মতামত

আমরা পুরুষ, ধর্ষক নই

পুরুষ খারাপ, পুরুষ খারাপ, পুরুষ খারাপ, পুরুষ লম্পট, পুরুষ লম্পট, পুরুষ লম্পট, পুরুষ ধর্ষক, পুরুষ ধর্ষক, পুরুষ ধর্ষক- মনে হয় জগতের সকল পুরুষই খারাপ, লম্পট, ধর্ষক। নষ্ট, বদমাস, দুঃশ্চরিত্র- সকল পুরুষ। আদতে তো তা নয়। হতেও পারে না কখনও। জগতের সকল মানুষ যেমন পারে না একই রকম হতে, তেমনি  সকল পুরুষও পারে না শুধু ভালো বা মন্দ হতে। প্রত্যেকেই যে যার মত। ভালো-মন্দ ব্যক্তি, ব্যক্তি চরিত্রের উপর নির্ভরশীল। তাই একজন পুরুষ হিসেবে, পুরুষের প্রতি এই মনোভঙ্গির তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অস্বীকার করছি। অসম্মতি প্রকাশ করছি এমন মন্তব্যের। শুধু তাই নয়, অন্য সকল পুরুষদেরও আমার মত প্রতিবাদ করা উচিত বলেই মনে করি আমি।

Advertisement

বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা পরপর ঘটেছে এখানে। এখনও ঘটছে।  একের পর এক ধর্ষণ ঘটছেই। মনে হয় ধর্ষণের এক অবাধ ভূমিতে পরিণত হয়েছে এদেশ। আজ হোটেলে তো কাল স্টেশনে। সকালে ভেড়ামারা, বিকালে ঠাকুরগাঁও। সন্ধ্যায় ফরিদপুর তো মধ্যরাতে চাঁদপুর। কোন বয়স নেই, কিশোরী-তরুণী-যুবতী-প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা- নিস্তার নেই কারো, ধর্ষণের হাত থেকে। এমন এক অসভ্য সময় ও পরিস্থিতি পার করছি আমরা। সম্ভবত এমন কোন নারী নেই বাংলাদেশে, যে ভেতরে ভেতরে ভীত সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত নয় ধর্ষণের ভয়ে।যত অসভ্য পরিস্থিতিই হোক, যত বীভৎস ধর্ষণ দৃশ্যই ভেসে উঠুক চোখের সামনে, সকল পুরুষকে দায়ী করা যাবে, নাকি উচিত হবে ধর্ষক বলা? তবে কেন সকল পুরুষদের ধর্ষক বলছি, দায়ী করছি?

কদিন ধরে দেখছি এখানে সেখানে ধর্ষণ নিয়ে বিক্ষিপ্ত মতামত, মুক্তমত প্রকাশিত হচ্ছে বেশ। ধর্ষণ নিয়ে লোকে বেশ সবর। নারীদের লেখায় ঘুরে ফিরে একই কথা, একই মন্তব্য। পুরুষ মানেই খারাপ। পুরুষ মানেই ধর্ষক। পুরুষের হাত থেকে বেঁচে থাকো। নিরাপদ থাকো। না হয় তোমাকে ধর্ষণ করবে পুরুষ। খুবই ভুল তথ্য, তত্ত্ব- হেইট স্পিচ।

ঘৃণা বাক্য ছড়িয়ে লাভ নেই। মনে রাখতে হবে এই পুরুষই কিন্তু আমার বাবা, আমার ভাই, আমার স্বামী, আমার সন্তান। নারী ও পুরুষ কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। প্রতিযোগী নয়। একের বিরুদ্ধে অন্যকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে লাভ কী? কেন দাঁড় করাচ্ছি একের বিরুদ্ধে অন্যকে। শত্রু ভাবাপন্ন সম্পর্ক পুরুষ-নারীতে এমন তো নয়।

Advertisement

আমরা পুরুষ, ধর্ষক নই। তাই ‘পুরুষ ধর্ষক’  যখন ঢালাওভাবে বলা হয় তাতে আমার প্রবল আপত্তি। জগতের সকল পুরুষকে কেন আমরা ধর্ষক বানিয়ে দিচ্ছি। ধর্ষক, ধর্ষকই। অপরাধ, অপরাধই। অপরাধীকে দেখতে হবে অপরাধী ব্যক্তি হিসেবেই। সকল পুরুষতো আর ধর্ষণ করে না, যৌন হেনস্তা করে না, নির্যাতন করে না, নিপীড়ন করে না, আগুনে পোড়ায় না, পাথর ছুঁড়ে না- তাহলে সবাইকে কেন এক করে ফেলছি? আর সত্যিকারের পুরুষ কখনোই ধর্ষণ করে না, করতে পারে না। অসম্ভব। যে ধর্ষক সে কাপুরুষ। পুরুষ ধর্ষক, তাই শাস্তি হিসেবে তার পুরুষাঙ্গটি কেটে ফেল, তাকে মৃত্যুদণ্ড দাও- এমন অযৌক্তিক সমাধান বাক্য ছুঁড়ছেন অনেকেই। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষকের এমন শাস্তি দাবি করে তোলপাড়। যে কোন মূল্যে তার ‘অঙ্গ’টি কেটে নিতে সরব অনেকেই। কিন্তু এতে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না আমার। কখনও মনেও হয়নি। খুব হটকারী ও হুজুগে আমরা। যুক্তির চেয়ে আমাদের আবেগ বেশি। ধর্ষণের জন্য পুরুষের এত ছোট দু’তিন ইঞ্চি অঙ্গটিকে দায়ী করে লাভ কী? পুরুষাঙ্গ মোটেও ধর্ষণ করে না। যদি তাই হতো তবে তো সকল পুরুষেরই এই অঙ্গ রয়েছে।

সকল পুরুষ কি ধর্ষণ করে, তা তো নয়। ধর্ষণ আসলে ‘অঙ্গ’ করে না, করে ‘মস্তিষ্ক’, ‘মানসিকতা’, ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’। যে মানসিকতার কারণে পুরুষ ধর্ষণ করে সেটিকেই চিহ্নিত করা জরুরি। সেটিকেই দায়ী করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বুঝতে হবে, ধর্ষকের মনোজগত, মানসিকতা আর সকল পুরুষের মানসিকতার চেয়ে আলাদা। এটি মানসিকতার একটি বিশেষ অবস্থা বা দশা। এই অবস্থাটি খুব স্বাভাবিক নয়, বিকৃত। ধর্ষকের ভালো লাগে ‘সেক্স’ নয়, ‘ভ্যায়োলেন্স’। চরম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, ক্ষোভ, ক্রোধ, নারীর প্রতি বিরুপ, পঙ্কিল মনোবৃত্তিই ক্রিয়াশীল থাকে। ‘পুরুষাঙ্গ’ অবলম্বন মাত্র।

চারপাশ থেকে মানুষ শেখে। শৈশব, বয়ঃসন্ধি আর বেড়ে ওঠার সময়টা তার বাকি জীবনকে প্রভাবিত করে প্রবলভাবে। এ সময়ের আলোচিত ধর্ষক, সাফাতের মানসিকতা বোঝা যায় তার বাবার অশ্লীল মন্তব্যে। ‘গুড পেরেন্টিং’ বলে কিছু ছিল না সেখানে। তার বাবাও নারীদের ‘যৌনদ্রব্য’  হিসেবেই বিবেচনা করেছে, দেখে দেখে ছেলেও দীক্ষা নিয়েছে বাবার মন্ত্রে। ঘরে স্ত্রীরা দাসী বাদী, যৌনবস্তু, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। তাদের মতামতের মূল্য নেই। গার্হস্থ্য বাদীগিরি, যৌনদাস বৃত্তিই তাদের নিয়তি। সন্তানরা এই দেখে দেখে বড় হয়। নারী মাত্রই স্তন আর যোনির মাংসপিণ্ড, মানুষ ভাবে না সে। ফলে বস্তু, পণ্য, দ্রব্যের মতো আচরণ করে তার সঙ্গে। মানসিকতার বদল না ঘটলে, দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে শুধু আইন দিয়ে লাভ হবে না কোনও। আইনতো ছিল তখনও, আছে এখনও।

পুরুষতান্ত্রিকতার যে বিশাল জাল তা ছিড়ে ফুড়ে নারী নয় কেবল, পুরুষও বেরিয়ে আসতে চায়। বেরুতে না পারলে মুক্তি নেই কারো, না পুরুষ, না নারীর। নারীর সঙ্গে পুরুষ যেমন নানা সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, তেমনি পুরুষও আছে জড়িয়ে, নারী পুরুষের নানা সম্পর্কে। নারীর যে অধিকার আন্দোলন, মুক্তি আন্দোলন তাতে পুরুষ কোনও না কোনওভাবে ভূমিকা রেখেছে সবসময়। ঐতিহাসিকভাবে এ কথা সত্য। এই উপমহাদেশে সতীদাহ প্রথার মতো বীভৎসতার বিরুদ্ধে পুরুষই দাঁড়িয়েছে। সহমরণের প্রতিবাদ করেছে। বিধবা বিবাহের আন্দোলন সেও তো পুরুষেরই ফসল। বিদ্যাসাগর আর রাজা রামমোহন রায়কে এই ভারতীয় উপমহাদেশ ভুলতে পারবে কোনও কালে? নারীদের পাশে তো পুরুষই দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

আমি পুরুষ। আমি মানুষ। সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ। অমানুষ নই, ধর্ষক নই। ধর্ষণ অসুস্থতা, ধর্ষক অসুস্থ, যৌন বিকারগ্রস্থ। আমি মানবিক, আমি প্রেমিক। ধর্ষণ নারীর জন্য যতটা না লজ্জার, তার চেয়ে শত সহস্র গুণ লজ্জার পুরুষের। এতে পুরুষের সম্মানই নষ্ট নয়। সম্ভ্রমবোধে আঘাত লাগে। তাই ধর্ষণে সত্যিকারের পুরুষদেরই প্রতিবাদ করা উচিত বেশি, পুরুষ হিসেবে আমার তাই মনে হয়।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।jabberhossain@gmail.com

এইচআর/এমএস