পাহাড়ের বুক বেয়ে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু থেকে নিচে আছড়ে পড়ছে ঝর্ণার জলরাশি। পাহাড়ের ঢালু গড়িয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ। চারদিকে উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়, বুনোঝোঁপ, নামহীন রঙিন বুনোফুলের নয়নাভিরাম অফুরন্ত সৌন্দর্য যে কাউকে এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাবে। আর হিমশীতল জলরাশির কাছে গেলে এক পবিত্র স্নিগ্ধতায় ভরে উঠবে দেহমন। বলছিলাম খাগড়াছড়ির অন্যতম আশ্চর্য ‘রিছাং ঝর্ণা’র কথা।
Advertisement
মূল সড়ক ছেড়ে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ সিঁড়ি। আনুমানিক দুই শতাধিক ধাপ শেষে নিচে নামতে নামতেই আপনার কানে বেজে উঠবে প্রকৃতির শন শন শব্দ। সিঁড়িটি শেষ হতে না হতেই আপনি দেখা পেয়ে যাবেন কাঙ্ক্ষিত ঝর্ণার।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ১১ কি.মি. আর মাটিরাঙা উপজেলা সদর থেকে ১০কি.মি. দূরত্বে খাগড়াছড়ি-ঢাকা মূল সড়ক ছেড়ে ১ কি.মি. দক্ষিণে চারিদিকের পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝে অবস্থান ‘রিছাং ঝর্ণা’র। শুধু রিছাং ঝর্ণাই নয় ঝর্ণা অভিমুখে সমগ্র যাত্রা পথটাই দারুন রোমাঞ্চকর। কাছাকাছি দুটো ঝর্ণাকে ঘিরে প্রতিদিন বহু সংখ্যক পর্যটক এসে ভিড় জমান এখানে। আর সকলেই ঝর্ণার শীতল পানিতে গা ভিজিয়ে একাত্ম হন প্রকৃতির সঙ্গে।
মারমা ভাষায় ‘রি’ শব্দের অর্থ পানি আর ‘ছাং’ শব্দের অর্থ গড়িয়ে পড়া। পাহাড় থেকে অবিরত পানি গড়িয়ে পড়ে বলেই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘রিছাং ঝর্ণা’। যার অন্য নাম ‘তেরাং তৈকালাই’। কক্সবাজারের হিমছড়ি ও মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাতের পর রিছাং ঝর্ণাই হতে পারে দেশের অন্যরকম এক অকৃত্রিম সৌন্দর্য।
Advertisement
খাগড়াছড়ির বেশকটি ঝর্ণার মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় ‘রিছাং ঝর্ণা’। ২০০৩ সালে ভ্রমণ পিপাসুদের নজরে আসা রিছাং ঝর্ণা সময়ের ব্যবধানে খাগড়াছড়ির অন্যতম পর্যটন স্পট হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।
খাগড়াছড়ি-ঢাকা মূল সড়কের পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত রিছাং ঝর্ণার হিম শীতল বহমান স্বচ্ছ পানির আওয়াজ বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ঝর্ণার পাশাপাশি পাহাড়ি প্রকৃতি মনের মাঝে এক অনুপম অনুভূতির সৃষ্টি করে। ইচ্ছে করবে প্রকৃতির মাঝেই কাটিয়ে দিই সারাক্ষণ। ঝর্ণা ছেড়ে মন চাইবে না ফিরে আসতে কোলাহল মূখর কোনো জনারণ্যে ।
এখানে পাশাপাশি থাকা দুটি ঝর্ণার মধ্যে পর্যটকদের সুবিধার ঝর্ণায় যাওয়ার জন্য পাকা সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে আর প্রথম ঝর্ণাটি থেকে আরো প্রায় ২০০ গজ ভেতরে গেলে দেখা মিলবে দ্বিতীয় ঝর্ণাটির। মোহনীয় রিছাং ঝর্ণার পাশাপাশি সবুজ পাহাড় ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠির জীবনধারা আপনাকে নতুন কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।
১০০ ফুট উচুঁ পাহাড় থেকে নিচে গড়িয়ে পড়া জলধারা নেমে এসেছে সমতলে। মূলত ঝর্ণাটির বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যটির কারণেই অনেকে ঢালু এই পথে প্রাকৃতিক ‘ওয়াটার স্লাইডিং’ করতে ভালোবাসেন। যদিও পাথুরে স্লাইড বলে পিছলে নামার জন্য মোটা কাপড় বা ছালার মতো কোনো সামগ্রী ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া রিছাং ঝর্ণার পাদদেশে যেখান থেকে ঝর্ণার পানি সমতলের উদ্দেশে যাত্রা করেছে সেখানে চাইলে সাঁতার কাটা বা গোসল করার বাড়তি সুবিধাও আপনি নিতে পারেন।
Advertisement
রিছাং ঝর্ণাকে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় ও নিরাপদ করতে সেখানে ইতোমধ্যেই প্রবেশদ্বারে গেট নির্মাণ করেছে মাটিরাঙা উপজেলা প্রশাসন। পর্যটকদের সুবিধার্থে ঝর্ণার খুব কাছাকাছি চেঞ্জ রুম ও বাথরুম নির্মাণ করা হয়েছে জানিয়ে মাটিরাঙা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিএম মশিউর রহমান বলেন, পাহাড়ের সৌন্দর্যকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে রিছাং ঝর্ণা। রিছাং ঝর্ণা পর্যটকদের বার বার কাছে টানে এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সেখানে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কিভাবে আসবেন
রাজধানী শহর ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কলাবাগান থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে খাগড়াছড়িতে। হানিফ (এসি), সেন্টমার্টিন (এসি), এস. আলম, সৌদিয়া, শান্তি পরিবহন, ইকোনো, ঈগল (এসি/নন-এসি), শ্যামলী পরিবহন ও রিফাত বাসযোগে খাগড়াছড়ি আসতে পারেন আপনি। আর চট্টগ্রাম থেকে আসতে হলে আপনাকে অক্সিজেন অথবা কদমতলী বিআরটিসি বাস টার্মিনাল থেকে খাগড়াছড়ি অভিমুখী গাড়িতে উঠতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে যেকোনো বাসে সরাসরি খাগড়াছড়ি জেলা শহর বা মাটিরাঙা নামতে পারেন। সেখান থেকেই চাঁদের গাড়ি (জীপ), সিএনজি বা মোটরসাইলে চড়ে যেতে পারবেন রিছাং ঝর্ণায়। অবশ্য ব্যক্তিগত গাড়িতে (প্রাইভেট কার বা মাইক্রো) করেও যেতে পারবেন সেখানে।
কোথায় থাকবেন ?
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি শহরের প্রবেশমূখে চেঙ্গী নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত পর্যটন মোটেল ছাড়াও জেলা সদরের মিলনপুরে হোটেল গাইরিঙ ও ক্যান্টমেন্ট এলাকায় হোটেল ইকোছড়ি ইন। সেখানেও থাকা-খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে হাতের নাগালেই। এছাড়াও খাগড়াছড়ি শহরে থাকার জন্য রয়েছে একাধিক হোটেল। যেখানে থাকতে পারবেন অনেক কম মূল্যে।
তবে খাগড়াছড়ির অন্যতম আশ্চর্য্য ‘রিছাং ঝর্ণা’ দেখতে আসার আগে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পানি ও খাবার সঙ্গে নিয়ে আসবেন। ‘রিছাং ঝর্ণা’ ভ্রমণে যে কোনো তথ্য এবং সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন মাটিরাঙার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিরনজয় ত্রিপুরার সঙ্গে ০১৫৫৮৮৮৩২৫৩ নম্বরে অথবা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য চন্দ্র কিরণ ত্রিপুরার সঙ্গে ০১৭৭৪৬৯৮৮১৬ নম্বরে।
এফএ/পিআর