দেশজুড়ে

তোমাদের কাছে এই বোনটার আবেদন, আমাকে সাহায্য কর

‘ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম দুই বছর আগে। বাপের বাড়ি থেকে ১২ লাখ টাকা দিয়েও নির্যাতন শেষ হচ্ছে না। আমার একটা সন্তান আছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে এতদিন সব সহ্য করেছি। এখন এমন পর্যায়ে গেছে হয়তো তারা টাকার জন্য মেরে ফেলতে পারে আমাকে। আমার শাশুড়ি কুষ্টিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী। সবাই তাকে ভয় করে, কেউ আসেনি আমার জন্য বিচার করতে। টাকার পাহাড় করেও লোভের শেষ নেই তার। মানসিক অত্যাচারে আজ আমি Anxiety রোগী। হয়তো একদিন মেরে ফেলবে, তার আগে বাঁচার জন্য তোমাদের কাছে এই বোনটার আবেদন, আমাকে সাহায্য কর। বিচার চাই তোমাদের কাছে।’

Advertisement

যৌতুকলোভী শাশুড়ির অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে গত শনিবার নির্যাতনের রক্তাক্ত ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলেন এক সন্তানের জননী গৃহবধূ নিশাত সুলতানা রিম্পি।

যৌতুকের দাবিতে রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী কুষ্টিয়া শহরের ২০/৭ রাজু আহম্মেদ রোড কোর্টপাড়ার ঐশী মঞ্জিলের সামসুল হকের স্ত্রী শাহিন আক্তার শাবানা গৃহবধূ রিম্পিকে বেধড়ক মারপিট করে গৃহবন্দি করে রাখে। কয়েক দফায় চলে অকথ্য নির্যাতন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে নিজের রক্তাক্ত ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন গৃহবধূ রিম্পি।

ওই স্ট্যাটাসে রিম্পি উল্লেখ করেন তার শাশুড়ির অঢেল বিত্ত-বৈভব আর ক্ষমতার কাছে সবই নত হয়ে যায়। যে কারণে জল্লাদ শাশুড়ির হাতে থেকে বাঁচানোর জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না এমন আশঙ্কার কথা জানান তিনি।

Advertisement

নির্যাতিতা ওই গৃহবধূর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাসটি অনেকেই শেয়ার করলে বিষয়টি নিয়ে কুষ্টিয়াসহ সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। অনেকেই গৃহবন্দি নিশাত সুলতানা রিম্পিকে শাশুড়ির কবল থেকে মুক্ত করতে সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করেন।

এদিকে রিম্পির ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার বিষয়টি জানতে পেরে শাশুড়ি শাবানা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। আরেক দফায় নির্যাতন করে রিম্পির মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়। রাতের আঁধারে শাশুড়ি শাবানা পাজেরো গাড়িতে করে ঢাকার মোহম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির বিল্ডিং নং ১৫’র ফ্ল্যাট নং ৬০৪ নিজেদের বাসায় নিয়ে গিয়ে গৃহবধূ রিম্পিকে ফের গৃহবন্দি করে রাখেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি উঠে আসলে মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস সিলেটের বিভাগীয় চেয়ারম্যান আলহাজ কায়েস চৌধুরী নির্যাতিতা গৃহবধূ রিম্পিকে উদ্ধারের জন্য তৎপরতা শুরু করেন। কুষ্টিয়াতে খোঁজ নিয়ে রিম্পিকে না পেয়ে তিনি খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত রিম্পির শ্বশুর সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুল হকের কাছ থেকে তার ঢাকার বাসার ঠিকানা উদ্ধার করেন। বুধবার রাতে মানবাধিকার কর্মীরা গৃহবধূ রিম্পিকে ঢাকার মোহম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির বিল্ডিং নং ১৫’র ফ্ল্যাট নং ৬০৪ নং বাসা থেকে গৃহবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করেন।

উদ্ধারের পর ওই দিন রাত ১০ টার দিকে নির্যাতিতা ওই গৃহবধূ ঢাকার আদাবর থানায় শাশুড়ির নামে মামলা দায়েরের জন্য গেলে পুলিশ স্বামী রিংকুকেও আসামি করার কথা বলে। অন্যথায় মামলা নেয়া যাবেনা বলে জানায়। যে কারণে থানায় মামলা দায়ের না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হন রিম্পি। বর্তমানে রিম্পি ও তার স্বামী রিংকু ঢাকার মহম্মদীয়া ইউজিং সোসাইটি ৩ নং রোডের মায়ের ভাড়া বাসায় উঠেছেন বলে জানা গেছে।

Advertisement

রিম্পির বরাত দিয়ে মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস সিলেটের বিভাগীয় চেয়ারম্যান আলহাজ কায়েস চৌধুরী জানান, দিনাজপুরের মেয়ে রিম্পি দুই বছর আগে ভালোবেসে কুষ্টিয়া শহরের সামসুল হকের বড় ছেলে ইফতেখারুল আরেফিন রিংকুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রিম্পি-রিংকু দম্পতির একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ি শাবানা যৌতুকের দাবিতে রিম্পির ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে।

এ পর্যন্ত যৌতুক হিসেবে রিম্পির পরিবার ১২ লাখ টাকা তার শাশুড়িকে দিয়েছে। কিন্তু তাতেও মন ভরেনি। আরও যৌতুক দাবি করে প্রায়ই রিম্পিকে মারপিট করতেন শাশুড়ি শাহিন আক্তার শাবানা। এমনকি রিম্পির স্বামী রিংকু মায়ের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেও মারপিট করা হত। ঘটনার দিন গত শনিবার খুনতী দিয়ে রিম্পিকে বেধড়ক মারপিট করা হয়। রিম্পির সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানান কায়েস চৌধুরী।

ঘটনার পর থেকেই গৃহবধূ রিম্পি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নানাভাবে তাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। যে কারণে এত অত্যাচার-নির্যাতনের পরেও অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক শাশুড়ি শাহিন আক্তার শাবানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছেন নির্যাতিতা গৃহবধূ রিংকী।

কায়েস চৌধুরী জানান, শুক্রবার সকাল থেকেই রিম্পির মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজমুল হক চৌধুরী রুবেল জানান, নির্যাতিতা ওই গৃহবধূ মামলা দায়েরের জন্য কয়েক দফা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বৃহস্পতিবার রাতে নিশাত সুলতানা রিম্পি তার মোবাইলে ফোন দিয়ে বলেন শুক্রবার সকাল ৯টায় তিনি তার চেম্বারে আসবেন। কিন্তু শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত রিম্পি আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেন নি বলে ওই আইনজীবী জানিয়েছেন।

নির্যাতনের বিষয়ে জানতে গৃহবধূ রিম্পির শাশুড়ি শাহিন আক্তার শাবানার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত রিম্পির শ্বশুর সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুল হকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।

এদিকে দুদক সূত্রে জানা গেছে, সামান্য একজন রেল কর্মকর্তা হয়ে সামসুল হক ও তার স্ত্রী শাহিন আক্তার শাবানা কীভাবে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন এ বিষয়টি দুদক অনুসন্ধান করছে।

আল-মামুন সাগর/এমএএস/পিআর