তাকে দলে নেয়া ছিল আসলে ‘আই ওয়াশ!’ বাদ পড়ার পর সবাই ঘরের ক্রিকেটে ভালো খেলে আবার জাতীয় দলে ফেরে। এটাই রীতি। অঘোষিত নীতিও। কিন্তু নাসিরের বেলায় যেন অন্য নিয়ম। ঘরোয়া ক্রিকেটে বার বার ভালো খেলে নিজের মেধা, মনন ও যোগ্যতার ছাপ রেখেও অবহেলিত নাসির। কেউ কেউ তাকে ‘ফিনিশার’ বলে ডাকলেও ক্রিকেটীয় ভাষায় নাসির হচ্ছেন ‘ইউটিলিটি ক্রিকেটার (কার্যকর পারফরমার)। ব্যাট, বল ও ফিল্ডিং তিন শাখায় যিনি সমান দক্ষ।
Advertisement
দলের প্রয়োজন মেটাতে যার জুড়ি মেলা ভার। সংকট, বিপদ ও প্রয়োজনে ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠা। কোন সময় বল হাতে ভাইটাল ব্রেক থ্রু দেয়া আবার কখনোবা এক দুর্দান্ত ক্যাচ তালুবন্দি করে প্রতিপক্ষকে ব্যাকফুটে ঠেলে নিজ দলকে উজ্জীবিত করায় নাসিরের মত দক্ষ পারফরমার খুঁজে পাওয়া কঠিন।
কিন্তু কথায় বলে না, ‘অতিবড় ঘরণী না পায় ঘর, অতি বড় সুন্দরী না পায় বর! নাসিরের যেন সেই অবস্থা। এত মেধা, যোগ্যতা আর পর্যাপ্ত সামর্থ্য থাকার পরও জাতীয় দলের বাইরে। সেই গত অক্টোবরে (২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর ) চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শেষ ওয়ানডে খেলেছেন। সাত মাস পর দেশের মাটিতে বিভিন্ন পর্যায়ে ভালো খেলে যাওয়ায় সুযোগ পেলেন, তাও শুধু ইংল্যান্ডের মাটিতে দশ বারো দিনের কন্ডিশনিং ক্যাম্প আর আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি টুর্নামেন্টে।
ইংল্যান্ডে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেললেও আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি টুর্নামেন্টের প্রথম তিন ম্যাচ ড্রেসিং রুমে আর ডাগ আউটে বসেই কেটেছে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ২৪ মে শেষ ম্যাচে অবশেষে সুযোগ পাওয়া। বল হাতে দুই উইকেট পেলেও ব্যাট হাতে নামা হয়নি। তারপর সেখান থেকে বার্মিংহাম হয়ে শুক্রবার বিকেলে দেশে ফিরে রাতটুকু পার করে শনিবার ফতুল্লায় মাঠে নেমেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলে গাজী গ্রুপের জয়রথ আবার সচল করা।
Advertisement
নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা সফরে সুযোগ মেলেনি। দেশের মাটিতে গত মার্চে এশীয় ইমার্জিং কাপ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া। নেপালের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো শতক হাকিয়ে নিজেকে মেলে ধরা। ইংল্যান্ড যাবার আগে মোহামেডানের বিরুদ্ধে প্রিমিয়ার লিগের প্রথম দিন ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু। চার ম্যাচে তিনবার নট আউট থেকে (১০৬*+৪১*+১৫*+৬৪) ২২৬ রান, পাশাপাশি (১/১৩+৩/৪০) = ৪ উইকেট শিকার। সব মিলে অলরাউন্ডিং পারফরমেন্সের অনুপম প্রদর্শনী। আর তাতেই ইংল্যান্ড সফর ও আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি টুর্নামেন্টের টিকিট পাওয়া।
কিন্তু স্বপ্নের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির স্কোয়াডের বাইরে থেকে দেশে ফেরত আসা। নাসির কেন, যে কোন ক্রিকেটারেরই মন খারাপ হবার কথা। সাত মাস পর জাতীয় দলে ফিরেও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে না পারার আক্ষেপ অনুশোচনায় দগ্ধ হবার কথা। কিন্তু শুনে অবাক হবেন, আয়ারল্যান্ড থেকে বার্মিংহাম হয়ে দেশে ফিরে কোনই আক্ষেপ নেই নাসির হোসেনের। ভেতরে হয়তো রক্তপাত হচ্ছে, কিন্তু শরীরি অভিবক্তি এবং কথা বার্তায় কোনই দুঃখবোধ নেই। ঠিক আগের মতই। একটু দ্রুত কথা বলা। চট জলদি স্বপ্রতিভ জবাব। সাত মাস পর সুযোগ পেয়েও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মত বড় মঞ্চে ওঠা হলো না। দুঃখ লাগছে না? একটুও কি খারাপ লাগছে না?
নাসিরের সাবলীল ও নির্ভার জবাব, ‘নাহ। কোনই আক্ষেপ নেই আমার।’ আফসোস-অনুশোচনা নেই কেন? শুনবেন? নাসির হতাশ নন। তার স্থির বিশ্বাস, জাতীয় দলে খেলার সামর্থ্য আছে পুরোপুরি। ঘরের ক্রিকেটে ভালো খেললে ঠিকই সুযোগ মিলবে। তাই তো জাগো নিউজের সঙ্গে আজ (শনিবার) সন্ধ্যায় একান্ত আলাপে ছোট অথচ দৃঢ় প্রত্যয়ী জবাব, ‘আক্ষেপ নেই। জানি ভালো খেললে ঠিক আবার দলে ঢুকবো।’
নাসির এমন কথা বলতেই পারেন। তার ভালোই জানা ‘ ফর্ম ইজ টেম্পোরারি। ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।’ কোন কারণে কিছুদিন বা একটা নির্দিষ্ট সময় হয়তো খারাপ কাটতে পারে। কিন্তু মান-গুণটা স্থায়ী। সেটা কখনো হারায় না। থেইে যায়। তাই নাসিরের মুখে ঐ কথা। এজন্যই তার অভিধানে হতাশ বলে কোন শব্দ নেই। নিজের সামর্থ্যের উপর যার প্রবল আস্থা, তিনিই তো প্রকৃত বীর।
Advertisement
নাসিরের ভালোই জানা, আমি পারি। ঘরের ক্রিকেটে ঠিক ভালো খেলবো। আর ভালো খেলে রান করলে ঠিক ডাক আসবে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচে সুযোগ পেয়ে শুরুতেই অধিনায়ক মাশরাফির বলে সহজ ক্যাচ হাত থেকে ফেলে দেয়া। সমালোচকরা নড়েচড়ে বসেন। মুখে বলতে শুরু করেন, ‘এই তো, এই না পারার কারণেই তাকে নেয়া হয় না।’
সমালোচকদের সে তীর্য্যক সমালোচনায় নাসির নির্বিকার। দেশে ফিরে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপে অকপট স্বীকারোক্তি, বিশ্বাস করেন, `প্রায় সাত মাস পর জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নামা, সব যেন যেন নতুন নতুন লাগছিল। তাই বলে ভাববেন না নার্ভাস বোধ করছিলেন। নাসিরের ভাষায়, আসলে জাতীয় দলে ফেরা এবং খেলা সহজ নয়। এজন্য সবাইকে লড়াই করতে হয়। তবে আমি বেশ কিছু দিন পর ডাক পাওয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখতে চাই। আমার বেশ ভালো লেগেছে। আবার দলে ফেরাকে আমি পজিটিভলি দেখতে চাই। এবং আমি মনে করি হঠাৎ জাতীয় দলে ফিরে ভালো পারফরম করা সহজ কাজ নয়।’
ছিলেন ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে। যেখানে এখন বেশ শীত। বাংলাদেশে শীতকালে গড় পড়তা যে তাপমাত্রা থাকে, তার চেয়েও অন্তত চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কম। সেখান থেকে ১২ ঘণ্টা আগে দেশে ফিরে শতভাগ বিপরিত আবহাওয়ায় পড়া। প্রচণ্ড গরম। সূর্য কিরণ যেন আগুনের লেলিহান শিখা। ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্রায় এক মাস কাটিয়ে দেশে ফিরে এমন সম্পূর্ণ বিপরিত ও বৈরি আবহাওয়াও তার ভালো খেলায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
তবে নাসির মানছেন, তার কষ্ট হয়েছে। বিশ্বাস করেন, এত গরম ভাবিনি। একমাস রীতিমত ঠাণ্ডায়ই ছিলাম। সেখান থেকে এসে মাঠে নেমেই আগুনের ভলকার মুখে পড়া। সত্যি বলতে কি মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। তারপরও চেষ্টা করেছি সাধ্যমত। কিন্তু মাঠে নেমেই বিপাকে পড়া। প্রথমেই দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া। এরপর আমি আর সৌরভ (মুমিনুল) মিলে এগিয়ে দিলাম। সৌরভ আউট হবার পর অমি ভাই (জহুরুল ৬) ফিরে গেলে আবার ব্যাকফুটে চলে যাই আমরা। তখন মনে হলো নাহ, আমাকেই দায়িত্ব নিয়ে খেলতে হবে। আমি আর ভারতীয় গুরকেরাত সিং মিলে প্ল্যান করলাম ৪৫ ওভার পর্যন্ত ব্যাটিং করবো। বাজে বল পেলে মারবো। আর ভালো বলগুলো থেকে অন্তত সিঙ্গেলস নেবার চেষ্টা করবো। এভাবে খেলে খেলেই এগিয়ে শেষ পর্যন্ত সাড়ে তিনশোতে গিয়ে ঠেকেছি।’
অধিনায়ক ফিরলে গাজী গ্রুপের শক্তির ভারসাম্য ঠিক হয়ে যাবে। ক`দিন আগে জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে এমনটাই বলেছিলেন কোচ সালাউদ্দীন। আজ নাসির দেশে ফিরে প্রথম দিন মাঠে নেমে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি উপহার দিয়ে কোচের কথা সত্য প্রমাণ করে ছাড়লেন। এখন নাসিরের লক্ষ্য কি? ‘গাজী গ্রুপকে চ্যাম্পিয়ন করা।’ সামনের তিন ম্যাচে সামর্থ্যের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করবো।’
ঘরোয়া ক্রিকেটে শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন আগেই। তবে সেটা পারফরমার হিসেবে। অধিনায়ক নাসির এখনো লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। এবার ক্যাপ্টেন নাসিরের হাতেই উঠবে প্রথম লিগ শিরোপা? সেটাই এখন তার মূল টার্গেট। জানেন, ভালো খেলে দলকে সাফল্য উপহার দিতে পারলে শুধু নামই হবে না, জাতীয় দলে ফেরা এবং জায়গাটা আবার মজবুত হবে।`
এআরবি/এমআর/আরআইপি