরাঘুরি করে ১৯৯৮ সালের ৩ এপ্রিল ডারবানের কিংসমিডে দ. আফ্রিকার সাথে ৪৯ বলে ৪৬* নটআউট। তারপর থেকে ব্যাটিং পজিশনে উন্নতি। ২৬৫ ওয়ানডের ২২৮ বার ব্যাট করে ৫০৮০ রান করা রাজ্জাক তিন শতক ও ২৩ হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নিজেকে পেস বোলারে পাশাপাশি দক্ষ উইলোবাজ হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেন।
এরপর আছেন শোয়েব মালিক। ২৪৭ ম্যাচে ২২৪ বার ব্যাট করে নয় সেঞ্চুরি ৩৯ হাফ সেঞ্চুুরিতে ৬৭১১ রান করা মালিক ক্যারিয়ার শুরু করেন অফস্পিনার হিসেবে। প্রথম ম্যাচে তারও ব্যাট করা হয়নি। ১৯৯৯ সালের ১৫ অক্টোবর প্রথম ওয়ানডেতে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে শ্রীলঙ্কার সাথে ১০ নম্বরে নেমে ০ রানে জয়সুরিয়ার বলে আউট দ্বিতীয় ম্যাচেও ১০ নম্বরে নেমে ৩*।
চার নম্বর খেলায় ব্যাট পাননি পাঁচ নম্বর খেলাতেও ১০ নম্বর। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পাওয়া । সাত নম্বরে নেমে ৪৪ করার পর ব্যাটিং পজিশনের উন্নতি। সর্বাধিক ৮৪ বার ব্যাট করেছেন ছয় নম্বরে। আর ৭৯ বার পাঁচ নম্বরে ব্যাটিং করেছেন।
পেস বোলারের কোটায় দলে আসা ফাহিম আশরাফও যে একদিন ওই সব পূর্বসূরীদের মতো পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান- অলরাউন্ডার বনে যাবেন না- তাই বা কি করে বলা যায়? লক্ষণ কিন্তু তেমনই।
এআরবি/এনইউ/পিআর